জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় এক ঐতিহাসিক অগ্রগতির কথা জানিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, আজকের আলোচনা ছিল অত্যন্ত ফলপ্রসূ এবং একটি ঐতিহাসিক মোড় তৈরি করেছে। তবে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় প্রতিবাদ কর্মসূচিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলার প্রতিবাদে ১০ মিনিটের ‘প্রতীকী ওয়াকআউট’ করেছে বামধারার তিনটি দলÑ সিপিবি, বাসদ ও বাংলাদেশ জাসদ।
গতকাল বুধবার বিকেলে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর প্রতিনিধির সঙ্গে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় পর্বের সংলাপের ১৮তম বৈঠকে সংবিধানের আওতাভুক্ত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। এর মধ্যে ছিল নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং ন্যায়পাল।
অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ জানান, আজকের (গতকাল) বৈঠকে নির্বাচন কমিশন গঠনসংক্রান্ত আলোচনা সম্পন্ন হয়েছে এবং সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ সংশোধনের মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠনে একটি নির্দিষ্ট কমিটি গঠনের বিষয়ে রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এই নতুন প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, একটি নির্বাচন কমিশন থাকবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং আইনে নির্ধারিতসংখ্যক নির্বাচন কমিশনারদের সমন্বয়ে। এদের মনোনয়নের জন্য একটি নির্বাচন কমিটি গঠিত হবেÑ যার নেতৃত্বে থাকবেন জাতীয় সংসদের স্পিকার। কমিটির সদস্য হিসেবে থাকবেন ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত), প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা এবং প্রধান বিচারপতির প্রতিনিধি হিসেবে আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি।
এতে বলা হয়েছে, কমিটি বিদায়ী কমিশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিন আগে প্রার্থী অনুসন্ধান শুরু করবে। যোগ্যতা-অযোগ্যতা, প্রার্থী আহ্বান এবং অনুসন্ধান পদ্ধতি নির্ধারিত হবে সংসদে প্রণীত আইনের মাধ্যমে।
প্রস্তাবনায় আরও বলা হয়, কমিটি অনুসন্ধানে প্রাপ্ত প্রার্থীদের জীবনবৃত্তান্ত স্বচ্ছভাবে যাচাই-বাছাই করে সর্বসম্মতিক্রমে একজনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং প্রতিটি কমিশনার পদের জন্য একজন করে নাম রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবে। রাষ্ট্রপতি তাদের পাঁচ বছরের জন্য নিয়োগ দেবেন।
এতে আরও বলা হয়, স্পিকারের অধীনে সংসদ সচিবালয় এই কমিটিকে প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা প্রদান করবে। বিদ্যমান ১১৮ অনুচ্ছেদের ২, ৪, ৫(ক) এবং ৬ উপ-অনুচ্ছেদ অপরিবর্তিত থাকবে। তবে ৫ উপ-অনুচ্ছেদে একটি নতুন অংশ যোগ করার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, যেখানে জাতীয় সংসদের জবাবদিহিতার আওতায় কমিশনের জন্য একটি আইন ও আচরণবিধি প্রণয়নের বিধান যুক্ত হবে।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের পূর্বের অবস্থান থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছাড় দিয়ে আজ যে ঐকমত্যে পৌঁছেছে, তা একটি স্বাধীন ও কার্যকর নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠার পথকে সুগম করবে। আমরা কমিশনের পক্ষ থেকে এই দায়িত্বশীল অবস্থানের জন্য সব রাজনৈতিক দলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
তিনি আরও আশাবাদ ব্যক্ত করেন, জুলাই মাসের মধ্যেই জাতীয় সনদ চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে। আমরা আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখব এবং আশা করছি শিগগিরই আমরা জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি পূর্ণাঙ্গ জাতীয় সনদে উপনীত হতে পারব।
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, বহুদিন ধরে নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। অতীতে ফ্যাসিবাদী পদ্ধতিতে একটি আইন করে একচেটিয়াভাবে রাষ্ট্রপতিকে নিয়োগের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, এ প্রক্রিয়াটি আর রাষ্ট্রপতির একক সিদ্ধান্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। কমিটির পাঠানো তালিকা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিতে বাধ্য থাকবেন।
উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনার পর প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রতিবাদ কর্মসূচিতে ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলার’ প্রতিবাদে ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ থেকে তিনটি দল ‘ওয়াকআউট’ করে।
মাইলস্টোন স্কুলে প্রতিবাদ কর্মসূচিতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ওপর ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলার’ অভিযোগ এনে সিপিবির রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘অতীতে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে স্বৈরাচারী শাসকরা যে ধরনের ঘটনাগুলো ঘটাত, তারই ছায়া দেখলাম। স্বৈরাচারে যারা ছিল, তারা এখানে নানা সংকট, ষড়যন্ত্র করবে, সেটা জানি। একজন উপদেষ্টাকে দেখলাম তিনি বলছেন, গতকালের ঘটনা স্বৈরাচারেরা করেছে। এটাকে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করাই (এখন) কাজ। আগে স্বৈরাচারী হাসিনা যখন বিপদে পড়ত, এ ধরনের কথা বলত; তার পাশে ১৪ দল বা অন্যরা বসে থাকত। বলত, সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করতে হবে। সে রকম দেখছি।’
ঐকমত্যের আলোচনা জরুরি হলেও ওয়াকআউটের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছেন জানিয়ে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘এ ঘটনার প্রতিবাদ করা ছাড়া এখানে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। এ জন্য ১০ মিনিটের জন্য থাকতে চাই না।’ পরে রুহিন হোসেন প্রিন্সকে সমর্থন জানান জাসদের স্থায়ী কমিটির মুশতাক হোসেন এবং বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ।