ঢাকা মঙ্গলবার, ২৯ জুলাই, ২০২৫

মশায় পরাজিত দুই সিটি করপোরেশন ৫ বছরে ব্যয় ৪০০ কোটি

শাওন সোলায়মান
প্রকাশিত: জুলাই ২৯, ২০২৫, ১২:৪৫ এএম

মশক নিধন কার্যক্রমে ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত পাঁচ বছরে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ৪০০ কোটি টাকারও বেশি ব্যয় করে পরাজিত হয়েছে মশার কাছে।

প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও নগরবাসী নিস্তার পায়নি মশার যন্ত্রণা থেকে। এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে নগরবাসীকে সহ্য করতে হচ্ছে অসহনীয় যন্ত্রণা। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছর মারা যাচ্ছে শত শত মানুষ।

তবুও ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, মশা নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হচ্ছে যথাযথ পদক্ষেপ। কিন্তু নগরবাসীদের মূল্যায়নে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন করপোরেশনের পূর্বের মেয়র এবং বর্তমানের প্রশাসকেরা। মশক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এই দুই সিটি করপোরেশন সফল হবে না বলেও অভিমত সাধারণ নগরবাসীর। তারা বলছেন, মশার কাছে পরাজিত হয়েছে সিটি করপোরেশন। 

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বিগত পাঁচ অর্থবছরের বাজেট পর্যালোচনায় দেখা যায়, মশক নিধন এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজে দুই সিটি করপোরেশনের ৪৩২ কোটি ৬৮ লাখ টাকারও বেশি খরচ হয়েছে। ডিএনসিসিতে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫০ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যে মশক ওষুধে ৩০ কোটি, আগাছা পরিষ্কার ও পরিচর্চায় ১ কোটি ৫০ লাখ, ফগার/হুইল/স্প্রে মেশিন পরিবহনে ৩ কোটি, মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে বিশেষ কর্মসূচিতে ২ কোটি, আউটসোর্সিং কার্যক্রমের জন্য ১২ কোটি এবং চিরুনি অভিযান পরিচালনায় ২ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এভাবে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫৩ কোটি ৩৫ লাখ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫২ কোটি ৫০ লাখ, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮৭ কোটি ৫০ লাখ এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৬১ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় করেছে ডিএনসিসি। সব মিলিয়ে ৫ বছরে মশক নিধনে ডিএনসিসি মোট ব্যয় করেছে ৩০৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে প্রায় ১৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। অন্যদিকে ২০২০-২০২৪Ñ এই চার অর্থবছরে ডিএসসিসি মশক নিধনে ব্যয় করেছে অন্তত ১২৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে ২০ কোটি ২ লাখ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩১ কোটি ২ লাখ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩১ কোটি ১ লাখ এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা ব্যয় করেছে ডিএসসিসি।

প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও কার্যত কে নো সুফল পায়নি নগরবাসী। বরং প্রতিবছর ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন ও কন্ট্রোলরুমের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে দেশজুড়ে দেড় হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। এদের মধ্যে মৃত্যু হয় ৭ জনের। ২০২১ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় সাড়ে ২৮ হাজার, মারা যান ১০৫ জন। তবে এই তালিকায় শুধু ঢাকায় মৃতের সংখ্যা রাখা হয়নি। ২০২২ সালে সর্বমোট ৬২ হাজার ৩৮২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হন এবং মোট ২৮১ জন মারা যান। এদের মধ্যে ১৮৫ জন ঢাকায় মারা যান। ২০২৩ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন।

এতে মৃত্যু হয় ১ হাজার ৭০৫ জনের। এদের মধ্যে ঢাকার ৯৮০ জন রয়েছেন। ২০২৪ সালে দেশজুড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন এবং মৃত্যু হয় ৫৭৫ জনের। মৃতদের মধ্যে ৩৪৩ জন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বাসিন্দা ছিলেন। চলতি বছর অদ্যাবধি দেশজুড়ে ৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে। এর মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের রয়েছে ৪২ জন। সব মিলিয়ে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দেশজুড়ে ২০২০ সাল থেকে অদ্যাবধি ২ হাজার ৭৪৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।

নগরবাসীরা বলছেন, কোটি কোটি টাকা খরচ করেও মশার কাছে পরাজিত হয়েছে দুই সিটি করপোরেশন। ডিএনসিসির আওতাধীন মিরপুরের পল্লবী এলাকার বাসিন্দা রমিজ উদ্দিন বলেন, ‘সিটি করপোরেশনকে যাবতীয় কর পরিশোধ করে আসছি। আমার নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার দায়িত্ব তাদের। কিন্তু আশপাশে তাকালে ডেঙ্গু মশার বিস্তারে সহায়ক পরিবেশ দেখতে পাই। আগে মেয়র ছিল, এখন প্রশাসক। পদে থাকা লোক বদলেছে, কিন্তু পরিস্থিতি বদলায়নি। কেউই মশার কামড় থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারছেন না।’ ডিএসসিসির আওতাধীন মতিঝিল এলাকার বাসিন্দা নূরে আলম বলেন, ‘একটি প্রচলিত কথা আছে যে মশা মারতে কামান দাগা। ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) অবস্থা হয়েছে তেমনি। এদের এখন আসলেই মশা মারতে কামান দাগানো বাকি আছে। আমাদের ট্যাক্সের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করেও মশার কাছে তারা পরাজিত আর ভুক্তভোগী আমরা। আমরা করের টাকাও দিচ্ছি, আবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ঘুরেও টাকা-পয়সা খোয়াচ্ছি।’

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডিস মশার পাশাপাশি ডেঙ্গু ভাইরাসের ধরন নিয়ে গবেষণার অভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না ডেঙ্গু পরিস্থিতি। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. লেলিন চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়া এখন ঢাকা ও ঢাকার বাইরেও ছড়িয়েছে, কারণ ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার ঘনত্ব ঢাকার বাইরেও বাড়ছে। তবে এখনো ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকাগুলোতে এর ঘনত্ব বেশি। ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ দিন দিন বাড়ছে, কারণ সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার মতো যে স্থানীয় ইউনিটগুলো রয়েছে, তারা সে ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে না বা নিতে পারছে না; যা নেওয়া দরকার। মশা নিয়ন্ত্রণে রাসায়নিক এবং পরিবেশগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি এ বিষয়ে কোনো জাতীয় পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়নি। যে ওষুধ বিদেশে কার্যকর, বাংলাদেশে সেটি কার্যকর হয় না। কারণ এডিস মশার পাশাপাশি ডেঙ্গু ভাইরাসের ধরন নিয়ে কোনো গবেষণা হচ্ছে না। পাশাপাশি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জনসম্পৃক্ততায় সংশ্লিষ্টদের কার্যক্রম দেখা যায় না, হলেও খুব সীমিত পরিসরে হচ্ছে। ফলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারেনি। এগুলো না করে শুধু মশা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ হবে না।’ ডেঙ্গুর প্রকোপ কবে নাগাদ কমে আসতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. লেলিন বলেন, ‘ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া উভয়ের বাড়তি লক্ষণ বিরাজমান। শ্রাবণ মাস চলছে, সামনে ভাদ্র। এই দুই মাসই বৃষ্টি হবেÑ অর্থাৎ ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া থাকবে। তবে বিগত সময়ের হিসাব অনুযায়ী, সারা বছরই রোগী পাওয়া যাচ্ছে।’

ডেঙ্গুর ধরন নিয়ে যে গবেষণা না করার বিষয়টি স্বীকার করছেন সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা। তবে ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষার পরেই প্রয়োগ করা হয় বলেও দাবি তাদের। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ডা. নিশাত পারভীন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমরা তো ‘মেডিক্যাল এপ্রোচে’ (চিকিৎসা পদ্ধতি) যাই না, ‘প্রিভেন্টিভ মেজার্স’ (প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা)-এ যাই।

তবে সব ওষুধই প্রয়োগের পূর্বে ‘পিপিডব্লিউ’ টেস্ট (মশা মারার কীটনাশকের কার্যকারিতা পরীক্ষা) এবং ‘আইইডিসিআর’ (রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট) থেকে পরীক্ষা করানো হয়। তাই ওষুধের কার্যকারিতা নেই, এমন দাবি সঠিক নয়। ওষুধ ব্যবহার করা হয় বাইরে (উন্মুক্ত স্থানে), কিন্তু ডেঙ্গু মশা বাসার ভেতরেও জন্ম নিতে পারে। এ জন্য জনসচেতনতা এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় গুরুত্ব দিচ্ছি। প্রতিটা এলাকায় গিয়ে গিয়ে নগরবাসীদের সচেতন করতে কথা বলছি। আমাদের সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে।     

তবে এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য ডিএনসিসি প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ এবং প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।