মঙ্গলবার, ২৯ জুলাই, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: জুলাই ২৯, ২০২৫, ১০:১২ এএম

ঠনঠন প্রতিরোধে ডেঙ্গু ভয়ংকর

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: জুলাই ২৯, ২০২৫, ১০:১২ এএম

ছবি -সংগৃহীত

ছবি -সংগৃহীত

আগেই আশংকা করা হয়েছিল ভরা মৌসুমে এবার ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে এডিস মশার দৌরাত্ম্য। আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যাও ছাড়াতে পারে আগের সব রেকর্ড। তারই সংকেত যেন পাওয়া গেল জুলাইয়ে। বর্ষার শুরু থেকেই বাড়তে থাকা ডেঙ্গুর প্রকোপ জুলাইয়ে ছাড়িয়েছে পূর্বের সব রেকর্ড। গতকাল সোমবার পর্যন্ত চলতি মাসের ২৮ দিনে আক্রান্তের সংখ্যা ছুঁতে চলেছে ১০ হাজারের ঘর। মৃত্যু হয়েছে ৩৬ জনের। এক মাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হিসাবে যা সর্বোচ্চ।

ভরা মৌসুমে অর্থাৎ আগস্ট-সেপ্টেম্বরে পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছাবে তা নিয়ে শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। আর এর অন্যতম কারণ হিসেবে ডেঙ্গুর প্রজননস্থল ধ্বংসে ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন তারা। একই সঙ্গে আবহাওয়ার তারতম্যও সমানভাবে দায়ী উল্লেখ করে তারা বলছেন, এখনই এডিসের জীবাণুবাহী মশার প্রজননস্থল ধ্বংস না করতে পারলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। প্রয়োজনে ক্রাশ প্রোগ্রাম চালানোর তাগিদ দিয়েছেন তারা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, জুলাইয়ের ১ তারিখে দেশের ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২২৭ জন। সর্বোচ্চ আক্রান্ত হয় ৭ জুলাই ৩২৪ জন। সব মিলিয়ে মাসের ২৮ তারিখ অর্থাৎ গতকাল সোমবার পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৯ হাজার ২৩৩ জনে। দিনে সর্বোচ্চ ৩ জনের মৃত্যু হয় গত ২৬ জুলাই। আর বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৯২৩ জনে। মৃত্যু হয়েছে ৭৮ জনের। এর মধ্যে জুলাইয়েই মারা গেছেন ৩৬ জন। আগস্ট আসার আগেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় ভাঁজ পড়েছে বিশেষজ্ঞদের কপালেও।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন, একই সঙ্গে উষ্ণ আর আর্দ্র আবহাওয়া। সব মিলিয়ে উপযুক্ত পরিবেশ এডিসের জীবাণুবাহী ডেঙ্গু মশার প্রজননের জন্য। গত বছরের শেষের দিকেও ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ঊর্ধ্বমুখি। যার ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের শুরু থেকেও আক্রান্তের সংখ্যা পুরোপুরি কমেনি। এর অন্যতম কারণ হিসেবে ডেঙ্গুর প্রজননস্থল ধ্বংসে ব্যর্থতা। প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। এখনই এডিসের জীবাণুবাহী মশার প্রজননস্থল ধ্বংস না করতে পারলে এবার কি যে পরিস্থিতি হবে তা কেউ কল্পনাও করতে পারছে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জুলাইয়ের আক্রান্তের এই পরিসংখ্যান বলছে, আগামী আগস্ট-সেপ্টেম্বরে পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তাই পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগাম পদক্ষেপ হিসেবে এডিস মশার প্রজননস্থল অপসারণ বা নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। বিশেষ করে রাজধানী বা রাজধানীর বাইরে যেসব হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীরা চিকিৎসাধীন তাদের বাড়ির ঠিকানা সংগ্রহ করে ওইসব বাড়িতে ক্রাশ প্রোগ্রাম চালাতে হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, কিছু কিছু হাসপাতালে, বিশেষ করে মুগদা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, আজগর আলী হাসপাতাল, সালাউদ্দিন হাসপাতালে সম্প্রতি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি। এই হাসপাতালগুলো থেকে রোগীর ঠিকানা সংগ্রহ করে সেই রোগীর বাড়ির আশপাশে মশা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদার করতে পারলে ওই এলাকায় সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব।  ডেঙ্গু রোগীটি যেখান থেকে আক্রান্ত হচ্ছে সেই জায়গায় ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা আছে। ভাইরাসবাহিত এডিস মশাটি যত দিন বেঁচে থাকবে জ্যামিতিক হারে ডেঙ্গু রোগ ছড়াতে থাকবে। তাই ডেঙ্গু রোগীর বাড়িকে কেন্দ্র করে ক্রাশ প্রোগ্রাম করা প্রয়োজন।

চলতি বছরের শুরু থেকেই কেন সারা দেশে এমন ডেঙ্গুরোগীর প্রকোপ এ বিষয়ে কবিরুল বাশার বলেন, উষ্ণ-আর্দ্র আবহাওয়া থাকার কারণে বাংলাদেশ মশা ও মশাবাহিত রোগ বিস্তারের জন্য উত্তম জায়গা। উপযুক্ত তাপমাত্রা, আর্দ্রতার সঙ্গে যোগ হয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ। বছরের শুরু থেকে ডেঙ্গুর চোখ-রাঙানি আরও আতঙ্কিত করে তুলেছে নগরবাসীকে। এমন পরিস্থিতিতে আর নির্দিষ্ট সময় না বরং সারা বছর এডিস মশা নিধনে অভিযান পরিচালনা করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, এরই মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন বাংলাদেশ স্কাউটস, বিএনসিসি এবং স্কুল ছাত্রছাত্রীদের এডিস মশা ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ স্কাউটস এবং বিএনসিসি সদস্যদের এ কাজে যোগ্য করে তোলার লক্ষ্যে তারা ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছে, যেটি অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। বিভিন্ন সেবামূলক সংস্থা এবং স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা এডিস মশা ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সম্পৃক্ত হলে অবশ্যই ভালো ফল আসবে। তবে তাদের এই কার্যক্রম নিয়মিতভাবে মনিটরিং করতে হবে।

একসময় ডেঙ্গু ঢাকার রোগ ছিল, কিন্তু এখন এটি বিস্তৃত হয়ে সারা দেশের প্রতিটি জেলায় ছড়িয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, মে মাসের শুরু থেকেই ডেঙ্গু ঊর্ধ্বমুখী, মাঠ পর্যায়ে এডিস মশার ঘনত্ব আমরা বেশি পাচ্ছি। মাঠ পর্যায়ের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ বছর চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগে অন্যান্য বছরের তুলনায় ডেঙ্গু বেশি হওয়ার ঝুঁকি আছে। ঢাকায়ও ডেঙ্গুর দাপট থাকবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোর পরিসংখ্যান বিবেচনায়, ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বেশি হয় ২০০০ সালে। ওই বছর সরকারি হিসাব মতে পাঁচ হাজার ৫০০ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় এবং ৯৩ জন মারা যায়।

সরকারি হিসাব মতে, ২০২২ সালে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৬২ হাজার ৩২১ ও মৃত্যু হয়েছে ২৮১ জনের। ২০২৩ সালের শুরু থেকে এ পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু রোগ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যারা চিকিৎসা নিয়েছে তাদের প্রায় অর্ধেক ঢাকার বাইরের জেলার।

পরিস্থিতি এমন চলতে থাকলে গত বছরের মতো এ বছরও রোগীদের ডেঙ্গু শকে চলে যাওয়ারও আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘এখন যে রোগীরা আসছেন হাসপাতালে তারা অনেকটাই ভালো আছে। অনেকেই চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। তবে যে হারে বাড়ছে এমন চলতে থাকলে গত বছরের মতো রোগীদের ডেঙ্গু শকে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছেই। আক্রান্তের সংখ্যা কখন কত হবে বলা যাচ্ছে না। কোথাও আজকে ১২৩ জন ভর্তি হলো, পরের দিন তা ২০০ জনও হতে পারে। যেহেতু এটি নিয়মিত বাড়ছে কোনো রোগীকে যেন বিনা চিকিৎসায় বাড়ি ফিরে যেতে না হয় সেজন্য আমরা সরকারি হাসপাতালগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছি। তারা প্রয়োজনীয় জনশক্তি, বেড এবং লজিস্টিকস সাপোর্ট তৈরি রাখবে। কিন্তু সমস্যা হলো ডেঙ্গু রোগীরা ডেঙ্গু শকে চলে গেলে, আক্রান্তের পাঁচ দিন পর রোগী যখন মনে করে সে সুস্থ হয়ে যাচ্ছে তখনই তাদের অবস্থা খারাপ হচ্ছে। জ্বর যখনই কমে আসছে, রোগীর রক্তচাপও কমে যাচ্ছে। ফলে মৃত্যুর আশঙ্কাও থাকছে।

তিনি বলেন, সাধারণত এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে ডেঙ্গু সেরে যায়। তবে কিছু রোগীর ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়তে পারে। এসব ক্ষেত্রে মৃত্যু হতে পারে। এই জটিল পরিস্থিতিকেই বলে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোম।

ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের উপসর্গের বিষয়ে তিনি জানান, এটি হলে শ্বাস-প্রশ্বাসে অসুবিধা হওয়া কিংবা শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে যাবে। ত্বক শীতল হয়ে যাবে। ত্বকের ভেতরের অংশে রক্তক্ষরণের কারণে ত্বকের ওপর লাল ছোপ সৃষ্টি হবে। বমি, মল কিংবা প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যাবে, প্রচণ্ড পেটব্যথা ও অনবরত বমি হওয়া, নাক ও দাঁতের মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ ও অবসাদ অনুভব হবে। শুধু তাই নয়, কখনো কখনো মস্তিষ্কের ভেতরেও রক্তক্ষরণ হতে পারে। এ রকম অবনতি দেখলে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।

চলতি বছর ডেঙ্গু রোগীর বাড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে আক্রান্তের সঠিক তথ্য না থাকাসহ মশা নিধনে দায়িত্বশীলদের ব্যর্থতাই অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. সালেহ মাহমুদ তুষার। রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগীদের নিয়ে সঠিক তথ্য না থাকার কারণে ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। পাশাপাশি ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশাও নিধন করা যাচ্ছে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিদিন ডেঙ্গু রোগীর বিষয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে তাতে শুধু হাসপাতালে ভর্তি রোগীর হিসাব করা হয়। কিন্তু বাসায় যারা চিকিৎসা নেন তাদের তথ্য কারো কাছে নেই। ফলে ডেঙ্গুর প্রজনন স্থল সম্পর্কে আমরা অন্ধকারেই থেকে যাচ্ছি। তাই করপোরেশনগুলো চাইলেও সব জায়গায় পৌঁছাতে পারছে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘ডেঙ্গুর ঊর্ধ্বগতি থামাতে না পারার কারণ হচ্ছে আমাদের কাছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সঠিক তথ্য নেই। যদি সঠিক তথ্য থাকত এবং হটস্পটটা চিহ্নিত করা যেত তাহলে একটা ব্যবস্থাপনা করা যেত। হটস্পটগুলোতে যদি আমরা ঠিকমতো লার্ভিসাইড এবং এডাল্ট্রিসাইডিং করতে পারতাম, মানুষকে সচেতন করতে পারতাম রোগীর সংখ্যাটা কমে আসত। সঠিক তথ্য এডিস মশা নির্মূলে সহায়তা করে।’

ডেঙ্গু রোগীর বিষয়ে যে তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দেয় আক্রান্তের সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে আরও বেশি মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘হাতে গোনা কয়েকটি হাসপাতাল রিপোর্ট করে। এর বাইরে কয়েক হাজার হাসপাতাল ও ক্লিনিক আছে যারা ডেঙ্গু রোগের সেবা দেয়। সেটা ধরেই গবেষকরা নির্ধারণ করেছেন আক্রান্তের সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে দশগুণ বেশি।’

Shera Lather
Link copied!