- মার্কিন শুল্কহার কমিয়ে ২০ শতাংশ নির্ধারণ
- ৭ আগস্ট রাত ১২টা থেকে শুল্কহার কার্যকর
- ভারতে গতকালই কার্যকর, নেতিবাচক প্রভাব
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের প্রধান রপ্তানিবাজার ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র। তবে শীর্ষে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানিতে প্রথম ধাক্কা আসে মার্কিন শুল্কনীতি নিয়ে। তিন মাস আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রপ্তানিপণ্যে ৩৫ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করেন। তবে সর্বশেষ বাংলাদেশের ওপর ১৫ শতাংশ শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশ করেছে দেশটি। যা কার্যকর হবে ৭ আগস্ট থেকে।
সংশোধিত ২০ শতাংশ মার্কিন শুল্ক ধার্য হওয়ায় পোশাক রপ্তানিতে বড় ঝুঁকি কমার সম্ভাবনা তৈরি রয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিযোগী অন্য দেশগুলোতে বাংলাদেশের ব্যবসা চলে যাওয়ার যে আশঙ্কা ছিল, তা এখন আর নেইÑ বলে জানিয়েছে পোশাক তৈরি ও রপ্তানি খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষ।
অন্যদিকে, মার্কিন শুল্কহার বাণিজ্য ঝুঁকি হ্রাসের ইঙ্গিত দেয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কহার হ্রাস পাওয়া আশাব্যঞ্জক হলেও আত্মতুষ্টির নয়। বরং এটি একটি সুযোগ ও একই সঙ্গে একটি সতর্কবার্তা বলেও জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
তবে মার্কিন ট্যারিফ ঘোষণার পরই গতকাল শুক্রবার থেকে ভারতে কার্যকর হয়েছে। এতে দেশটির শেয়ারবাজারে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। ভারতের অনেক গণমাধ্যম জানিয়েছে, গতকাল (শুক্রবার) থেকেই রপ্তানির ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ ট্যারিফ চালু হয়েছে। এ ছাড়া অতিরিক্ত পেনাল্টির দিকটিও সামনের দিকে উঠে এসেছে। ভারত যেভাবে রাশিয়ার সঙ্গে তেল ও প্রতিরক্ষা খাতে চুক্তি করেছে, তার সরাসরি প্রভাব ট্যারিফের ওপর পড়েছে বলে মনে করছেন ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এটা ভারতীয়দের পক্ষে সুখকর নয়। রপ্তানির ক্ষেত্রে বিরাট প্রভাব ফেলবে, সমস্যা তৈরি হবে। ট্রাম্পের এই ট্যারিফের জের সরাসরি ভারতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এর প্রভাব পড়েছে ভারতের স্টক মার্কেটেও।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ইতিবাচক বাণিজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রঘোষিত শুল্কহার কমানো নিয়ে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ছিল দেশটিতে অনুষ্ঠিত বৈঠকের আলোচিত ইস্যু। তবে ট্রাম্প প্রশাসন যে যুক্তির কথা তুলে ধরে পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়, বাংলাদেশ তা নিয়ে আগেই তিন থেকে চার মাস ধরে কাজ করেছে। যার কারণে গত শুক্রবার রাতের তৃতীয় বৈঠক শেষে ২০ শতাংশ করের সিদ্ধান্ত আসে।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, আগের দুই দফা বৈঠকে যেসব বিষয় অমীমাংসিত ছিল, সেগুলোতে উভয় দেশ একমত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যঘাটতি কমাতে বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বৃদ্ধি ও যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানি বোয়িং থেকে ২৫টি উড়োজাহাজ ও গম কেনার কথা জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। যার ফলে প্রতিযোগী অন্য দেশগুলোর সঙ্গে ২০ শতাংশের কাতারে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ।
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের নেতৃত্বে একটি দল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই আলোচনা করতেই ওয়াশিংটনে যায়। এই দলে রয়েছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরী।
ঘোষিত মার্কিন শুল্ক নিয়ে বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘মর্কিন ট্যারিফ এখন নির্ধারিত হয়েছে ২০ শতাংশ। ট্যারিফ যদি ৩৫ শতাংশ থাকতÑ তাহলে শঙ্কা ছিল। আমাদের ব্যবসা অন্য দেশে চলে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল, এখন তা নেই। কারণ, আমাদের ট্যারিফ আর অন্যদের ট্যারিফ সমান।’
তিনি রূপালী বাংলাদেশকে আরও বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশ ভারতের ট্যারিফ আমাদের চেয়ে ৫ শতাংশ বেশি। মার্কিন ট্যারিফ নীতির ফলে প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে বায়ার হান্টিং শুরু হতো। এতে একটা শঙ্কা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, এখন তার থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে গেল।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণা অনুযায়ী, ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে সইয়ের সাত দিন পর থেকে বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কার্যকর হবে। এই সময় গণনায় আদেশ সইয়ের দিনটি অন্তর্ভুক্ত নয়। শুল্ক কার্যকরের নির্দিষ্ট সময় হলোÑ পূর্বাঞ্চলীয় সময় অঞ্চল (ইটি) অনুযায়ী রাত ১২টা ০১ মিনিট, অর্থাৎ বাংলাদেশ সময় সকাল ১০টা ০১ মিনিট থেকে।
পূর্বাঞ্চলীয় সময় অঞ্চল অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ৭ আগস্ট রাত ১২টা ০১ মিনিটের মধ্যে পণ্য যদি জাহাজে লোড হয়ে ট্রানজিটে থাকে এবং ৫ অক্টোবরের মধ্যে তা গুদাম থেকে ছাড় করা হয়, সেসব পণ্য নতুন শুল্কহার থেকে অব্যাহতি পাবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। ৩১ জুলাই হোয়াইট হাউস এই সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করে। বাংলাদেশের জন্য পূর্বঘোষিত ৩৫ শতাংশ শুল্কহার কমিয়ে ২০ শতাংশে আনা হয়েছে, অর্থাৎ ১৫ শতাংশ কমানো হয়েছে। বাংলাদেশি ও মার্কিন কর্মকর্তাদের মধ্যে কয়েক সপ্তাহব্যাপী আলোচনার পর গতকাল এই শুল্ক কমানোর ঘোষণা দেয় ওয়াশিংটন।
মার্কিন সংশোধিত শুল্ক নিয়ে অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘নানা পদক্ষেপে যুক্তরাষ্ট্র শুল্কের হার ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করেছে, এটা ইতিবাচক দিক। এটা অন্য দেশগুলোর তুলনায়ও ন্যূনতম। যা বাণিজ্যঝুঁকি হ্রাসের ইঙ্গিত দেয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কহার হ্রাস পাওয়া আশাব্যঞ্জক হলেও আত্মতুষ্টির জন্য নয়। বরং এটি একটি সুযোগ ও একই সঙ্গে একটি সতর্কবার্তা।’
তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘উদাহরণ হিসেবে শ্রীলঙ্কার জন্য মার্কিন শুল্কহার কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়েছে, যেখানে আগে ছিল ৩০ শতাংশ। পাকিস্তানের হার কমে হয়েছে ১৯ শতাংশ, যা আগে ছিল ২৯ শতাংশ। বাংলাদেশের অন্যান্য প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম ও ভারতের ক্ষেত্রে ট্যারিফ হার ২০ শতাংশ ও ২৫ শতাংশ। কাজেই এটা আত্মতুষ্টির নয়।’
প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে শুল্কহারের তুলনা করে ফেসবুকে অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের নতুন শুল্কহার যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রতিযোগীদের হারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলো, যা তৈরি পোশাক খাতের ঝুঁকি কমিয়ে এনেছে। তবে চীনের শুল্কহার এখনো চূড়ান্ত না হওয়ায় বিশ্ববাণিজ্যে কিছুটা অনিশ্চয়তা থেকে যাচ্ছে’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সেলিম রায়হান বলেন, ‘যদি চীনের ওপর উচ্চ শুল্ক থাকে, তাহলে বাংলাদেশসহ কিছু দেশ লাভবান হবে। কিন্তু চীনের শুল্কহার কমলে তা প্রতিযোগিতা তীব্র করতে পারে।’ শুল্কহারে সাময়িক স্বস্তি মিললেও প্রতিদানে যুক্তরাষ্ট্রকে কী কী দেওয়া হচ্ছে, তা প্রকাশ করার ওপর জোর দেন তিনি। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে গোপনীয়তার চুক্তি হয়েছে, তার সমালোচনাও তিনি করেন। তবে পূর্বাঞ্চলীয় সময় অঞ্চল অনুযায়ী ৭ আগস্ট রাত ১২টা ০১ মিনিট থেকে বাংলাদেশের জন্য এই শুল্কহার কার্যকর করা হবে বলে জানিয়েছে ওয়াশিংটন।