ঢাকা শনিবার, ০২ আগস্ট, ২০২৫

সাক্ষাৎকারে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম

নির্বাচন-ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়ায় আ.লীগের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান অনিবার্য ছিল

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: আগস্ট ২, ২০২৫, ০১:৩৮ এএম

জুলাই অভ্যুত্থান চলাকালীন আন্দোলন বেগবান করতে সামনে থেকে সমন্বয়ের পাশাপাশি আড়ালে থেকে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, মাহফুজ আলম তাদের একজন। আন্দোলন চলাকালে আওয়ামী সরকারের ব্যাপক হত্যাকা- ও গণগ্রেপ্তারের মধ্যেও তা সচল রাখার কাজ করেছিলেন তিনি। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনের ফাঁকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের ‘ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ লিডার্স স্টেজ’ অনুষ্ঠানে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাকে চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানে নেপথ্যের নায়ক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন।


এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন মাহফুজ আলম। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে (বাসস) দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে জুলাই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট, ছাত্র-জনতার আকাক্সক্ষার সঙ্গে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ও আধুনিক রাষ্ট্র গঠন নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। 
মাহফুজ আলমকে প্রশ্ন করা হয়Ñ কোন কোন ঘটনা জুলাই অভ্যুত্থানকে অনিবার্য করে তুলেছিল? উত্তরে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ মূলত শাপলা-শাহবাগের বাইনারির দ্বারা এমন একটা রাষ্ট্রীয় বিভাজন সামনে এনেছিল, যেখানে রাষ্ট্রকে হয় ইসলামিস্ট, না হয় সেক্যুলার করার একটা দৃশ্য দেখানো হয়েছিল। এসব বিভাজনের আড়ালে মূলত ২০১৪ সালের নির্বাচনকে কুক্ষিগত করা হয়েছে। ২০১৫ সালে বিএনপির অসহযোগ আন্দোলন আর আওয়ামী সরকারের দমন-নিপীড়নের মাধ্যমে ‘বিরোধী দলের অস্তিত্বহীন’ একটা স্টাইলে বাংলাদেশকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বিরোধী দল শূন্যতার প্রেক্ষাপটেই দেখতে হবে ভ্যাট আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। তারপর ডাকসু নির্বাচন। ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই তিনটা যদি বিগ ইভেন্ট হিসেবে ধরি, তাহলে ১৮ সালের রাতের নির্বাচনের পর ধীরে-সুস্থে একটা ঘটনা ঘটছিল। আর সেটা হলো, মুজিববাদী সংগঠনগুলোর বাইরে তরুণদের একটা ডেমোক্রেটিক প্রেসার গ্রুপের আবির্ভাব ঘটছিল। 


এর বাইরেও যেই আন্দোলনের কথা উল্লেখ না করলেই না, তা হলো সীমান্ত হত্যাবিরোধী আন্দোলন। ... অন্যদিকে বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকা-ের মাধ্যমে ২০১৩ সাল থেকে ১৮ সাল পর্যন্ত ছিল শিবির সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলার একটি কালচার বজায় রাখা হয়েছিল। আবরার ফাহাদের শাহাদাতের পর এটা অনেকটা কমে আসে। আবরার ফাহাদের শহিদ হওয়ার ঘটনাটা আমাদের ভেতরে বড় একটা সংবেদনশীলতা তৈরি করেছিল। একদিকে আওয়ামী লীগের এমন দানব হয়ে ওঠা, আরেকদিকে ধীরে ধীরে আওয়ামী লীগ তৈরীকৃত বয়ানগুলো ধরে ধরে প্রতিরোধ গড়ে ওঠা, সব মিলিয়েই একটি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।


ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বাইরে স্বৈরাচার পতনের বিকল্প কোনো উপায় কি ছিলÑ এমন প্রশ্নের জবাবে মাহফুজ আলম বলেন, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন বা রাজনীতি করে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগকে নামানোর কোনো উপায় ছিল না। কারণ গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া নির্বাচন-ব্যবস্থাকে আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণরূপে নষ্ট করে দিয়েছিল। বিরোধী দলের অস্তিত্ব বিলীন করে দেওয়ার মাধ্যমে আসলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে নামার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছিল।


সেনাবাহিনী টেক ওভার করার একটা পদ্ধতি ছিল। বিডিআর ম্যাসাকার থেকে শুরু করে বিভিন্ন পলিটিক্যাল বিষয়ে জড়িয়ে নৈতিক শক্তি যেটাকে বলে, তা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া ১/১১ সরকারের ব্যর্থতা সেনাবাহিনীর মাথায় ছিল। শেখ হাসিনা ও তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারেক সিদ্দিকী দ্বারা যেভাবে সেনাবাহিনী ব্যবহার হয়েছিল, তাতে আসলে সেনাবাহিনীর মোরালিটি ভেঙে পড়েছিল। তাই আর্মির ক্ষমতা টেকওভার করার প্রক্রিয়াও আসলে বাস্তবিক ছিল না। তাই এ কাজ এমন একটা ফ্রন্টেরই করা দরকার ছিল, যারা অতটা শত্রুভাবাপন্ন নয়। জনতা অপেক্ষা করছিল সত্যিকারের নেতৃত্ব। ছাত্ররা সামনে এলেই শ্রমিক-জনতা নেমে গিয়েছিল। তাই বলা যায়, শেখ হাসিনার পতনের জন্য গণঅভ্যুত্থান অনিবার্য ছিল।


জুলাই গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন’ পদ্ধতির মাধ্যমে বিচারের কার্যকারিতা সম্বন্ধে এক প্রশ্নের জবাবে মাহফুজ আলম বলেন, কিছুদিন আগে স্বৈরাচারী আমলের নির্বাচন কমিশনার আদালতের কাছে বলেছেন যে আওয়ামী লীগের আমলে ভুয়া জাতীয় নির্বাচন হতো, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সেগুলো ছিল না। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বে থাকা একজন এ কথা বলার মাধ্যমে সত্যকে সামনে এনেছেন। এই কথাগুলোর স্বীকৃতি আওয়ামী লীগ থেকে আসতে হবে। কারণ বিচারিক প্রক্রিয়া ভিন্ন জিনিস আর কোশ্চেন অব মোরালিটির জায়গা থেকে আওয়ামী লীগের এই হত্যাকা- স্বীকার করেই সামনে আসতে হবে।


একজন শিক্ষক, তিনি গণহত্যায় অংশ নেননি। কিন্তু ওই শিক্ষক গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন। এই শিক্ষককে তো আপনি গণহত্যার শাস্তি দিতে পারবেন না, বরং তার পাপকে স্বীকার করে তাকে ক্ষমা চেয়ে সামনে এগোতে হবে। এখন ক্ষমা চাওয়ার দশ রকমের উপায় থাকতে হবে। কিন্তু তার জন্য ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশনের বাইরে কার্যকরী কোনো প্রক্রিয়া নেই। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি খুবই আশাবাদী। আমার ধারণা, এই পদ্ধতির মাধ্যমেই আমরা রাষ্ট্র হিসেবে আরও শক্তিশালী হব।


জুলাই গণহত্যার বিচার নিয়ে জনমনে নানা ধরনের প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে তথ্য উপদেষ্টা বলেন, আমাদের একটা স্পিডি ট্রায়াল দরকার ছিল; যেখানে দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচারিক প্রক্রিয়ায় খুন, গুম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের সাজা দেওয়া। কিন্তু সমস্যা হলো, বিচারব্যবস্থাও স্বৈরাচারী শাসনামলে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। যেসব বিষয়ের ওপর বিচার ও তদন্ত দাঁড়িয়ে আছে, সেই সব প্রতিষ্ঠানকেও নষ্ট করা হয়েছে। তাই যখন বিচার শুরু হলো, তখন প্রত্যাশার চেয়েও ধীরগতির হয়েছে। কিন্তু তবু এসব সংকট পেরিয়ে কিছু সমাধান আনার চেষ্টা করা হয়েছে। যেমনÑ দুটো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি, শুধু সরকার না; আমার ধারণা নাগরিকেরাও বিচার প্রক্রিয়া সহজ করতে হেল্প করছে। আশা করি দ্রুতই জুলাইয়ে শহিদ হওয়া পরিবার ও দেশবাসী দৃশ্যমান বিচার দেখতে পাবে।
মাহফুজ আলমের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, গণঅভ্যুত্থানের এক দফা দাবি ঘোষণার সময় নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের যে আকাক্সক্ষার কথা বলা হয়েছিল, আমরা কি অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে সেই আকাক্সক্ষার দিকে এগোতে পেরেছি? সংস্কারের মধ্য দিয়ে যেভাবে রাষ্ট্র যাচ্ছে, রাজনৈতিক সংস্কৃতিরও সংস্কার হচ্ছে কি? এই প্রশ্নের জবাবে মাহফুজ আলম বলেন, নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তখনই সম্ভব, যখন বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও চর্চার সংস্কার হবে। ভারত রাষ্ট্র গঠনের পর নেহরু যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন বিরোধী দল বলতে আসলে কিছুই ছিল না। নেহরুর সুযোগ ছিল ডিক্টেটর হয়ে ওঠার, যেহেতু বিরোধী বলতে কেউ নেই। কিন্তু নেহরু ক্ষমতায় এসেই জয়প্রকাশ নারায়ণকে ডাকলেন এবং বললেন, তোমরা একটা শক্তিশালী বিরোধী দল তৈরি করো, আমরা সাহায্য করব। তিনি একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতিটা জারি রাখতে চেয়েছিলেন। অপরদিকে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের পর শেখ মুজিবেরও একই অবস্থা ছিল, কিন্তু তিনি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের সুযোগটা গ্রহণ করেননি। মুজিববাদী রাজনৈতিক দলগুলো একই পন্থায় দেশ চালাতে চাইছে।


এখন আপনি যদি বিরোধী দল বা পক্ষকে সম্মান না জানান, তাদের একটা শক্ত অবস্থানে আসতে না দেন, তাহলে রাষ্ট্র কি সঠিকভাবে দাঁড়ায়? এটা তো রাজনীতির কোর একটা আইডিয়া। বিরোধী দলকে নিয়ে রাজনীতি করবে এরকম রাজনীতিবিদ বাংলাদেশে খুব কম বললেই চলে। একজন ছিলেন, বেগম খালেদা জিয়া। তাকে হাসিনা ভয়াবহ রকমের আক্রমণ করেছে, কুরুচিপূর্ণ কথা বলেছে। কিন্তু ওই অর্থে বেগম খালেদা জিয়া প্রতিহিংসার রাজনীতি করেননি। সমস্যা হলো, এই কালচারটা বাংলাদেশের পলিটিকসে তৈরি হয়নি।


এখনো দেখতে পাই, কোনো দলই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলকে স্পেস দিতে চায় না। আপনি যদি এটা জারি রাখেন, তাহলে তো আর রাজনৈতিক সংস্কার হলো না। গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকেও বিদ্যমান রাজনৈতিক চর্চার বাইরে নতুন সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।