ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কর্তৃত্ববাদী সরকার পতনের গণঅভ্যুত্থান ছিল সব মত-পথের মানুষের। তবে সরকার পতনে যে ঐক্য দেশের রাজনীতিকদের ছিল, নির্বাচন ইস্যুতে তার সবই ম্লান হওয়ার পথে। বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর একাংশের দাবি দ্রুততম সময়ে নির্বাচন। বিপরীত অবস্থানে রয়েছে এনসিপি-জামায়াতসহ কিছু রাজনৈতিক দল।
ডিসেম্বর থেকে সওে এলেও আগামী ফেব্রুয়ারি ধরে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে বিএনপি। এই লক্ষ্য ধরে দলীয় কর্মকা- সাজানো হচ্ছে। ভোটের সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ ঘোষণার পর পুরোদমে নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় মনোযোগ দেবে দলটি। নেতাকর্মীদেরও নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে তেমনভাবেই। একই সঙ্গে সমমনা দলগুলোকেও নির্বাচনে প্রস্তুতির বার্তা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
লন্ডন বৈঠকের পরপরই সরকারের পক্ষ থেকে ইসিকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বার্তা দেওয়া না হলেও আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক প্রস্তুতির এ আনুষ্ঠানিক নির্দেশনাকে সরকারের ‘নির্বাচন প্রস্তুতির প্রক্রিয়া’ হিসেবেই দেখছে বিএনপি। দলটির প্রত্যাশা, গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দেবেন, সেখানে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে স্পষ্ট বার্তা থাকবে।
এরই মধ্যে চলতি সপ্তাহেই নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার ইঙ্গিত দিয়েছেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তাই আগামী দু-তিন দিনের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ (পথনকশা) ঘোষণার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো ও সাধারণ মানুষের মধ্যে থাকা অনিশ্চয়তা ও সংশয় দূর হবে বলে মনে করছেন বিএনপির একাধিক নেতা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তবে বিএনপির দলীয় সূত্র বলছে, নির্বাচনি প্রস্তুতি নিলেও এই সময়ে নির্বাচন হওয়া নিয়ে শঙ্কাও আছে দলটির নেতাকর্মীদের মাঝে। বিশেষ করে জুলাই সনদ, জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা না হওয়া নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হতে পারে। এ ছাড়া জামায়াত-এনসিপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচন নিয়ে অবস্থানও শঙ্কার বড় কারণ। এসব দল নির্বাচন চাইলেও সংস্কার এবং জুলাই সনদের বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
এদিকে সংস্কারের একাংশ বাস্তবায়ন, জুলাই ঘোষণাপত্রের সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ বেশ কিছু বিষয় নির্বাচনের আগেই নিষ্পত্তি করতে চায় তারা। পরস্পর বিপরীতমুখী এই অবস্থান রাজনীতিতে সংকট সৃষ্টি করছে নানামুখী। ফলে বিরাজ করছে উত্তেজনা। মূলত নির্বাচন, সাংবিধানিক সংস্কার, জুলাই ঘোষণা ও জুলাই সনদকে ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার অনৈক্য বেশ স্পষ্ট। এখানেই শেষ নয়।
অভ্যুত্থানে ভূমিকা পালনকারী ছাত্র নেতৃত্বও পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদগার শুরু করেছে। এরই মধ্যে সরকারে থাকা জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া দুই ছাত্র প্রতিনিধির বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগও উঠেছে। চাঁদাবাজির অভিযোগে জেলে আছেন একাধিক ছাত্র প্রতিনিধিও। এত কিছুর পরও নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণার খবরে উঁকি দিচ্ছে সম্ভাবনা। বিএনপি নেতারা মনে করছেন, সংকটের সমাধান নির্বাচনের মাধ্যমেই।
রাজনৈতিক সংকট কাটাতে গত ১৩ জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সাথে তারেক রহমানের বৈঠকের পর জামায়াত, এনসিপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নতুন দাবি নির্বাচন বিলম্বিত করার ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছে বিএনপি। বিএনপি নেতারা মনে করেন, এসব করে দেশকে অস্থিতিশীল করা যাবে। কিন্তু দেশের মানুষের মুক্তি মিলবে না।
বিএনপি নেতারা মনে করেন, বিভিন্ন দাবি তুলে নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র করলেও প্রার্থী চূড়ান্ত কিংবা দলীয় প্রচারণা বেশ এগিয়েছে জামায়াত। জুলাই পদযাত্রার নামে কৌশলে সারা দেশে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি।
তবে বসে নেই বিএনপিও। নির্বাচন সামনে রেখে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী বাছাই শুরু না করলেও ভেতরে ভেতরে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের খোঁজ-খবর নিচ্ছে বিএনপি। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দলীয় নেতাকর্মীসহ এলাকায় মানুষদের কাছে প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতা, আন্দোলনে ভূমিকা, দলের প্রতি আনুগত্য, দেশপ্রেমসহ বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা হলে দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ শুরু হবে। আর নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোটারদের দোরগোড়ায় যেতে চাইছে দলটি। এ জন্য ৩১ দফা কর্মসূচি নিয়ে নেতাদের তৃণমূলে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন দলের হাইকমান্ড। পাশাপাশি চলছে দলের প্রাথমিক সদস্য সংগ্রহ অভিযান। এই কার্যক্রম চলবে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত। একই সঙ্গে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি গঠন, কমিটি পুনর্গঠন, মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি গঠনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকার পরিকল্পনা নিয়েছে দলটি।
আলোচনার টেবিলে যখন জুলাই সনদ নিয়ে ভিন্নমত, তখন শেষ মুহূর্তে জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তৈরি হয়েছে টানাপোড়েন। আলটিমেটাম, পাল্টা আলটিমেটামেও দলগুলোকে ঐকমত্য কমিশন থেকে সরবরাহ করা সনদের খসড়া নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছে কয়েকটি দল। জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টির পক্ষ থেকে খসড়া নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। এনসিপি জানিয়েছে, সনদের যে খসড়া দেওয়া হয়েছে, তা তারা গ্রহণ করতে পারছে না। দলটি চায় জুলাই সনদ ঘোষণার পদ্ধতি আগে জানাতে। জামায়াতের পক্ষ থেকে বলা হয়, সনদের খসড়াটি অসম্পূর্ণ প্রস্তাবনা।
দলটির পক্ষ থেকে জুলাই সনদ চূড়ান্তে দুটি ভিত্তির কথা বলা হয়েছে। এদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে চলমান আলোচনা শেষ করবে। সেই সময় পার হয়েছে। ওই সময়ের মধ্যেই একমত, দ্বিমত ও ভিন্নমতগুলো একত্রিত করে তৈরি হবে জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদ। এতে ঐকমত্যের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে, আর দ্বিমতের অংশগুলো ‘নোট অব দ্য ডিসেন্ট’ হিসেবে সন্নিবেশিত হবে। রাজনৈতিক দলের নেতারা স্বাক্ষর করবেন এই সনদে। ৫ আগস্টের মধ্যে যেকোনো একদিন স্বাক্ষরের জন্য দিন ধার্য করা হতে পারে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, প্রার্থী বাছাই ও নির্বাচনি ইশতেহারের কাজ চলছে। নির্বাচনি প্রক্রিয়া শুরু হলে সেটা আরও সামনে চলে আসবে। দলের কেউ যাতে বিপথগামী না হয়, সেই দিকেও তীক্ষè নজর রাখছে বিএনপি।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, প্রায় সব দলই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনকে স্বাগত জানিয়েছে। হয়তো কয়েকটা দল, হতে পারে যারা এর বিরোধিতা করেছে। সংস্কার ও জুলাই সনদের ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত নেই। সবাই বলেছে, এটা ঐকমত্যের ভিত্তিতে হবে। সেটা সংস্কার বলেন আর জুলাই সনদ বলেন। সেখানে তো কারো কোনো সমস্যা নেই। সরকার রোডম্যাপ ঘোষণা করলে সব সংকট, শঙ্কা কর্পূরের মতো উবে যাবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, লন্ডন বৈঠকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল নির্বাচন এবং ভোটের দিনক্ষণ। সেখানে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সাক্ষাতের পর আমাদের আশা ছিল, নির্বাচনের দিনক্ষণের বিষয়ে স্পষ্ট ঘোষণা আসবে। আমাদের দাবি, এ বিষয়টি স্পষ্ট করা হোক। তাদের কথাবার্তায় সন্দেহ বাড়ায়।
তবে সন্দেহ দূর করা উচিত সরকারকেই। পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ও জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনের দাবিকে অপকৌশল হিসেবে দেখছেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, আমাদের দাবি জাতীয় নির্বাচন দিয়ে দেশকে সামনের দিকে অগ্রসরের দিকে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু নতুন ইস্যু তৈরি নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার একটি অপকৌশল।