২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনের অবসানের এক বছরপূর্তিতে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা এক বিস্তৃত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে অভ্যুত্থানপূর্ব রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, আন্দোলনের বিস্তার, শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য ও সীমাবদ্ধতা তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান এক ঐতিহাসিক ঐক্যের উদাহরণ হলেও, এক বছর পর তা এখন রাজনৈতিক বিভক্তি, ন্যায়বিচারের দাবিতে হতাশা ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মাঝে দোদুল্যমান। তবুও যারা রক্ত দিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই এখনো আশার আলো দেখছেনÑ বাংলাদেশ যেন সত্যিকারের গণতন্ত্র ও সুবিচারের পথে এগিয়ে যায়।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সিনথিয়া মেহরিন সকালের মাথায় ছাত্রলীগের এক কর্মীর হামলা এবং রংপুরে পুলিশের গুলিতে শিক্ষার্থী আবু সায়েদের মৃত্যুই ছিল আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট। পরবর্তী সময়ে দেশের হাজারো ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক ও সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবনে বিক্ষোভকারীরা প্রবেশ করলে তিনি হেলিকপ্টারে করে ভারতে পালিয়ে যান।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ওই আন্দোলনে এক হাজার ৪০০-র বেশি মানুষ নিহত হন, হাজার হাজার আহত হন। ৮ আগস্ট দেশটির একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এরপর আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ এবং ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
তবে এক বছরের মাথায় সেই ঐক্য আজ ভেঙে পড়েছে বলে অভিযোগ করেছেন আন্দোলনের অন্যতম মুখ সিনথিয়া সকাল।
তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এখন ক্ষমতার লড়াইয়ে ব্যস্ত। পরিবর্তনের যে স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম, তা অধরাই থেকে যাচ্ছে।’
আন্দোলনে সন্তান হারানো সঞ্জিদা খান দীপ্তি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা ন্যায়বিচারের আশায় পথে নেমেছিলাম, কিন্তু এখনো অধিকাংশ খুনি ও দমন-পীড়নকারীরা বিচারবহির্ভূতভাবেই আছে।’
তবে অনেকেই এখনো অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আস্থা রাখছেন।
নারায়ণগঞ্জে পুলিশের গুলিতে আহত খোকন চন্দ্র বর্মণ বলেন, ‘পুরোনো দুষ্ট ক্ষতগুলো রাতারাতি যাবে না, তবে আমরা আশাবাদী।’ টিকটকার আতিকুল গাজী, যিনি এক হাতে দেশের পতাকা ওড়ান আর বলেন, ‘এক হাত গেছে, কিন্তু মনোবল হারায়নি।’
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, পুলিশের মনোবল ভেঙে পড়া এবং রাজনৈতিক সহিংসতার বাড়বাড়ন্ত। মানবাধিকার সংস্থা অধিকার জানায়, এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৭২ জন, আহত হয়েছেন ১,৬৭৭ জন। অপরাধ বাড়ছে, পুলিশ বলছে, তারা এখন প্রতিদিন বিক্ষোভ সামলাতেই ব্যস্ত।
অন্যদিকে অর্থনীতিতে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে, প্রবাসী আয় ও বৈদেশিক সহায়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে কর্মসংস্থানের সংকট, উচ্চ বেকারত্ব এবং যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ট্যারিফ দেশের প্রধান পোশাক খাতকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাজনৈতিক দলগুলো যদি প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারে, তবে অস্থিরতা আবারও বাড়তে পারে। কেউ কেউ একে ‘কসমেটিক রিসেট’ বলেও উল্লেখ করেছেন।
আপনার মতামত লিখুন :