জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির দিনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নিয়ে আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান করে জুলাই ঘোষণাপত্র তুলে ধরেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই ষোষণাপত্রে জুলাই শহিদদের জাতীয় বীর ঘোষণা করে শহিদ-পরিবার, আহত যোদ্ধা ও আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতাকে আইনি সুরক্ষার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী নির্বাচিত সরকার জুলাই অভ্যুত্থানকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেবে এবং সংবিধানের তপশিলে এই ঘোষণাপত্র সন্নিবেশিত করবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। তবে এই ঘোষণাপত্রকে স্বাগত জানালেও জুলাই বিপ্লবের প্রত্যাশা ও আকাক্সক্ষার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি বলে জানিয়েছেন অনেক রাজনৈতিক দলের নেতারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ ঘোষণাপত্রকে জুলাইয়ের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানেরই অর্জন বলে মন্তব্য করে রূপালী বাংলাদেশকে জানান, ঐতিহাসিক জুলাই বিপ্লবের আকাক্সক্ষাকে আমরা পূর্ণভাবে ধারণ করি। জুলাই বিপ্লব হলো ১৬ বছর ধরে দেশের সাধারণ মানুষের আকাক্সক্ষা। সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতেই গণঅভ্যুত্থান।
দলটির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুও বলেন, জুলাই বিপ্লবের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন করা না হলে অতীতের মতোই পুরোনো বন্দোবস্ত আবারও ফেরত আসবে, জনগণকে অধিকারহীন করবে। এ জন্য দেশের মানুষের কাছে আহ্বান জানাব, প্রত্যেক মানুষ যেন এক হয়ে জুলাই হত্যাযজ্ঞের বিচার, শহিদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ায় জাগ্রত পাহারাদার হয়ে থাকেন।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিও এই ঘোষণাপত্রকে স্বাগত জানালেও আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেয়নি। গতকাল ঘোষণাপত্র পাঠ শেষে সাংবাদিকদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘জুলাই ঘোষণাপত্র হয়েছে, এটাকে স্বাগত জানাই। ভালোভাবে পড়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো হবে। এটা যে হয়েছে সেটাকে অভিনন্দন।’
এদিকে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পেশ করার পরপরই ঘোষণাপত্র নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামী। দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, ঘোষণাপত্র সংবিধানে স্থান দেওয়ার কথা ছিল। সংবিধানে প্রিয়াম্বেলে চেয়েছিলাম, সেটা হয়নি। এ ছাড়া ৫ আগস্ট থেকে এই ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন হবে বলে আমরা শুনেছিলাম, কিন্তু এটা কখন থেকে বাস্তবায়ন হবে, তার কোনো নির্দেশনা নেই।
তিনি আরও বলেন, ঘোষণাপত্রে জুলাই আন্দোলনে শহিদ পরিবার কিংবা আহত যারা আছে তাদের বিষয়ে কোনো স্পষ্ট নির্দেশিকা নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের যেভাবে সুবিধা দেওয়া হয়েছে, সেভাবে জুলাই যোদ্ধাদের জন্য কোনো সম্মাননা রাখা হয়নি। জুলাইযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধাদের মতো আজীবন ভাতা দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল জামায়াত। এসব বিষয়ে ঘোষণাপত্রে স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা নেই। এটা একধরনের রচনার মতো হয়ে গেছে। এসব কারণেই আমরা হতাশ, পুরো জাতি হতাশ।
গণঅধিকার পরিষদের বেশির ভাগ প্রস্তাবই ঘোষণাপত্রে আসেনি বলে জানিয়েছেন দলটির সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর। তবে দেশের বৃহৎ স্বার্থে এই ঘোষণাপত্রকে সাধুবাদ জানিয়েছেন তিনি। নুরুল হক নুর বলেন, সংস্কারের বিষয়ে আমাদের একটি জোরালো অবস্থান ছিল। সেটি হলোÑ জুলাই সনদ স্বাক্ষরের পরই তা বাস্তবায়ন হবে। কিন্তু ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছেÑ আগামী সংসদ সেটি বাস্তবায়ন করবে। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্র সংস্কারের জনআকাক্সক্ষা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। তা ছাড়া জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি নিয়েও ঘোষণাপত্রে কার্যত কিছু বলা হয়নি।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি বলেন, ঘোষণাপত্রে সাধারণত এত বিস্তৃত ইতিহাস থাকে না, সংক্ষিপ্ত হয়। কিন্তু ঘোষণাপত্রে মূল থেকে অন্যান্য বিষয় বেশি চলে এসেছে। এই অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট ছিল গত দেড় দশকের অত্যাচার, নির্যাতন, গুম, খুন। এর মধ্যে ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলন ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন দেশের তরুণদের জাগ্রত করেছে। ফলে চব্বিশের আন্দোলন থেকে একটি অভ্যুত্থান হয়েছে।
ঘোষণাপত্রে দৃঢ় অঙ্গীকারের বিষয়টি না থাকায় খানিকটা হতাশা প্রকাশ করেছেন আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু। তিনি বলেছেন, ঘোষণাপত্র শুনে মনে হলো, শেষের দিকে এসে কিছুটা ব্যত্যয় ঘটেছে। আমাদের মনে হয়েছে, যেন শেষ হয়েও হইল না শেষ। বিশেষ করে আমরা দ্বিতীয় রিপাবলিক চেয়েছিলাম, যেটা জুলাই ঘোষণাপত্রে থাকবে। আরও অনেক কিছু চেয়েছিলাম, সেগুলো এখানে নেই।
তিনি বলেন, আমরা অনেক আশা করেছিলাম যে জুলাই ঘোষণাপত্রে দৃঢ় একটা অঙ্গীকারের কথা থাকবে। আমাদের প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে যে কথাটা ছিল, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার। আমাদের আক্ষেপ ছিল যে, সেগুলো আমরা পূরণ করতে পারি নাই। এবারও আমরা চেয়েছিলাম, সেরকম একটা প্রত্যাশার দীপ্ত অঙ্গীকার থাকবে।
মঞ্জু আরও বলেন, ঘোষণাপত্র শুনে মনে হলো শেষের দিকে এসে কিছুটা ব্যত্যয় ঘটেছে। আমাদের মনে হয়েছে, যেন শেষ হয়েও হইল না শেষ। মানের আশা পূর্ণ হয়েও কিছুটা অপূর্ণতা রয়ে গেছে। তার পরও আমরা মনে করি, এটি বড় একটা ঘটনা। ইতিহাস সৃষ্টিকারী ইভেন্ট আমাদের দেশে হয়েছে। আমরা আশা করি, আজকের এই ঘোষণাপত্র নতুন প্রজন্মকে নতুন করে জাগ্রত করবে। দেশবাসীকে শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
জুলাই ঘোষণাপত্র ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানেরই অর্জন বলে মন্তব্য করেছেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। তিনি বলেন, এই ঘোষণাপত্র ’২৪-এর জুলাইয়ের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানেরই অর্জন, সে কারণে এর আকাক্সক্ষাকে আমরা পূর্ণভাবে ধারণ করি। মুক্তিযুদ্ধসহ এ দেশের মানুষের শত শত বছরের সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় এই অর্জন সম্ভব হয়েছে বলে আমরা মনে করি।
সাকি আরও বলেন, এই আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন না করা হলে অতীতের মতোই পুরোনো বন্দোবস্ত আবারও ফেরত আসবে, জনগণকে অধিকারহীন করবে। কাজেই আমরা বাংলাদেশের মানুষের প্রতিই আহ্বান জানাব, প্রত্যেক মানুষ যেন এক হয়ে জুলাইয়ের হত্যাযজ্ঞের বিচার, শহিদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ায় জাগ্রত পাহারাদার হয়ে থাকেন; ন্যায়বিচার, সংস্কার, নির্বাচনের পথেই যা অর্জিত হবে।
জুলাই আন্দোলনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নেতৃত্ব দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী, বর্তমানে গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, আমাদের প্রত্যশা ছিল আরও আগে জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়া হবে। সেই প্রত্যাশা আনুযায়ী সেটা পাইনি। আজ এক বছরের মাথায় এসে অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের পর আমাদের কনসার্নের বাইরে গিয়ে ঘোষণাপত্র দেওয়া হয়েছে। আমাদের আরও অনেক বেশি প্রত্যাশা ছিল, সেটা পূরণ হয়নি।
আপনার মতামত লিখুন :