- মানিক মিয়া অ্যাভিনিউসহ রাজধানীজুড়ে নানা আয়োজন
- বৃষ্টি উপেক্ষা করে অংশ নেয় হাজারো মানুষ
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। রাজধানীজুড়ে নামে লাখো মানুষের মিছিলের ঢল। এর আগে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার কবল থেকে বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ৩৬ দিনের রক্তাক্ত আন্দোলনে স্বৈরাচারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কারফিউ ভেঙে ছাত্রদের এক দফার ডাকে রাজপথে নেমে আসে সর্বস্তরের জনতা। গতকালের এদিনে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটে। অগণিত তরুণ তাদের জীবন দিয়ে ফ্যাসিবাদমুক্ত করে স্বদেশ। পতন হয় ১৬ বছর ধরে চেপে বসা আওয়ামী স্বৈরাচারের।
নানা বর্ণাঢ্য আয়োজনে ৩৬ জুলাই উদযাপন করেছে সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা। গতকাল মঙ্গলবার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে অনুষ্ঠিত হয় বর্ণাঢ্য এই আয়োজন। পাশাপাশি রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী এবং পুলিশের যৌথ হামলায় নিহত ও আহত পরিবারের সদস্যরা এ উদযাপনে অংশ নিয়ে সব হামলার দ্রুত তদন্ত ও বিচারের দাবি জানিয়েছে। পাশাপাশি এক বছর পরও এসব হত্যাকা- ও হামলার বিচার না পাওয়ায় আক্ষেপ করেছেন শহিদ পরিবারের সদস্যরা।
গতকাল বৃষ্টি উপেক্ষা করেই রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে জুলাইয়ের বর্ষপূর্তি ও জুলাই ঘোষণাপত্র ঘোষণা প্রদান অনুষ্ঠানে বিকেল থেকেই মানুষের উপস্থিতি বাড়ে। এদিন বিকেলে মিছিল নিয়ে আসেন শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ফ্যাসিস্টের পলায়ন উদযাপন, ঐতিহাসিক জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ, স্পেশাল ড্রোন ড্রামা ‘ডু ইউ মিস মি?’সহ নানা আয়োজনে সাজানো ছিল ৩৬ জুলাই উদযাপনের এই আসর। শ্রাবণের বৃষ্টি উপেক্ষা করে হাজারো মানুষের ঢলে ভিন্ন এক ভালো লাগার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। হাতে লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়ে ও মাথায় পতাকা বেঁধে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দেশপ্রেম মূর্ত করে তোলে সর্বস্তরের জনতা। এরই মধ্যে মঞ্চে পরিবেশিত হয় দ্রোহের গান।
সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীদের সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে দুপুর ১২টায় শুরু হয় দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠান। তারা একে একে পরিবেশন করে ‘এই দেশ আমার বাংলাদেশ’, ‘আয় তারুণ্য আয়’, ‘জীবনের গল্প’, ‘ওমা আর কেঁদো না’, ‘যাদের জন্য পেলাম আবার নতুন বাংলাদেশ’, ‘জারিগান’সহ ইসলামিক সংগীত। এরপর ‘কলরব শিল্পীগোষ্ঠী’ পরিবেশন করে ‘তোমার কুদরতী পায়ে’, ‘দে দে পাল তুলে দে’, ‘ধন ধান্যে পুষ্পভরা’, ‘ইঞ্চি ইঞ্চি মাটি’ ও ‘দিল্লি না ঢাকা’। একক সংগীত পর্বে নাহিদ পরিবেশন করেন ‘পলাশীর প্রান্তর’ ও ‘৩৬ জুলাই’সহ দুটি গান। এরপর ‘নোঙর তোল তোল’, ‘তুমি প্রিয় কবিতা’, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’, ‘চল চল’ ও ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা’ গানগুলো পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী তাশফি। গানের ফাঁকে ফাঁকে সেøাগানে প্রকম্পিত করে তোলেন ছাত্র-জনতা।
এরপর বেলা ২টা ২৫ মিনিটে বেলুন উড়িয়ে ফ্যাসিস্টের পলায়ন উদযাপন করা হয়। এরপর সংগীত পরিবেশন করেন ‘চিটাগাং হিপহপ হুড’। তারা গেয়ে শোনায় ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘আমরা আসছি ঢাকা কাঁপাইতে’সহ কয়েকটি গান।
র্যাপার সেজান গেয়ে শোনায় ‘কথা ক’, ‘হুদাই হুতাশে’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’সহ কয়েকটি র্যাপ সংগীত। ব্যান্ডদল শূন্য পরিবেশন করে ‘শত আশাদ’, ‘বেহুলা’, ‘রাজাহীন রাজ্য’ ও ‘শোন মহাজন’সহ কয়েকটি গান। এরপর মঞ্চে উঠেন কণ্ঠশিল্পী ইথুন বাবু ও মৌসুমি। দলীয়ভাবে তারা পরিবেশন করে ‘আমাদের বাংলাদেশ’, পলাশ গেয়ে শোনায় মা’ মৌসুমি গেয়ে শোনায় ‘দেশটা তোমার বাপের নাকি’, ‘এখনো আমরা জেগে আছি’ ইত্যাদি। এরপর সংগীত পরিবেশন করেন সায়ান, ব্যান্ডদল সোলস, ওয়ারফেজ, বেসিক গিটার লার্নিং স্কুল, ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ব্যান্ডদল এফ মাইনর, কণ্ঠশিল্পী পারশা মাহজাবীন পূর্ণী, কণ্ঠশিল্পী এলিটা করিম। বিকেলে পাঠ করা হয় ঐতিহাসিক জুলাই ঘোষণাপত্র।
সবশেষে ছিল ড্রোন ড্রামা শো ‘ডু ইউ মিস মি?’। ড্রামাটি লিখেছেন ‘দ্য অ্যানোনিমাস’। বাংলাদেশ সরকার এবং চীন সরকার কর্তৃক যৌথভাবে এ ‘ড্রোন শো’-তে প্রায় ২ হাজার ড্রোন উড্ডয়নের মাধ্যমে জুলাইয়ের গল্প তুলে ধরা হয়। জুলাইয়ে ঢাকাসহ সারা দেশের ছাত্র-জনতা স্রোতের মতো বেরিয়ে এসে আন্দোলনে নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটায় এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। সেই জীবন্ত মুহূর্ত ও সেøাগান এবং গ্রাফিতিসমূহ প্রদর্শন করা হয় ‘ড্রোন শো’-এর মাধ্যমে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতিকে পুনর্জাগরণে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মাসব্যাপী কর্মসূচির অংশ হিসেবে জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সহযোগিতায় এই আয়োজনের ব্যবস্থাপনায় ছিল শিল্পকলা একাডেমি।
মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ছাড়াও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গৌরবময় অর্জন রক্ষা, শহিদদের স্মরণ এবং ইসলামপন্থিদের প্রতি চলমান বৈষম্যের প্রতিবাদে রাজধানীর শাপলা চত্বরে অনুষ্ঠিত হয়েছে ইন্তিফাদা বাংলাদেশ আয়োজিত গণসমাবেশ। ইন্তিফাদা বাংলাদেশের গণসমাবেশে অংশ নেন জুলাই আন্দোলনের সক্রিয় অংশগ্রহণকারী নেতা, ওলামায়ে কেরাম, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিকসহ সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরা। গতকাল বেলা ১১টায় শুরু হয় এ গণসমাবেশ। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন ইন্তিফাদা বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য মাওলানা মীর ইদরিস। বক্তব্য দেন, প্রেসিডিয়াম সদস্য আহমাদ রফিক, মুফতি তারেকুজ্জামান, আসিফ আদনান, ডা. মেহেদী হাসান, ডা. শামসুল আরেফীন শক্তি, জাকারিয়া মাসউদ।
এ ছাড়া ফ্যাসিবাদ পতনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে তিন দিনের আয়োজন শুরু করেছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। গতকাল থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে চলবে এই অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের সূচনা হয় গতকাল ভোর ৫টায় টিএসসি থেকে প্রতীকী ‘ফতেহ গণভবন’ পর্যন্ত একটি সাইকেল র্যালির মধ্য দিয়ে। আয়োজনের মধ্যে ছিল, ডকুমেন্টরি প্রদর্শনী, বিপ্লবী গান ও কবিতা, শহিদ পরিবার ও আহতদের স্মৃতিচারণ, বিকেলে মাইম পরিবেশনা ও নাটক এবং রাতে ‘প্ল্যানচেট বিতর্ক।’
আপনার মতামত লিখুন :