ওষুধ জীবন রক্ষার্থে একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক হিসেবে বিবেচিত। স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলায় মানুষ ওষুধের ওপর নির্ভরশীল। নিরাপদ ও মানসম্মত ওষুধ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের প্রয়োজনীয় নীতিমালা তৈরি, তদারকি ও নিয়ন্ত্রণে একটি সংস্থা কাজ করে। বাংলাদেশে এ-সংক্রান্ত সব নিয়ন্ত্রণমূলক কর্মকা- পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ হচ্ছে ‘ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর’ (ডিজিডিএ)। এ অধিদপ্তরের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল ক্রয়সাধ্যমূল্যে নিরাপদ ও মানসম্পন্ন অত্যাবশ্যকীয় সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা এবং তৈরিকৃত ওষুধের উৎপাদনসহ আমদানিকৃত ও রপ্তানিযোগ্য গুণগত মান ও কার্যকরতা নিশ্চিত করা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে স্বকীয়তা হারিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। দাম নিয়ন্ত্রণ তো দূরে থাক, কোম্পানিগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে নিয়ন্ত্রক অসহায় হয়ে পড়েছে। কিছু অসাধু কর্মকর্তার কারণে নিয়ন্ত্রক হয়েও নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় রয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এমন পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানটিকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো সংস্কার করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
১৯৮২ সালের ওষুধ (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশের ১১ (১) ধারায় স্পষ্ট বলা রয়েছে, ‘সরকার অফিসিয়াল গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।’ আইনের এ ধারা অমান্য করে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে দাম বাড়িয়ে চলেছে অধিদপ্তর। একসময় ২০০ বেশি ওষুধের দাম নির্ধারণ করে দিত সরকার। এখন ঠিক করতে পারে মাত্র ১১৭টির। এ ক্ষেত্রে কিছু আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণের বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু তা-ও মানছে না, এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
দাম বাড়িয়ে প্রথম প্রজ্ঞাপনটি প্রকাশ করা হয়, ২০২১ সালের ২০ জুলাই। সেই প্রজ্ঞাপনে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বহুল ব্যবহৃত ২০টি জেনেরিকের ৫৩টি ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বাড়ানো হয়। এগুলোর মধ্যে বিভিন্ন মাত্রার প্যারাসিটামলের দাম বাড়ানো হয় ৫০ থেকে শতভাগ। ৪০ টাকার অ্যামোক্সাসিলিনের দাম বাড়িয়ে করা হয় ৭০ এবং ২৪ টাকার ইনজেকশন হয়ে যায় ৫৫ টাকা। ওই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ২৪টির দাম বাড়ায় অধিদপ্তর। শুধু তা-ই নয়, প্রজ্ঞাপন ডিসেম্বরে জারি করা হলেও মূল্য কার্যকর হয়, এরও আগে ওই বছরের ২০ নভেম্বর থেকে।
গেজেট প্রকাশ না করে এভাবে প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঘোষণা দিয়ে দাম বাড়ানোর এ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ বেআইনি বলে দাবি করেছে ভোক্তা-অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। ক্যাব জানায়, দেশে উৎপাদিত এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় ব্যবহৃত ১১৭টির দাম নির্ধারণ করে সরকার। আইন অনুসারে প্রতিটির উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই এ তালিকার ৬০টি ওষুধ উৎপাদন করতে হবে। কিন্তু বেশির ভাগ উৎপাদনকারীই এর মধ্যে অল্প কয়েকটি উৎপাদন করে। এই ১১৭টির বাইরে অন্যগুলোর মূল্য নির্ধারণ করে উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো, যা ১৯৮২ সালের ওষুধ (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশের ১১(১) ধারার লঙ্ঘন বলে মনে করে ক্যাব।
প্রশাসন অধিদপ্তরের ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় আইন লঙ্ঘন হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী বলেন, আইন অনুযায়ী দাম বাড়ানোর ক্ষমতা সরকারের। তবে দাম বাড়াতে হলে বাজার যাচাই, বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণ এবং গণশুনানি করতে হবে। প্রাণরক্ষাকারী অনেক ওষুধের দাম সরকার নির্ধারণ না করে, কোম্পানিগুলো নির্ধারণ করছে। কোম্পানিগুলো এ ক্ষেত্রে যদি এক টাকাও দাম বাড়ায়, আর সেটা যদি অধিদপ্তর মেনে নেয়, তা হবে বেআইনি। কোম্পানির প্রস্তাবিত দাম গ্রহণের এখতিয়ার ঔষধ প্রশাসনের নেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওষুধের দাম কোম্পানিগুলো ইচ্ছেমতো বাড়ালেও প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করে। সম্প্রতি দেশে ডেঙ্গু-করোনা-চিকুনগুনিয়ার মতো জ্বরের প্রকোপ বাড়লে কোম্পানিগুলো নিজেদের ইচ্ছেমতো এসব রোগে ব্যবহৃত ওষুধের দাম বাড়াচ্ছে। এ ক্ষেত্রেও প্রশাসনের ভূমিকা জনগণের বিপক্ষে অবস্থানের শামিল।
১৯৮২ সালের অধ্যাদেশে ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ছিল সরকারের। কিন্তু ১৯৯৪ সালে মাত্র ১১৭টির দাম সরকারের হাতে এবং বাকিগুলো কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হয়। তখন থেকেই এ খাতে নৈরাজ্য শুরু হয় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, কোম্পানিগুলো ১৯৯৪ সালে নেওয়া সিদ্ধান্তের সুবিধা নিচ্ছে। এটা পরিবর্তনে কেউ এগিয়ে আসে না। যেহেতু সব কাঁচামাল আমদানি করতে হয়, তাই ডলারের দামের সঙ্গে ওষুধের দাম বাড়ে।
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ওষুধের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের সক্ষমতায় ঘাটতি রয়েছে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের। তাদের নিয়ম কোনো কোম্পানি মানে না। এমনকি তারাও মানতে বাধ্য করতে পারে না। তাই মাঝেমধ্যে মাত্রাতিরিক্ত দাম বৃদ্ধির অভিযোগ ওঠে। এতে বিক্রেতারা লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ভোক্তা। এমনিতেই হতদরিদ্র, নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার বাইরে। এখন ওষুধের দাম মাত্রাতিরিক্ত বাড়ায় দেখা দেবে চিকিৎসাবৈষম্য। এ অবস্থা থেকে বের হতে সরকারকে একটি কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। যাতে ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের ন্যূনতম লাভ রাখতে পারে আবার জনগণেরও উপকার হয়।
ওষুধের দামের স্বেচ্ছাচারিতা রোধে গত বছরের এপ্রিলে একটি রুল জারি করেন হাইকোর্টও।
ওই সময় ওষুধ কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে ৩০ দিনের মধ্যে তা জানাতে প্রশাসন মহাপরিচালককে বলা হয়। সরকারের অনুমোদন ছাড়া ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলো যাতে কাঁচামাল আমদানি করতে না পারে, সে ব্যাপারেও বলা হয়েছিল। একই সঙ্গে অব্যাহতভাবে ওষুধের দাম বৃদ্ধি রোধে কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চেয়ে রুলও জারি করা হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। দিনের পর দিন কোম্পানিগুলো ওষুধের দাম বাড়ানো নিয়ে নিজেদের স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়েই যাচ্ছে।
তবে সরকার এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে কাজ করছে বলে জানান, মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. শামীম হায়দার। তিনি বলেন, ‘দেশীয় ব্যবস্থাপনায় ওষুধের কাঁচামাল তৈরি ও উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে কাজ করছে ডিজিডিএ। একই সঙ্গে এ খাত উন্নয়নে নীতি সহায়তার জন্য কমিটিও গঠন করা হচ্ছে। দেশে ওষুধের কাঁচামাল শিল্পের বিকাশ হোক, এটা আমাদেরও চাওয়া। এ সেক্টরের বিকাশে আমাদের আন্তরিকতার ঘাটতি নেই। কাঁচামালের উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলে এক সঙ্গে কাজ করব। তবে বাজার তদারকির জন্য যে জনবলের প্রয়োজন, তার ঘাটতি আমাদের রয়েছে এটি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পেলে, আমরা অবশ্যই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেব।’