জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রথম ভাষণে শিক্ষা খাতে পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের আশ্বাস দিয়েছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছিলেন, ‘শিক্ষার ক্ষেত্রে চরম নৈরাজ্য প্রতিষ্ঠা করে গেছে বিগত সরকার। আমরা তার পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের উদ্যোগ নেব। এটা আমাদের অন্যতম অগ্রাধিকার।’ কিন্তু সরকার গঠনের এক বছর পার হলেও শিক্ষা খাতে সংস্কারের কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়নি।
সংবিধান, নির্বাচন-ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন ও স্বাস্থ্য খাতসহ ১০টি খাতের সংস্কার কমিশন গঠন করা হলেও শিক্ষা খাতে সংস্কারের জন্য কোনো সংস্কার কমিশন গঠন হয়নি। সাবেক শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ জানিয়েছিলেন, শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠনের কোনো চিন্তা-ভাবনা অন্তর্বর্তী সরকারের নেই। তবে প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা সংস্কারে একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করা হলেও মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা নিয়ে নেই কোনো চিন্তা।
বিগত এক বছরে শিক্ষা খাতে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সামান্য পরিমাণ বাজেট বৃদ্ধি এবং আওয়ামী লীগ সরকারের ২০২১ সালের প্রণয়ন করা জাতীয় শিক্ষানীতি বাতিল, পাঠ্যবইয়ে কিছু বিষয় পরির্বতন আর দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ ছাড়া গত এক বছরে তেমন কিছু পরিবর্তন হয়নি। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ শিক্ষাবিদ ও সাধারণ মানুষ। তারা বলছেন, বর্তমানে দেশের যে কারিকুলাম চলছে, তা গতানুগতিক। এই শিক্ষা কর্মবান্ধব শিক্ষা নয়। শিক্ষা খাতকে যুগোপযোগী করতে সবার আগে শিক্ষা সংস্কার কমিশন করা দরকার ছিল। কিন্তু সরকার সেদিকে নজর দেয়নি।
শিক্ষা নিয়ে কাজ করা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন শিক্ষক ও গবেষক বলেন, গত এক বছরে শিক্ষা নিয়ে তেমন কোনো কাজ হয়নি, কোনো সংস্কারও হয়নি। সংস্কার হওয়ার মধ্যে যা হয়েছে তা হলো, আগে আওয়ামী লীগের লোকজন বিভিন্ন পদজুড়ে বসে ছিল; এখন বিএনপি-জামায়াতের লোকজন বসেছে। তবে কিছু কিছু জায়গায় এখনো আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগীরা রয়ে গেছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ছাত্রদের তোপের মুখে পদত্যাগ করে পালান আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়োগ দেওয়া সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, রেজিস্টারসহ পদধারী। সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এসব পদ পূরণ করাই সরকারের ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। যদিও এসব পদ দ্রুত পূরণ করা হয়েছে, তবে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ অনেকের। এ ছাড়া বিগত দিনের মতো এবারও বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের বই দেওয়া ছিল সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। তা পূরণ করতেও হোঁচট খেয়েছে সরকার।
জানুয়ারির ১ তারিখের বদলে শিক্ষার্থীরা এপ্রিল-মে মাসে সব বই হাতে পেয়েছে। বইয়ের মান নিয়েও প্রশ্ন অনেক। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেই টেন্ডার বাদ দিয়ে দেশের কিছু ঠিকাদার সিন্ডিকেট করে বেশি দর দিয়ে বই ছাপার কাজ নেয়। কিন্তু তারা সময়মতো বই ছাপাতে পারেনি। আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বশেষ কারিকুলাম বাতিল করলেও নতুন কোনো কারিকুলাম চালু করতে পারেনি সরকার। ফিরে যাওয়া হয়েছে ২০১০ সালের সৃজনশীল কারিকুলামে।
দেশের কয়েকশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণের কাজ বন্ধ রয়েছে উল্লেখ করে তারা আরও বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অসংখ্য ঠিকাদার দেশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের অবকাঠামো নির্মাণের কাজে পেয়েছিল। ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপরই সেসব ঠিকাদার পালিয়ে গেছেন, খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেকের নামে মামলাও হয়েছে; তারাও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ফলে এসব অবকাঠামো নির্মাণের কাজও শুরু হচ্ছে না।
তবে প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা সংস্কারের জন্য শিক্ষাবিদ ড. মনজুর আহমদকে আহ্বায়ক করে একটি পরামর্শক কমিটি গঠন করে সরকার। সেই কমিটি দেশের বিভিন্ন অংশীগোষ্ঠীর সঙ্গে মতবিনিময় এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ দেশের ১১টি জেলার ১২টি উপজেলা পরিদর্শন করে একটি সুপারিশমালা পেশ করেছে। এই সুপারিশের আলোকে মিড ডে মিল, শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোসহ বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. আবদুস সালাম বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান অনেকগুলো স্বপ্নের বীজ বপন করেছিল। তার মধ্যে অন্যতম একটি ছিল শিক্ষার মানোন্নয়ন করা। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সেই শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা আশা রেখেছিলাম নতুন একটা শিক্ষানীতি প্রণয়ন হবে, কিন্তু তারা সেখানে এখন পর্যন্ত হাত দেয়নি।
শিক্ষার বাজেট নিয়ে তিনি বলেন, সর্বশেষ যে বাজেট হয়েছিল, সেখানে শিক্ষার বাজেট বাড়ানো হয়নি। এত স্বল্প বাজেট দিয়ে শিক্ষার মান কখনো বাড়ানো সম্ভব নয়। এমনকি শিক্ষকদের মর্যাদার বিষয়ে অনেক দিন থেকে আমরা লড়াই করছি। শিক্ষকদের পরিপূর্ণ মর্যাদা ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়ন কল্পনা করা যায় না।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, রাজনৈতিক পট পরিবর্তন আর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ ছাড়া কোনো পরিবের্তন হয়নি। শিক্ষা নিয়ে যেটা জরুরি ছিল, সেই শিক্ষা কমিশনও গঠিত হয়নি। এ নিয়ে সরকারের কোনো উদ্যোগ ছিল না বলেই মনে হয়েছে। তিনি বলেন, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বড় বড় পদে যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে; তাদেরও আগে যে রকম দলীয় ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হতো, সেরকম দলীয় ভিত্তিতেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষা আগেও কোনো গুরুত্ব পায়নি, এখনো গুরুত্ব পায়নি। বরং এখন আরও বেশি বাণিজ্যিক করণ হয়েছে এবং প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলোর আধিপত্য বেড়েছে। প্রতিটি সরকার এটাই মোটামুটি ধরে নেয় যে, প্রাইভেট এডুকেশন ভালো। শিক্ষা তো প্রাইভেট বা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হয় না। শিক্ষার মান বাড়াতে রাষ্ট্রকেই মূল দায়িত্ব নিতে হয়। সেটা এই সরকারের মধ্যে আজ পর্যন্ত দেখিনি। এখন সামনে কোন সরকার আসবে, তারা কী করবে, সেটা দেখার বিষয়। এ সময় তিনি শিক্ষা নিয়ে দ্রুত শিক্ষা কমিশন গঠন করে এর মানোন্নয়নে কাজ করতে হবে বলে জানান।
আপনার মতামত লিখুন :