ঢাকা শুক্রবার, ০৮ আগস্ট, ২০২৫

‘ভঙ্গুর’ অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে

রহিম শেখ
প্রকাশিত: আগস্ট ৮, ২০২৫, ০২:১৬ এএম

গত বছরের আজকের এই দিনে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ধসে পড়ে আওয়ামী লীগ সরকার। তবে কোনোভাবে দাঁড়িয়েছিল দেশের ‘অর্থনীতি’।

হাসিনা সরকারের আমলে বড় বড় দুর্নীতি হয় আর্থিক খাতে। ব্যাংক খাতের ক্ষত ছড়িয়ে পড়ে পুরো অর্থনীতিতে। প্রবল সংকট এক পরিস্থিতির মধ্যে দায়িত্ব নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার। দায়িত্ব গ্রহণের পর গত এক বছরে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

আর্থিক খাত ‘ভঙ্গুর’ অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অস্থির ডলার বাজারে ফিরেছে কিছুটা স্বস্তি। প্রবাসীর পাঠানো রেমিট্যান্সে এসেছে গতি। রপ্তানিও এখন ইতিবাচক ধারায়। অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে অগ্রগতি হলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে কাক্সিক্ষত স্বস্তি আসেনি। কারণ, মূল্যস্ফীতির চাপ পুরোপুরি সামাল দেওয়া যায়নি। মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও এখনো চাপে আছে সাধারণ মানুষ। সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগও অনেকটা স্থবির। ফলে কর্মসংস্থান আশানুরূপ বাড়েনি। এমন অবস্থায় অর্থনীতিতে কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে। এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে মূল্যস্ফীতি কমানোর পাশাপাশি রাজস্ব, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানো এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তা দূর করা।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার টানা ১৫ বছরের বেশি ক্ষমতায় থেকেও সংকটে পড়া অর্থনীতিকে টেনে তুলতে পারেনি। শেষ সময়ে এসে অর্থনীতি প্রায় গভীর খাদে পড়ে যাচ্ছিল। তবে অর্থনীতি খারাপ হতে শুরু করেছিল মূলত ২০১৯ সাল থেকে। মাঝখানে দেখা দেয় কোভিড-২০ মহামারি। এরপর ২০২২ সালের শুরুতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বৈশ্বিক অর্থনীতি বিপদে পড়ে যায়, যার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও। তবে দেশে সংকট বেশি প্রকট হয়েছে আগের সরকারের একের পর এক ভুল ও খামখেয়ালি নীতির কারণে। অর্থনীতির প্রায় সব সূচকই তখন নি¤œমুখী ছিল। এরমধ্যে অন্যতম ছিল রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের অন্যতম অবিস্মরণীয় অধ্যায় ছিল প্রবাসীদের ‘রেমিট্যান্স শাটডাউন’। হাসিনার পতনের দুই সপ্তাহ আগে থেকে বিভিন্ন দেশে থাকা বাংলাদেশি শ্রমজীবী প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করে দেন। এতে সরকারের ওপর চাপ বাড়তে থাকে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। আজকের এই দিনে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর হাসিনার টানা তিন মেয়াদের যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করে, তাতে দুর্নীতি ও টাকা পাচারের ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে। শে^তপত্র কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। বর্তমান বাজার দরে (প্রতি ডলার দাম ১২০ টাকা) এর পরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা। এই হিসাবে প্রতি বছর গড়ে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এই অর্থ ফেরাতে নানামুখী তৎপরতা শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।

গত বুধবার অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, খাদের কিনার থেকে গত এক বছরে দেশের অর্থনীতি অনেকটা উঠে এসেছে। তার মতে, মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থান, জ্বালানি, শুল্কসহ সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ব্যবসায়ীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং স্লো হয়ে যাওয়া ব্যবসা-বাণিজ্যে একটু গতি সঞ্চার করা।

বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি, বিনিয়োগে স্থবিরতা এবং রাজস্ব আদায়ে নাজুক পরিস্থিতি বিদ্যমান। রিজার্ভের পরিমাণ দেখে মনে হচ্ছে, এটি ভালো আছে। কিন্তু আমদানি খরচ কম হওয়া এবং বিদেশি ঋণের প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় রিজার্ভ বেড়েছে। তাই রিজার্ভ পরিস্থিতি ভালো, এটা বলা যাবে না। সেলিম রায়হানের মতে, অর্থনীতি এখনো চাপের মধ্যে আছে। 
 
রিজার্ভে থেমেছে পতন
রেমিট্যান্স আয়ের দিক থেকে চলতি অর্থবছর ভালোভাবে শুরু হলো। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৯ শতাংশ। গত জুলাই মাসে প্রবাসীরা ২৪৭ কোটি ডলার বা ২ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার আয় দেশে পাঠিয়েছেন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে। দেশের ইতিহাসে এর আগে কোনো অর্থবছরে এত প্রবাসী আয় আসেনি। এই আয় আগের অর্থবছরের ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে ৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার বা ২৬ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছিল ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার। প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় ডলারের বাজার স্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণ ছাড়ের ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ ২৯ দশমিক বিলিয়ন ডলার দাঁড়িয়েছে। আইএমএফের হিসাবপদ্ধতি বিপিএম ৬ মান অনুযায়ী, রিজার্ভ অবশ্য ২৫ দশমিক ০৫ বিলিয়ন ডলার।
 
রাজস্ব ঘাটতির চাপে বাড়ছে দুশ্চিন্তা
গণঅভ্যুত্থানের পর ২০২৪ সালের আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের ফলে অর্থনৈতিক কর্মকা-ে নতুন করে গতি আসায় বছরের শুরুর দিকে রাজস্ব প্রবৃদ্ধিতে পুনরুদ্ধারের লক্ষণ দেখা যায়। এপ্রিলে প্রবৃদ্ধি হয় ১৪ শতাংশের ওপরে। তবে গত জুনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা আন্দোলনে নামার পর রাজস্ব আদায় কার্যক্রম একরকম বন্ধ হয়ে যায়। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুনে রাজস্ব আদায় কম হয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের একই মাসের তুলনায় প্রায় ১৯ শতাংশ কম। সব মিলিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় ৩.৭১ লাখ কোটি টাকা, যা এর আগের অর্থবছরে ছিল প্রায় ৩.৬৩ লাখ কোটি টাকা। 
 
বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধিতে পতন
বিনিয়োগ খরার মধ্যে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে সর্বনি¤œ পর্যায়ে এসেছে। গত জুন শেষে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে গত ২২ বছরের যে তথ্য রয়েছে, এ প্রবৃদ্ধি তার মধ্যে সর্বনি¤œ। এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে একবার প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৮২ শতাংশে নেমেছিল। এর আগে করোনা অতিমারির মধ্যেও বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৭ শতাংশের ওপরে ছিল। মূলত গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে প্রতি মাসেই ঋণ প্রবৃদ্ধি কমতে কমতে এ পর্যায়ে নেমেছে। গত বছরের জুলাইয়ে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ। 
 
বিনিয়োগে মন্থর গতি 
রাজনৈতিক অস্থিরতা, গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটসহ বিভিন্ন কারণে দীর্ঘদিন ধরেই প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগে (এফডিআই) মন্দাভাব চলছিল। গত বছরের শেষ ছয় মাসে তা ৭১ শতাংশ কমে যায়। তবে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) এফডিআই আসার হার বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে দেশে মোট ১৫৮ কোটি ডলারের এফডিআই এসেছে। এর মধ্যে ৭১ কোটি ডলার ফেরত নিয়ে গেছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। সেই হিসাবে, গত জানুয়ারি-মার্চ সময়ে নিট এফডিআই এসেছে ৮৬ কোটি ডলার। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় যা ১১৪ শতাংশ বেশি। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে আসা নিট এফডিআই ২০২২ সালের পর সর্বোচ্চ। ওই বছরের জানুয়ারি-মার্চে নিট এফডিআই এসেছিল ৮৯ কোটি ডলার। পরের বছরের একই সময়ে সেটি কমে ৬৩ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। 

ঋণের চাপে সরকার, কমছে বিদেশি সহায়তা 
দেশের ইতিহাসে প্রথমবার এক বছরে ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করেছে সরকার। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এ ঋণ শোধ করা হয়। আসল ও সুদ মিলিয়ে মোট পরিশোধ করা হয়েছে ৪০৮ কোটি ৬৯ লাখ ডলার। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ২১ শতাংশ বেশি। পরিশোধ করা অর্থের মধ্যে আসল পরিশোধ হয়েছে ২৫৯ কোটি ৫১ লাখ ডলার এবং ১৪৯ কোটি ১৮ লাখ ডলার ব্যয় হয়েছে সুদ পরিশোধে। এদিকে, গত অর্থবছরে মোট ৮ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ, যা চার বছরের মধ্যে সর্বনি¤œ। আর ঋণ প্রতিশ্রুতি ছিল ৮ দশমিক তিন দুই বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ২২ শতাংশ কম। এদিকে গত অর্থবছরে ৮৩২ কোটি ডলারের প্রতিশ্রুতির বিপরীতে ছাড় হয় ৮৫৭ কোটি ডলার। 

উন্নয়ন প্রকল্পে স্থবিরতা
গত ২০ বছরের মধ্যে বিদায়ী অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) সর্বনি¤œ বাস্তবায়ন হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মাত্র ৬৮ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন হয়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) ওয়েবসাইটে ২০০৪-২৫ অর্থবছর থেকে গত ২০ বছরের এডিপি বাস্তবায়নের তথ্য দেওয়া আছে। ওই সময়ের মধ্যে সবচেয়ে কম এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে বিদায়ী অর্থবছরে। বিদায়ী অর্থবছরে সংশোধিত এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ২৬ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা। বছর শেষে খরচ হয় মাত্র ১ লাখ ৫২ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। বাস্তবায়ন হার ৬৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ। 

পাচারের টাকা ফেরাতে তৎপরতা বেড়েছে
দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এরই মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। পাচারকৃত সম্পদ দেশে ফেরত আনা ও ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্স পুনর্গঠন করে কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। এই টাস্কফোর্সের অধীনে শেখ হাসিনার পরিবারসহ শীর্ষ ১০টি শিল্পগোষ্ঠীর অবৈধ অর্থ অর্জন, কর ফাঁকি ও অর্থ পাচার খতিয়ে দেখতে যৌথ তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। এ ছাড়া পাচারের ঘটনা তদন্ত করতে বিশ্বের বড় তিনটি অডিট ফার্মকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।