আমাদের দেশে অপরাধীদের বেপরোয়া এবং নৃশংস আচরণের পেছনে রাজনীতি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও সমাজ ব্যবস্থা দায়ী। গণঅভ্যুত্থানের পরে রাষ্ট্র ও সমাজ যে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে চায় এবং আইনের শাসনের পথে হাঁটতে চায় সেই ব্যবস্থাগুলো আমরা দেখছি না। ফলে অপরাধ বেড়েই চলছে। বিচার নিশ্চিত না করা গেলে এ রকম হবে।
এর সঙ্গে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা, আছে রাজনৈতিক প্রশ্রয়। সবমিলিয়ে পরিস্থিতি এমন হচ্ছে। এখন প্রতিবাদ করলে মানুষ নিগ্রহের শিকার হয়, তার নিরাপত্তা নাই। এই কারণে কোনো মানুষ স্বেচ্ছায় মামলার সাক্ষীও হতে চায় না। একটা ভয়ের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে, যা অপরাধীদের উৎসাহিত করছে। তারা আরও নৃশংস হচ্ছে। এর ফলে সমাজে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হচ্ছে। মানুষ মনে করছে নিজেকে গুটিয়ে রাখলে, প্রতিবাদ না করলে, অন্যের বিপদ দেখলে, নিজে ঘরে ঢুকে গেলে সে নিরাপদ থাকবে। কিন্তু বাস্তবে সে এতে আরও অনিরাপদ হয়ে পড়বে।
তবে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলে অপরাধ অনেক কমে আসবে। এরমধ্যে অন্যমত বিষয় হচ্ছে- আইনের কঠোর প্রয়োগ। এর মাধ্যমে অপরাধীদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এর পরে রয়েছে সামাজিক সচেতনতা। এটি অত্যন্ত জরুরি। এ ছাড়া মানুষকে আইনি প্রক্রিয়ার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে উৎসাহিত করতে হবে। পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করতে হবে। এ ছাড়া মাদক ও অন্যান্য সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধেও একইসঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে। মাদক ও অন্যান্য সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারলে অপরাধ অনেক কমে যাবে। এদিকে গণপিটুনি বেড়েছে। গণপিটুনির মতো ঘটনা বন্ধ করতে হবে এবং আইনের মাধ্যমে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। সর্বশেষ হলো, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও দক্ষ ও কার্যকর করে তুলতে হবে, যাতে তারা অপরাধ দমনে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এই বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দিলে সহিংসতা ও অপরাধের প্রবণতা কমানো অনেকটা সম্ভব।
গত ৫ আগস্টের পর আইনশৃঙ্খলার উন্নতির যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা পর্যাপ্ত নয়। ৫ আগস্টের আগে-পরে যেসব পুলিশ হত্যার শিকার হয়েছেন সেটার বিচারিক প্রক্রিয়াও দেখা যাচ্ছে না। এতে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে শীর্ষ কর্মকর্তাদের ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা মনে করছেন, অপরাধে জড়িয়েছেন শীর্ষ কর্মকর্তারা কিন্তু জনরোষের শিকার হচ্ছেন মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্যতম শর্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা। এটি করতে না পারলে নির্বাচনের শিষ্টাচার নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে জোরালোভাবে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর যে ঘাটতি তৈরি হয় সেটা মোকাবিলা করতে কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা ও জবাবদিহি জরুরি। আইন প্রয়োগে ঘাটতি থাকলে জবাবদিহি ও দায়িত্বশীলতা তৈরি হয় না। এজন্য পুলিশ আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে সংকটের মধ্যে পড়ছেন। তবে পুলিশের মনোবল বৃদ্ধির বিষয়গুলোও নিয়ে খুব একটা কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।
লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন