শুক্রবার, ১৫ আগস্ট, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: আগস্ট ১১, ২০২৫, ০৬:১৮ এএম

নতুন রূপে আরও ভয়ংকর হয়ে ফিরেছে চিকুনগুনিয়া

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: আগস্ট ১১, ২০২৫, ০৬:১৮ এএম

নতুন রূপে আরও ভয়ংকর হয়ে ফিরেছে চিকুনগুনিয়া

বেসরকারি কর্মকর্তা সুপ্রতীপ সরকার। গত মঙ্গলবার অফিস চলাকালীন সময়েই হঠাৎ তীব্র জ্বর অনুভব করেন। যেনতেন জ্বর নয়, দেখতে দেখতে থার্মোমিটারের পারদ ছোঁয় ১০৪-এর ঘরে। সহকর্মীদের সহায়তায় বাড়ি ফেরেন শরীরে তীব্র ব্যথা নিয়ে।

এক পরিচিত চিকিৎসকের সঙ্গে ফোনে কথা বললে চিকুনগুনিয়া পরীক্ষা করানোর কথা বলেন। ওই চিকিৎসক ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পরীক্ষা করানোর কথা বললেও বাসা থেকে অনেক দূর হওয়ায় কাছের শহিদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে যান সুপ্রতীপ। কিন্তু সেখানে ডেঙ্গু পরীক্ষা হয়। চিকুনগুনিয়া পরীক্ষার সুযোগ নেই। পার্শ্বর্তী কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে গিয়েও পরীক্ষা করাতে ব্যর্থ হয়ে সেদিনের মতো বাড়ি ফেরেন তিনি। এই সময়টা শুধু প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খেলেও শরীরে তীব্র ব্যথায় কাতর হয়ে পড়েন তিনি।

একই রকম চিকুনগুনিয়ার তীব্র ব্যথায় হার্টে সমস্যা দেখা দেয় ব্যবসায়ী সলিমুল্লাহ খানের। শরীরের ব্যথা এত তীব্র ছিল যে বুঝতেই পারেননি বুকের ব্যথাও। ফলাফল হার্ট অ্যাটাক। পরিবারের লোকজন নিয়ে আসেন রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সলিমুল্লাহ খানের ছেলে ই¯্রাফিল জানান, কয়েক দিন থেকেই বাবার শরীরে জ¦র। পাশাপাশি শরীরে প্রচ- ব্যথা ছিল। এ কারণেই হয়তো বুকের ব্যথা বুঝতে পারেননি। চিকিৎসকরা বলছেন, বড় বিপদ থেকে বাঁচা গেছে দ্রুত হাসপাতালে আনতে পারায়। 

শুধু সুপ্রতীপ সরকার বা সলিমুল্লাহ খান ননÑ চলতি মৌসুমে ডেঙ্গু জ্বরের পাশাপাশি চিকুনগুনিয়ায় ভুগছেন অসংখ্য মানুষ। কিন্তু ডেঙ্গু বা করোনার মতো এর হিসাব রাখার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে কোনো কন্ট্রোলরুম নেই, ফলে চলতি বছর এ রোগে ঠিক কতজন আক্রান্ত হয়েছেন তার হিসাব পাওয়া যায় না। 

সম্প্রতি রাজধানীসহ দেশের প্রায় প্রতিটি ঘরেই জ্বরে ভুগছে মানুষজন। এদের কেউ কেউ ডেঙ্গু, কেউ চিকুনগুনিয়া, আবার কেউ বা ভুগছেন করোনায়। কারো কারো একসঙ্গে ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়া হওয়ারও খবর পাওয়া যাচ্ছে। অন্যান্য বছরের মতো শুধু শরীরে ব্যথাতেই থামছে না চিকুনগুনিয়ার প্রভাব। চলতি বছর ডেঙ্গুর মতোই চিকুনগুনিয়াতেও রোগীর শকে চলে যাওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। কাউকে কাউকে বরণ করতে হচ্ছে পঙ্গুত্বও। হার্ট-ফুসফুসেও প্রভাব পড়ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এমন পরিস্থিতিতে ডেঙ্গুর মতোই চিকুনগুনিয়ার রোগীকেও পরিসংখ্যানের আওতায় নিয়ে এসে পরীক্ষা এবং সঠিক চিকিৎসা সহজলভ্য করার পরামর্শ তাদের।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ডেঙ্গুর মতোই মশাবাহিত এই রোগও সম্প্রতি প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে। এডিস মশাবাহিত এই  রোগে জ্বর-পরবর্তী সময়ে গিঁটের ব্যথায় ভুগতে হয় রোগীদের। ২০০৫ সালে বিশ্বের নানা দেশে আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছিল ডেঙ্গুর তুলনায় উপেক্ষিত চিকুনগুনিয়া। কিন্তু এর চিকিৎসায় কমতি থেকে গেছে বিস্তর। আর তাই আবারও মাথাচাড়া দিয়েছে চিকুনগুনিয়ার ভাইরাস। মাঝে কমলেও এখন আবার নতুন রূপে আরও ভয়ংকর হয়ে ফিরে এসেছে বলে সতর্ক করেছে সংস্থাটিও। 

আফ্রিকায় এই ভাইরাসের খোঁজ প্রথম মিলেছিল। চিকুনগুনিয়ার ভাইরাসের বাহক হলো স্ত্রী এডিস ইজিপ্টাই ও এডিস অ্যালবোপিক্টাস মশা। মশার লালাবাহিত হয়ে এ ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। অনেকে বলেন, অস্থিসন্ধির জ্বর। চিকুনগুনিয়াতে রোগী সারা শরীরে অস্বস্তি অনুভব করেন। গায়ে ও মুখে লাল র‌্যাশ হয়। ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ার ভাইরাস দমনে কোনো ওষুধ তো নেই, টিকাও নেই। মূলত উপসর্গের মোকাবিলা করাটাই চিকিৎসা। কিন্তু এ রোগে জ্বরের দেড়-দুই বছর পরেও চলতে পারে ব্যথার প্রকোপ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, বর্তমানে ১১৯ দেশের প্রায় ৫৬০ কোটি মানুষ এ ভাইরাসের বিপদে রয়েছে। তাই মশাবাহিত যেকোনো রোগ থেকেই সতর্ক থাকা খুব জরুরি। দরকার শুধু রোগের সঠিক শনাক্তকরণ এবং ঠিক রোগের ঠিক চিকিৎসা। ভারত মহাসাগর অঞ্চলের সাথে যুক্ত ইউরোপ এবং অন্যান্য মহাদেশে এই রোগের নতুন প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে, দুই দশক আগে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া মশাবাহিত চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের মহামারির পুনরাবৃত্তি রোধে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। 

সম্প্রতি জেনেভায় সাংবাদিকদের ডব্লিউএইচওর মেডিকেল অফিসার ডায়ানা রোজাস আলভারেজ বলেন, আমরা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দেখতে পাচ্ছি। ২০০৪-২০০৫ সালের মহামারির সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে এবারও, তখন বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার আগে মূলত ছোট দ্বীপ অঞ্চলগুলোতে ৫ লাখের মতো মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন।  এবারের প্রকোপ শুরু হয়েছে ২০২৫ সালের শুরুর দিকে। লা রিইউনিয়ন, মায়োট এবং মরিশাসসহ এর আগেও আক্রান্ত ভারত মহাসাগরের দ্বীপগুলোতেই এবারও প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। 

রোজাস আলভারেজ বলেন, লা রিইউনিয়নের জনসংখ্যার আনুমানিক এক-তৃতীয়াংশ ইতিমধ্যেই সংক্রমিত হয়েছে। ভাইরাসটি এখন মাদাগাস্কার, সোমালিয়া এবং কেনিয়ার মতো দেশগুলো এবং ভারতসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়ও মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ছে ভাইরাসটি। এখনই ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০১৭ সালের পর ঢাকায় আবারও দেশে চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের আবির্ভাব একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয়। পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না নিতে পারলে এটি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চরম চাপ সৃষ্টি করতে পারে।  সংক্রামক রোগ বিষয়ক গবেষণার জন্য পরিচিত ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ইনফেকশাস ডিজিজেস রিজিয়নস’ (আইজেআইডি রিজিয়নস) জার্নালে ‘দ্য রি-অ্যাপিয়ারেন্স অব চিকুনগুনিয়া ইন বাংলাদেশ ২০২৪’ শিরোনামে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, চিকুনগুনিয়ার বাহক এডিস মশার বংশবৃদ্ধির জন্য অনুকূল পরিবেশ থাকায় রাজধানীসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে এর ভয়াবহ প্রভাব পড়তে পারে। যার বাস্তবতা বর্তমানে দেখছে দেশ। শুধু রাজধানী নয়, রাজধানীর বাইরেও রোগটিতে কষ্ট পাচ্ছেন রোগীরা। রংপুর থেকে চঞ্চল ভৌমিক নামের এক রোগী মোবাইলে বলেন, প্রথমে ভেবেছিলাম ডেঙ্গুর মৌসুম, তাই ডেঙ্গু পরীক্ষা করাই। কিন্তু ডেঙ্গু নেগেটিভ আসে। চিকিৎসক চিকুনগুনিয়া পরীক্ষা করাতে বলেন। কিন্তু কোথায় গেলে পরীক্ষা করাতে পারব সেটা খোঁজ নিতে নিতে আরও তিন দিন চলে যায়। এর মধ্যে শরীরের তীব্র ব্যথায় কাবু হয়ে শুয়ে আছি। 

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর), যুক্তরাজ্যের কিল বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গত বছরের এক গবেষণায় দেখা গেছে, চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ রয়েছে এমন ৩৯৪ জন রোগীর নমুনা পরীক্ষা করে ১৩৮ জনের (৩৫ শতাংশ) চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়। শনাক্ত হওয়া রোগীদের মধ্যে ১৩৬ জনই ঢাকা শহরের বাসিন্দা। তাদের মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৭২ জন এবং উত্তর সিটি করপোরেশনের ৬৪ জন। বাকি দুজন রোগীর মধ্যে একজন নারায়ণগঞ্জের ও অন্যজন কেরানীগঞ্জের। রোগীদের ৬৫ শতাংশ পুরুষ ও ৩৫ শতাংশ নারী। ৮৩ শতাংশের বয়স ৩০ বছরের বেশি।

গবেষণাদলের সদস্য ও আইইডিসিআরের ইপিডেমিওলজি বিভাগের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. আব্দুল্লাহ ওমর নাসিফ বলেন, এ বছরও এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ থেকেই আমরা নিয়মিত চিকুনগুনিয়া পজিটিভ রোগী পাচ্ছি। সামনের কয়েকটি মাস, যে সময়কে আমরা ডেঙ্গু মৌসুম বলি, সে সময়ে সাধারণত এডিস মশার ব্যাপক বংশবৃদ্ধি ও বিস্তার ঘটে। সুতরাং এখন থেকেই সতর্ক না হলে ঢাকা শহরে ২০১৭ সালের মতো অনেক বড় আকারে প্রাদুর্ভাব হতে পারে।
চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের ওপর গবেষণায় দেখা যায়, ৯৬ শতাংশের অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, ২৯ দশমিক ৪ শতাংশের ক্লান্তি, ১৯ শতাংশের অস্থিসন্ধি ফুলে যাওয়া ছিল। এ ছাড়া জ্বর, পেশিতে ব্যথা ও মাথা ব্যথা থাকে।

ফলোআপ রোগীদের ৮১ শতাংশের ২৮ দিন পরও দীর্ঘস্থায়ী উপসর্গ ছিল। রোগীরা চিকুনগুনিয়া সংক্রমণের কারণে গড়ে ১০ দশমিক ৫ কর্মদিবস হারিয়েছে। বাংলাদেশের মাথাপিছু দৈনিক আয় ৬ দশমিক ৯৮ মার্কিন ডলার ধরে প্রত্যেকে গড়ে ৭৩ দশমিক ৩ ডলার আয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

সরকারের এখনই চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের নিয়মিত পরিসংখ্যানের আওতায় আনার তাগিদ দিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ডেঙ্গুর মতোই এখনকার চিকুনগুনিয়া রোগীদেরও শকে চলে যাওয়ার মতো কেস আমরা পাচ্ছি। অনেকের আবার বিকলাঙ্গ থেকে শুরু করে হার্টেও সমস্যা হচ্ছে। তাই এটিকে আর অবহেলা করার সুযোগ নেই। প্রাণঘাতী না হলেও এটি একজন রোগীকে শারীরিকভাবে অক্ষম করে দিতে সক্ষম। 

এ ব্যাপারে কীটতত্ত্ববিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, চিকুনগুনিয়ার বাহক এডিস এলবোপিকটাস ও এডিস ইজিপটাই মশা। এ মশা আগে থেকেই ছিল, এখন সারা দেশে ছড়িয়েছে। যেহেতু চিকুনগুনিয়ায় মৃত্যুহার কম, তাই সরকার পরীক্ষা বন্ধ করে দেয়। তাই শনাক্ত রোগীর সংখ্যা জানা যাচ্ছে না।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!