মৃত্যুর হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন মব সহিংসতার শিকার রংপুরে রূপলাল ও প্রদীপ দাস। দুই হাতজোড় করে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘আমি চোর না, ডাকাতও না।’ তবুও শেষরক্ষা হয়নি তাদের। সেই মর্মস্পর্শী আকুতির ভিডিও এখন ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, যা দেখে অনেকেই শিউরে উঠছেন। শুধু রূপলাল ও প্রদীপ লালই নয়, প্রতিনিয়তই কোথাও না কোথাও মব সহিংসতায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। এতে নিহত হচ্ছে দুষ্কৃতকারী ছাড়াও নিরপরাধ মানুষ। মব সহিংসতার শিকার হচ্ছে পুলিশ, শিক্ষক থেকে শুরু করে চোর-ডাকাত-ছিনতাইকারী ছাড়াও সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। বাদ যাচ্ছেন না বিদেশিরাও। বাসা-বাড়িতে লোকজন ঢুকে সবকিছু তছনছ করছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব সন্ত্রাসী নিজেদের পরিচয় দিচ্ছে ‘তৌহিদি জনতা’। ফলে জনমনে বাড়ছে উদ্বেগ। সাম্প্রতি ভয়েস ফর রিফর্ম ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, দেশে মব সহিংসতার ঘটনা নিয়ে ৮০ শতাংশ মানুষ উদ্বিগ্ন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা ও ঢিলেঢালা মনোভাবের সুযোগে একদল জনতা মব তৈরি করছে, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয় বাড়াচ্ছে। এ ছাড়া মবের সুযোগ নিয়ে নানা অভিযোগ তুলে অন্যায় স্বার্থ হাসিল করছে বিভিন্ন গোষ্ঠী। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস ও চাকরিচ্যুতিতেও মবের সুযোগ নিচ্ছে অসাধু চক্র। অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরেও নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি মব সহিংসতা। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, আইন অবজ্ঞা করে মব সহিংসতা তৈরি করে সমাজে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করা এবং ভয়াবহ পরিবেশ তৈরিতে জড়িত অপরাধীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এ ধরনের ঘটনা প্রচলিত আইন, সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদ-ের দৃষ্টিতে অত্যন্ত বিপজ্জনক ও অগ্রহণযোগ্য।
জানা গেছে, গত একবছরে মব সহিংসতার নামে গণপিটুনিতে নিহতের সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় তিন-চার গুণ বেড়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক বছরে দেশে অন্তত ২০৮ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) গত জুন ও জুলাই মাসের এক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত দুই মাসে ৯২টি মব সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ২৬ জন। এ ছাড়া আহত হয়েছেন অন্তত ১০০ জন। এরমধ্যে জুনে ৪১টি মব সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ১০ জন ও আহত হয়েছেন ৪৭ জন। এ ছাড়া জুলাইতে ৫১টি মব সহিংসতার ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৬ জন ও আহত হয়েছেন ৫৩ জন। গত জুনের চেয়ে জুলাইতে মব সহিংসতার ঘটনা বেশি এবং আহত-নিহতও বেশি।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরে ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর গণপিটুনিতে হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে।
২০২৩ সালের আগস্ট থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত ছয় মাসে গণপিটুনিতে নিহতের সংখ্যা ২৯। ২০২৪ সালের দেশের পট পরিবর্তনের মাস আগস্ট থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ৬ মাসে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ১১২ জন। সে হিসাবে অন্তর্বর্তী সরকারের গত ছয় মাসে গড়ে প্রতি মাসে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ১৯ জন।
আসকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের গতকাল সোমবার পর্যন্ত গত একবছর ১১ দিনে মব সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ২০৮ জন। গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ১৯৯ জন। চলতি মাসের গত ১১ দিনে নিহত হয়েছেন ৯ জন। এদের মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৯২ জন, খুলনায় ১৮ জন, রাজশাহীতে ১৭ জন, রংপুরে ৯ জন, সিলেটে ৫ জন, চট্টগ্রামে ৩৫ জন, বরিশালে ১৭ জন ও ময়মনসিংহ বিভাগে নিহত হয়েছেন ৬ জন।
পরিসংখ্যান বলছে, পট পরিবর্তনের মাস আগস্টে গণপিটুনিতে মারা যান ২১ জন। পরের মাস সেপ্টেম্বরে গণপিটুনিতে মৃত্যু হয় ২৮ জনের, যা ২০২১ সালের পুরো বছরের সমান। গত বছরের অক্টোবরে গণপিটুনিতে মারা গেছেন ১৯ জন, নভেম্বরে ১৪ জন ও ডিসেম্বরে ১৪ জন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে গণপিটুনিতে নিহত হন ১৬ জন। ফেব্রুয়ারিতে ১১ জন, মার্চে ২০ জন, এপ্রিলে ১৮ জন, মে মাসে ১৩ জন, জুন মাসে নিহত হয়েছেন ১১ জন এবং জুলাই মাসে নিহত ১৪ জন। এছাড়া চলতি মাসে এ পর্যন্ত ৯ জন নিহত হয়েছেন গণপিটুনিতে।
আসকের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে গণপিটুনির ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১২৮ জন। ২০২৩ সালে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছিল ৫১ জন, ২০২২ সালে ৩৬ জন, ২০২১ সালে ২৮ জন এবং ২০২০ সালে ৩৫ জন।
ভয়েস ফর রিফর্ম ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) পরিচালিত এক সমীক্ষার ফলে জানা গেছে, দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ মব সহিংসতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। গতকাল রাজধানীর আগারগাঁও জাতীয় আর্কাইভস অডিটোরিয়ামে জরিপের ফল প্রকাশ করা হয়। জরিপে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম, জনগণের সংস্কার প্রত্যাশা এবং আসন্ন নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর জনসমর্থন বিষয়ে মতামত নেওয়া হয়। সমীক্ষায় দেখা যায়, নারীর নিরাপত্তা, রাতে চলাচলের নিরাপত্তা এবং পোশাক নিয়ে হয়রানি নিয়েও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মানুষের উদ্বেগ রয়েছে।
ফলে বলা হয়, সার্বিকভাবে মব সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ ৮০ শতাংশ, নারীর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ ৫৬ শতাংশ, রাতে চলাচলের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ ৬১ শতাংশ এবং পোশাক নিয়ে রাস্তায় হয়রানির উদ্বেগ ৬৭ শতাংশ।
বিভিন্ন সামাজিক পরিস্থিতি কত শতাংশ মানুষের কাছে নেতিবাচক মনে হয়, তা পরিমাপ করেও সমীক্ষায় উপস্থাপন করা হয়েছে। ‘জনগণের মতামত, অভিজ্ঞতা ও প্রত্যাশা জুলাই ২০২৫’ শীর্ষক জরিপটি সারা দেশের ৬৪ জেলায় ৫ হাজার ৪৮৯ জন নারী ও পুরুষের মধ্যে টেলিফোনে পরিচালিত হয়। চলতি বছরের ১ থেকে ২০ জুলাই এই তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
গত ৯ আগস্ট শনিবার রংপুরের তারাগঞ্জের ঘনিরামপুর এলাকার রূপলাল দাস (৪০) ও মিঠাপুকুর উপজেলার প্রদীপ দাসকে (৩৫) ভ্যান চোর সন্দেহে স্থানীয়রা পিটিয়ে হত্যা করে। সম্পর্কে তারা ভাগনি জামাই ও শ্বশুর। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা গেছে, স্থানীয় কয়েকজন বটতলা এলাকায় ভ্যান থামিয়ে রূপলাল ও প্রদীপকে আটক করেন। ভ্যান থেকে বের করা হয় একটি প্লাস্টিকের বস্তা। নাম-পরিচয় জিজ্ঞেস করলে তারা চুপ ছিলেন। একপর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে কয়েকজন তাদের মারতে যান। কিন্তু মেহেদী হাসান নামের যুবক তাদের মারধর করতে বাধা দেন এবং পুলিশে খবর দেওয়ার কথা জানান। এ সময় রূপলাল উত্তর দেন, ‘আমি চোর না, ডাকাতও না। মুচি তারাগঞ্জ বাজারে জুতা সেলাই করি।’ কিন্তু ভিড়ের মধ্যে কেউ উচ্চস্বরে বলে ওঠে ‘তুই চোর-ডাকাইতের বাপ।’ এ সময় রূপলাল প্রস্রাবের কথা বললেও, পালিয়ে যাবেন ভেবে তাকে সুযোগ দেয়নি উত্তেজিত জনতা। হঠাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন, আর ভ্যানের ওপরে বসা প্রদীপকে লক্ষ্য করে লোকজন বলতে থাকে- ‘মাল খেয়ে আসছে, অভিনয় করছে।’
এ সময় ভ্যানে থাকা বস্তা থেকে প্লাস্টিকের বোতল বের করে নাকে নিয়ে গন্ধ শুঁকেন মেহেদী হাসান নামের এক যুবক। কিছুক্ষণ পরই তিনি বলেন, ‘এ ভাই, দয়া করে আমাকে ধরো’ বলে মাটিতে পড়ে যান। দুজন তাকে ধরে সরিয়ে নেন। তখনই ক্ষুব্ধ জনতা রূপলাল ও প্রদীপকে মারধর শুরু করে।
রাত ১১টার দিকে পুলিশ এসে দুজনকে উদ্ধার করে তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। চিকিৎসক রূপলালকে মৃত ঘোষণা করেন। গুরুতর আহত প্রদীপকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়, যেখানে রোববার ভোর ৪টার দিকে তারও মৃত্যু হয়।
অন্যদিকে গতকাল বেলা ১১টার দিকে টঙ্গীতে ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনিতে অজ্ঞাত (২২) এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ বলছে, বাসের জানালা দিয়ে টান মেরে মোবাইল ছিনতাইয়ের সময় তাকে গণপিটুনি দেওয়া হয়। মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।
রংপুরে চুরির সন্দেহে দুজনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) গভীর উদ্বেগ ও তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। এ ধরনের ঘটনা প্রচলিত আইন, সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদ-ের দৃষ্টিতে অত্যন্ত বিপজ্জনক ও অগ্রহণযোগ্য বলে জানিয়েছেন, আসকের সিনিয়র সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির।
তিনি বলেন, আইন ও সালিশ কেন্দ্র মনে করে, আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে হত্যা করা আইনের শাসন ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। সংবিধানের ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদে প্রত্যেক নাগরিকের আইনগত সুরক্ষা ও জীবন রক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে, যা এই ঘটনায় গুরুতরভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনেও এ ঘটনা জীবন ও নিরাপত্তার অধিকারের গুরুতর হানিকর।
আসক জোরালোভাবে বলতে চায়, গণপিটুনিতে হত্যা করার ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটে চলেছে, যা দেশের সব নাগরিকের মধ্যে গভীর উদ্বেগ ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি সামাজিক সম্প্রীতি ও আইনের শাসনের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শুধু ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাসের ১০ তারিখ পর্যন্ত কমপক্ষে ১১১ জন নাগরিক মব সন্ত্রাসের শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র মনে করে, এই ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে, যেকোনো সংঘবদ্ধ প্ররোচনামূলক কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত গোষ্ঠী বা ব্যক্তি বিশেষকে দায়মুক্তি না দিয়ে তাদের শনাক্ত করে কঠোরভাবে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। কেননা এ ধরনের নির্মম ঘটনা মানবাধিকারের ভিত্তিকে সরাসরি আঘাত করে।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) জানিয়েছে, আইনকে নিজ হাতে তুলে নিয়ে নির্যাতন বা গণপিটুনির মতো ঘটনা ঘটিয়ে গুরুতর আহত করাও অবশ্যই ফৌজদারি অপরাধ। এ ক্ষেত্রে গণপিটুনির সাথে জড়িত অপরাধীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী তথা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এমএসএফ মনে করে, আইন অবজ্ঞা করে মব সহিংসতা তৈরি করে সমাজে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করে এক ভয়াবহ পরিবেশ তৈরিতে জড়িত অপরাধীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।