১৫ আগস্ট ঘিরে অঘটন ও নৈরাজ্যের আশঙ্কায় দেশজুড়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। দিনটিকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের নৈরাজ্য ঠেকাতে এ সতর্ক অবস্থান বলে জানিয়েছে পুলিশ।
আগামী ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে দেশের কারাগারে নাশকতার আশঙ্কাও রয়েছে। সরকারের বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
ঘটনাবহুল আগস্ট মাসে ক্ষমতার পালাবদলের এক বছর পূর্তি। সরকারের পাশাপাশি ফ্যাসিবাদবিরোধী দলগুলোর নানা কর্মসূচি চলছে। এ সময়ে নাশকতা হতে পারে বলে আশঙ্কা খোদ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর। হতে পারে হতাহতের মতো ঘটনাও। এ অবস্থায় ১৫ আগস্ট কর্মসূচির নামে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দেশজুড়ে ব্যাপক নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে এমন তথ্যের ভিত্তিতে সারা দেশে কঠোর নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার।
গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, ১৫ আগস্ট রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশে হামলাসহ বহুমুখী অঘটন ও নৈরাজ্যের ঝুঁকি থাকতে পারে। সম্ভ্যাব্য হামলা ঠেকাতে প্রতিরোধমূলক প্রস্তুতিতে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পরিস্থিতি মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের একটি সূত্র রূপালী বাংলাদেশকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে দিনটি ঘিরে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সারা দেশে দায়িত্বরত পুলিশ অফিসার ও এসপিদের বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর, ডিএমপি ও র্যাব সদর দপ্তর এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্রে একই তথ্য জানা গেছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা গতকাল মঙ্গলবার নৈরাজ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ে বৈঠক করেন। এ বৈঠকে কারা সংশ্লিষ্টরাও উপস্থিত ছিলেন। এ সময় কারাগার কর্মকর্তাদের আলাদাভাবে সতর্ক থাকতে বলা হয়।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘সারা দেশে যাতে কেউ কোনো ধরনের নাশকতা সৃষ্টি করতে না পারে সে জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশের বিশেষ ইউনিট ও জেলা, মহানগরকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।’
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আগস্ট ঘিরে বড় ধরনের নাশকতার ঘটনা ঘটলে তা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এবং অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, ১৫ আগস্ট ঘিরে বড় ধরনের নাশকতার ঘটনা ঘটলে তা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের নিতে হবে। তাদের মনে রাখা উচিত, দেশের মানুষের নিরাপত্তার দায়িত্ব তাদের কাজেই জনগণকে নিয়ে সবার সতর্ক থাকা উচিত।
এদিকে দিনটি ঘিরে নিরাপত্তা বিঘœ হওয়ার আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক নেতারাও। এ বিষয়ে বিএনপি চেয়ারপারসনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ফজলে এলাহী আকবর বলেন, ‘আগস্টে দেশে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। ১৫ আগস্টকে কেন্দ্র করে নৈরাজ্য বন্ধে জনগণকে সচেতন করতে হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীসহ আরও যেসব স্টেকহোল্ডার আছে তাদের এই বার্তা দেওয়া উচিত, তারা যেন সরকারকে সহায়তা করে, যাতে অস্থির কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়। একই সঙ্গে সব রাজনৈতিক দল-মত মিলে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। নৈরাজ্য সৃষ্টি হলে সরকার ও দেশের মানুষ কারোর জন্য ভালো হবে না।’
বন্দি পলায়নের আশঙ্কায় কারাগারে কঠোর নিরাপত্তা
এদিকে ১৫ আগস্টকে কেন্দ্র করে নাশকতামূলক কর্মকা-, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও বন্দি পলায়নের আশঙ্কায় দেশের সব কারাগারে রেড অ্যালার্ট জারি করেছে কারা অধিদপ্তর। সম্প্রতি এক নির্দেশনায় প্রত্যেক কারা কর্তৃপক্ষকে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা জোরদার এবং বন্দিদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া সার্বিক বন্দি ব্যবস্থাপনায় সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
এ নির্দেশনার পর নড়েচড়ে বসেছেন সব কারাগারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। বিশেষ করে যেসব কারাগারে সন্ত্রাসী, দাগি অপরাধী, জঙ্গি, দুর্ধর্ষ প্রকৃতির বন্দি এবং ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী, এমপি ও গুরুত্বপূর্ণ নেতা বন্দি রয়েছেন; সেসব কারাগারে বাড়তি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত তিন আসামি পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তবে পালানোর আগেই বিষয়টি নজরে আসে কারা কর্তৃপক্ষের। এরপরই কারাগারটির নিরাপত্তায় বিজিবি ও পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন বলেন, সব কারাগারে সতর্কতা জারি রুটিন কাজের অংশ। বন্দি ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমরা কারাগারগুলোর অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা জোরদার করতে বলেছি। সতর্কতা জারির ক্ষেত্রে গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তিন আসামি পালানোর চেষ্টার ঘটনাটিকেও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
একাধিক খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কারা অধিদপ্তরের নির্দেশনার পর দেশের সব কারাগারের প্রধান ফটকে আগস্ট মাসের শুরু থেকেই অস্ত্রধারী কারারক্ষীদের সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে। এ ছাড়া বন্দিদের সঙ্গে স্বজনের দেখা-সাক্ষাতেও বাড়তি সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বন্দিদের সেলগুলোয় কারা কর্তৃপক্ষের নিজস্ব গোয়েন্দা ইউনিটের সদস্যদের নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিভিন্ন আদালতে হাজিরা শেষে বন্দিদের কারাগারে ঢোকানোর সময় সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে তল্লাশি করা হচ্ছে যেন বন্দিরা অস্ত্র, গুলি, চাকুসহ অন্যান্য ক্ষতিকারক বস্তু নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে। ওয়াচ টাওয়ার থেকে কারাগারের চৌহদ্দিতে নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া কারাগার থেকে বন্দিদের আদালতে আনা-নেওয়ার সময় যাতে বন্দি ছিনতাইয়ের কোনো ঘটনা না ঘটে, সে বিষয়েও সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
সম্প্রতি কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার থেকে পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন মৃত্যুদ-প্রাপ্ত তিন আসামি। এ জন্য তারা বিভিন্ন উপকরণ সংগ্রহ করে তমাল ভবনের নিচতলায় ১২ নম্বর কক্ষের দেয়াল খুঁড়ছিলেন। ৫ আগস্ট রাতে বিষয়টি টের পায় কর্তৃপক্ষ। পরদিন ৬ আগস্ট সকালে ওই কক্ষে তল্লাশি চালিয়ে একটি লোহার পাত, দুই টুকরা রড, কম্বল কেটে বানানো ২৮ ফুট লম্বা রশি, ২৫ ফুট লম্বা বেল্ট, লোহার তৈরি ২টি আংটা, ১০ ফুট লম্বা একটি খুঁটিসহ বিভিন্ন উপরকরণ জব্দ করা হয়। এ ঘটনায় গেল বৃহস্পতিবার কোনাবাড়ী থানায় একটি মামলা দায়ের করে কারা কর্তৃপক্ষ। মামলার এজাহার অনুযায়ী, ওই তিন আসামি কারাগার থেকে পালানোর প্রস্তুতি হিসেবে এসব উপকরণ সংগ্রহে রেখেছিলেন।
কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মোহাম্মদ আবদুল্লাহ-আল-মামুন রূপালী বাংলাদেশকে জানান, ‘সম্প্রতি আগস্ট মাস থেকে শুরু করে এবং ১৫ আগস্ট ও অন্যান্য বিষয় মাথায় রেখে কারাগারে সর্বোচ্চ নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমরা সতর্ক রয়েছি এবং সরকারের পক্ষ থেকেও আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।’
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সুরাইয়া আক্তার জানান, ‘কারাগারে যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না হয় সেই বিষয়ে আমরা সতর্ক রয়েছি। সেই সঙ্গে সরকারি আদেশ মেনেই আমরা কাজ করছি। যাতে কারাগারে সর্বক্ষেত্রে বন্দিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।’
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম জানান, ‘শুধু আগস্ট মাস নয়, ১৫ আগস্টে নাশকতার আগাম তথ্য পেয়ে সতর্ক রয়েছে ডিবি পুলিশ। এ ছাড়া আমাদের একাধিক টিম আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মাঠে সক্রিয় রয়েছে।’
পুলিশের সাবেক আইজিপি মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেছেন, ‘১৫ আগস্টকে কেন্দ্র করে দেশের মাটিতে যেকোনো নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে জনগণের জানমাল রক্ষা করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর। তারা যাতে দেশের যেকোনো জায়গায় মানুষ হত্যার শিকার হতে না হয় সেদিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। ১৫ আগস্ট ঘিরে মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটাতে চাইছে একটি রাজনৈতিক চক্র। দোসরদের প্রতিরোধ করতে দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে বলে জানান পুলিশের সাবেক এই কর্মকর্তা।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানান, ‘আওয়ামী লীগের দোসররা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। তাদের কঠোর হাতে দমন করতে প্রস্তুত আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। দোসররা দেশ-বিদেশে বসে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলাসহ পরিস্থিতি অশান্ত করার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। তাদের তথ্য নিয়ে ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশ দেওয়া আছে। তারা সেই বিধি অনুযায়ী অস্থিতিশীলকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন বলে আশা করি।’