- ৫টি দেশের ৭টি শহরে অর্থ পাচার
- সাজা নিশ্চিতে কাজ করছে সিআইসি
- পাচারে জড়িত ১১ শিল্প গ্রুপের মালিক
- অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ নেতৃত্বে আসছে রদবদল
বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি)। বিশে^র ৫টি দেশের ৭টি শহরে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছে ৫২ ব্যক্তি ও ৩৫৬টি প্রতিষ্ঠান। অর্থ পাচারের দায়ে এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান শাস্তির আওতায় পড়তে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছে এনবিআরের বিশেষ একটি সূত্র।
এনবিআর জানায়, বিশে^র ৫টি দেশে অনুসন্ধান চালিয়ে নিশ্চিত হওয়ায় পরে শাস্তির মুখে পড়তে যাচ্ছেন এসব প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। শিগগিরই অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে শাস্তির খড়গ নেমে আসছে। অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সাজা নিশ্চিত করতে কাজ করছে সিআইসি। শাস্তির প্রাথমিক ধাপ হিসেবে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে শীর্ষ নেতৃত্বের বদল আনা হবে। অন্যদিকে ব্যক্তি এবং মুনাফা উপযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে কি ধরনের শাস্তি আরোপ হচ্ছে, তা জানাতে পারেনি বিশেষ সূত্রটি।
সূত্রটি আরও জানিয়েছে, অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত ছিল দেশের কয়েকটি শীর্ষ গ্রুপ। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবারসহ ১১টি শিল্প গ্রুপের মালিক পাচারের সঙ্গে জড়িত। পাচারের টাকায় বিদেশে গড়ে তোলা বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক তারা। পাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিল্প গ্রুপগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ বিদেশি ব্যবসায়ী আদনান ইমামের আইপিই গ্রুপ, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর আরামিট গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, সিকদার গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, জেমকন গ্রুপ, নাবিল গ্রুপ, সামিট গ্রুপ প্রভৃতি। পাচারের শীর্ষে থাকা ব্যাংক লুটসহ ৫২ জনের নাম দুর্নীতির তালিকায় এসেছে।
পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে কাজ করছে আন্তর্জাতিক চারটি প্রভাবশালী সংস্থা। সেগুলো হলোÑ দ্য স্টোলেন অ্যাসেট রিকভারি (এসটিএআর), ইন্টারন্যাশনাল এন্টি করাপশন কোঅর্ডিনেশন সেন্টার (আইএসিসিসি), যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস ও ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর অ্যাসেট রিকভারি (আইসিএআর)। অর্থ উদ্ধারে সম্পৃক্ত বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নগদ কোনো অর্থ দেওয়া হবে না। তবে উদ্ধার করা অর্থ থেকে কমিশন দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।
‘৪০ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির সন্ধান’ সম্পর্কে গত রোববার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে জানিয়েছেন সিআইসির মহাপরিচালক আহসান হাবিব। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের (আইআরডি) সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান এবং আহসান হাবিব প্রধান উপদেষ্টার সামনে এসব তথ্য তুলে ধরেন।
আহসান হাবিব বলেন, ‘দেশে বসেই বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রাথমিক প্রস্তুতি শেষে সিআইসির গোয়েন্দারা দেশগুলোতে সরেজমিনে পরিদর্শন করে বিস্তারিত তথ্য তুলে নিয়ে আসেন’। আরও অনুসন্ধান চলমান জানিয়ে আহসান হাবিব বলেন, ‘এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থ পাচার করে গড়ে তোলা ৩৪৬টি সম্পত্তির সন্ধান মিলেছে। এটি আমাদের অনুসন্ধানের আংশিক চিত্র।’
সিআইসির মহাপরিচালক হিসেবে তিনি বলেন, ‘এসব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে বাংলাদেশের অনুকূলে নিয়ে আসার জন্য এবং অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সাজা নিশ্চিত করতে কাজ করছে সিআইসি’। অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা শেখ হাসিনার আমলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেটাবেজ (সিবিএস) নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ায় ছিল। তারা নিজেদের লোক বসিয়ে বহু তথ্য গায়েব করে দিয়েছে জানিয়ে আহসান হাবিব বলেন, ‘আশার বিষয় হচ্ছে, মুছে দেওয়া তথ্য উদ্ধারে দক্ষতা অর্জন করেছে সিআইসি’।
পরে গণমাধ্যমকে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বলা হয়, ৯টি দেশে ৩৫২টি পাসপোর্টের সন্ধান পাওয়া গেছে, যেগুলো টাকার বিনিময়ে অর্জন করেছে কিছু বাংলাদেশি। দেশগুলো হচ্ছেÑ অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বারমুডা, অস্ট্রিয়া, ডমেনিকা, গ্রেনেডা, সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস, নর্থ মেসিডোনিয়া, মালটা, সেন্ট লুসিয়া ও তুরস্ক।
বিস্তারিত জানার পর প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেন, ‘অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সিআইসি ও পুলিশের সিআইডিসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ দেশের সম্পদ লুট করে বিদেশে সম্পত্তি তৈরি করতে না পারে।’
সিআইসিকে অনুসন্ধান কাজ চলমান রাখার নির্দেশনা দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেন, ‘যতদূর সম্ভব গভীরে যেতে হবে এবং সম্ভাব্য আরও দেশে অনুসন্ধান বিস্তৃত করতে হবে। যাতে দেশের সম্পদ দেশে ফিরিয়ে আনতে সম্ভাব্য সব পদক্ষেপে সরকার সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে।’
এদিকে, এনবিআরে আন্দোলনের জের ধরে গতকাল আরও চার কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। অফিসের ‘দাপ্তরিক কাজে বাধা দেওয়া এবং সংগঠনের ভূমিকা পাালনের মাধ্যমে দেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করায় এই সিদ্ধান্ত’ গ্রহণ করেছে এনবিআর। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের (আইআরডি) এক আদেশে তাদের বরখাস্ত করা হয়েছে।