ঢাকা শনিবার, ২৩ আগস্ট, ২০২৫

নারী পাচারের পরিসংখ্যান আছে প্রতিকার নেই

আরিয়ান স্ট্যালিন
প্রকাশিত: আগস্ট ২২, ২০২৫, ১১:০২ পিএম

চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি, ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্ত দিয়ে পাচার করা হচ্ছিল ঢাকার একটি স্কুলের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীসহ তিন কিশোরীকে। কিশোরীরা জানায়, ‘ইন্ডিয়া যাবি নাচ শিখতে? মাসে ৫০ হাজার টাকা বেতন’, ‘নীল পাখি’ নামের একটি ফেসবুক আইডি থেকে তাদের একজনের কাছে বার্তা আসে। সেটিই তাদের ফাঁদে পড়া শুরু। পাচারকারী তাদের আত্মীয় না হলেও তিন শিক্ষার্থীরই পূর্বপরিচিত ও তারা সমবয়সি। এক কিশোরী জানায়, পূর্বপরিচিত এক মেয়ের ফেসবুক আইডির নাম নীল পাখি। মেয়েটির মা-ও একই আইডি ব্যবহার করেন। ওই আইডি থেকে একদিন তার সঙ্গে যোগাযোগ করে। এরপর ভারতে নাচ শিখতে যাওয়া এবং বড় অঙ্কের বেতন পাওয়ার কথা সে তার দুই সহপাঠীকে জানায়। তারাও যেতে রাজি হয়। নীল পাখি আইডি থেকে যোগাযোগ করা মেয়েটির মা তাদের ভারতের উদ্দেশে রওনা দিতে সহায়তা করেন।

তিন কিশোরী জানায়, গত ১০ ফেব্রুয়ারি সকালে তারা ঢাকা থেকে ঝিনাইদহের বাসে ওঠে। বাসের কন্ডাক্টর তাদের ঝিনাইদহে এক লোকের হাতে তুলে দেন। সেই লোক এক নারীর বাসায় নিয়ে যান। সেখান থেকে সন্ধ্যায় তাদের ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় তুলে দেওয়া হয়। অটোরিকশাচালক তাদের সীমান্ত এলাকা মহেশপুরে এক লোকের কাছে নিয়ে যান। ওই লোকের সঙ্গে সীমান্ত পাড়ি দিতে যাওয়ার সময় বিজিবির সদস্যরা তাদের ধাওয়া করে। দৌড়ে পালানোর সময় একজন কিশোরী হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। অন্যরাও আর এগোতে পারেনি। তখন তিন কিশোরীকে উদ্ধার করে বিজিবি। মুখে গামছা বাঁধা লোকটি পালিয়ে যান। বাংলাদেশ থেকে নারী ও শিশুদের ভারতে পাচারের এই প্রবণতা থেমে নেই। বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সীমান্তে কড়াকড়ি বেড়েছে। তবে পাচারকারীরা ফাঁকফোকর ঠিকই খুঁজে নিচ্ছে।

সীমান্ত থেকে উদ্ধার করা তিন কিশোরীর একজন বাদী হয়ে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি মহেশপুর থানায় মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২-এ মামলা করে। মামলায় কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। তিন কিশোরীই নি¤œবিত্ত পরিবারের সদস্য। তারা ভাগ্যবানÑ পাচার হওয়ার আগেই তাদের উদ্ধার করা গেছে। তারা ফিরতে পেরেছে পরিবারের কাছে। কিন্তু সবার এমন সৌভাগ্য হয় না। অনেকেই পাচারের শিকার হন। ভারতে নিয়ে তাদের বিক্রি করে দেওয়া হয়। বাধ্য করা হয় যৌনকাজে।

পাচারকারীরা সাধারণত নি¤œবিত্ত ও আর্থিক সংকটে থাকা নারীদের লক্ষ্যবস্তু বানায়। যেমন ঢাকার বাসিন্দা ক্যানসার আক্রান্ত এক নারীর চিকিৎসায় অনেক অর্থ ব্যয় হচ্ছিল। তার বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছিল। প্রতিবেশী এক নারী তাকে জানান, ভারতে চিকিৎসা খরচ কম। সেখানে গিয়ে কাজ করে তিনি নিজেই চিকিৎসা করাতে পারবেন। তার ফাঁদে পড়ে গত বছরের ১০ অক্টোবর ওই নারী ভারতে পাচারের শিকার হন। গত বছরের ২১ নভেম্বর হায়দরাবাদের পুলিশ তাকে যৌনপল্লি থেকে উদ্ধার করে।

ভারতে দিন দিন বাড়ছে বাংলাদেশি নারী পাচার ও জোরপূর্বক দেহব্যবসায় বাধ্য করার ঘটনা। সম্প্রতি দেশটির হায়দরাবাদ ও মহারাষ্ট্রসহ বিভিন্ন রাজ্যে অভিযান চালিয়ে একাধিক বাংলাদেশি নারী ও কিশোরীকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। সম্প্রতি হায়দরাবাদ থেকে এক বাংলাদেশি কিশোরীকে উদ্ধার করা হয়, যাকে জোর করে দেহব্যবসায় নামানো হয়েছিল। এ ছাড়া গত এক মাসে খাইরতাবাদ, চাদেরঘাট ও বান্দলাগুডার বিভিন্ন যৌনপল্লি থেকে অন্তত চারজন বাংলাদেশি নারীকে উদ্ধার করেছে পুলিশ।

এর আগে, মহারাষ্ট্রের পালঘরে যৌন র‌্যাকেট থেকে উদ্ধার হওয়া ১৪ বছর বয়সি এক বাংলাদেশি কিশোরী জানায়, গত তিন মাসে অন্তত ২০০ জন পুরুষ তাকে যৌন নির্যাতন করেছে। মানবপাচারবিরোধী ইউনিট (এএইচটিইউ), এনজিও এক্সোডাস রোড ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন এবং হারমনি ফাউন্ডেশনের যৌথ অভিযানে গত ২৬ জুলাই মীরা-ভায়ন্দর ভাসাই-ভিরার পুলিশ তাকে উদ্ধার করে।

২০০০ সালের শুরু থেকেই হায়দরাবাদের যৌনপল্লিতে বাংলাদেশি নারীদের আটকে রাখার ঘটনা ঘটছে। শুধু বাংলাদেশি নয়, উজবেকিস্তান, রাশিয়া, ইউক্রেন, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের নারীরাও পাচার হয়ে দেহব্যবসায় নিপতিত হচ্ছে।

ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য মতে, বাংলাদেশের দারিদ্র্যপীড়িত এলাকা থেকে নারীদের চাকরির প্রলোভন ও ভালো জীবনের আশ্বাস দেখিয়ে ভারতে পাচার করা হয়। সীমান্ত এজেন্টদের সহায়তায় অবৈধভাবে প্রবেশের পর তাদের ভুয়া পরিচয়পত্র তৈরি করে বিভিন্ন শহরে পাঠানো হয়। পরে দালালদের মাধ্যমে যৌনপল্লিতে বিক্রি করে দেওয়া হয়।

সেন্ট্রাল সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার বোর্ড (সিএসডব্লিউবি) পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ভারতে বাণিজ্যিক যৌন শোষণের শিকার নারীদের মধ্যে অন্তত ২ দশমিক ৭ শতাংশই বাংলাদেশি। কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই ও হায়দরাবাদের যৌনপল্লিগুলোতে এসব নারী বিক্রি হয় বলে জানানো হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশ-ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ অভিযান, সীমান্ত নজরদারি জোরদার এবং সচেতনতা কার্যক্রম বাড়ানো ছাড়া এ ভয়াবহ মানবপাচার রোধ করা সম্ভব নয়।

বিশ্বব্যাপী দ্রুত বর্ধনশীল সংঘবদ্ধ অপরাধগুলোর মধ্যে মানব পাচার অন্যতম। বিগত বছরগুলোয় বাংলাদেশেও মানব পাচারের হার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য মতে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের খোঁজে পাড়ি জমিয়েছেন ১৩ লাখ ৫ হাজার ৪৫৩ জন। এদের মধ্যে ৭৬ হাজার ৫১৯ নারী অভিবাসী কর্মী; যাদের ৬৬ শতাংশ সৌদি আরবে ও ১০ শতাংশ জর্ডানে ও ৯ শতাংশ ওমানে গেছেন। এ ছাড়া বিএমইটির তথ্য মতে, ২০২৪ সালে মোট ১০ লাখ ১১ হাজার ৮৫৬ জন কর্মী বিদেশে গেছেন। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মাত্র ৫৪ হাজার ৬৯৬ জন নারী কর্মী বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন, যা এই সময়ের মোট অভিবাসনের মাত্র ৬ দশমিক ০৩ শতাংশ। ২০২৩ সালের তুলনায় গত বছর নারী কর্মীদের অভিবাসন কমেছে ২২ শতাংশ।

ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের ‘মানব পাচার রিপোর্ট ২০২৪’ অনুযায়ী, সরকারের পাচারের ভিকটিম শনাক্তকরণ হিসাবে দেশে ১ হাজার ২১০ জন পাচারের শিকার, যার মধ্যে ২১০ জন যৌন, ৭৯৫ জন জোরপূর্বক শ্রম ও ২০৫ জন অন্যান্য ধরনের পাচারের শিকার। একই সময়ে এনজিও এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তথ্য মতে, কমপক্ষে ১০ হাজার ১৩৫ ভিকটিমকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ১ হাজার ৭৮৪ জন যৌন পাচার, ৮ হাজার ৯০৯ জন শ্রম পাচার এবং ২৬১ জন অন্যান্য ধরনের পাচারের শিকার। 

প্রেমের ফাঁদে ফেলে, বিয়ে করে সন্তানসহ বিদেশ নিয়ে যৌনকাজে বাধ্য করার ঘটনাও রয়েছে। শুধু ভারতে নয়, মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিক পাঠানোর কথা বলেও নানা প্রতারণার ঘটনা ঘটে, যা আইনের দৃষ্টিতে পাচার। যেমন সাতক্ষীরার এক নারী গত বছরের ২১ নভেম্বর সৌদি আরবে গিয়েছিলেন কাজের উদ্দেশ্যে। পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজের কথা বলে তাকে দেওয়া হয় একটি বাসায় গৃহকর্মের কাজ। সেখানে তিনি যৌন নির্যাতনের শিকার হন। জানুয়ারি মাসে তিনি ফেরত আসেন। এক নারী বলেছিলেন, তার ছয় মাসের সন্তানকে জিম্মি করে তাঁকে যৌনকাজে বাধ্য করা হতো। বারান্দা থেকে শিশুসন্তানকে ঝুলিয়ে ধরে বলা হতো, কথা না শুনলে ওপর থেকে ফেলে দেবে।

বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্রের বছরে মুনাফা প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার। মানব পাচার রূপ নিয়েছে ভয়াবহ ও দ্রুত বিস্তার লাভকারী সংঘবদ্ধ অপরাধে। সেসব অপরাধচক্র (সিন্ডিকেট) শিশু, নারী ও পুরুষকে ব্যবহার করছে শ্রম শোষণ, যৌন নিপীড়ন, জোর করে বিয়ে, মাদক পাচার ও অনলাইন প্রতারণার মতো বিভিন্ন অপরাধে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় ৫০ মিলিয়ন মানুষ ‘আধুনিক দাসত্বে’ জীবনযাপন করছে, যার মধ্যে ১২ মিলিয়ন শিশু এবং ৬১ শতাংশ নারী ও কিশোরী। 

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালে থানাগুলোতে মানব পাচারের বিরুদ্ধে ১ হাজার ১৩৫টি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া গত বছরের শেষ নাগাদ দেশব্যাপী মানব পাচার দমন ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ২৯১টি। এসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে প্রায় ১৬ হাজার অভিযুক্তকে। দায়ের করা মামলার মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ৬৬২টির। এর মধ্যে ৩৮টি মামলায় দোষীদের দেওয়া হয়েছে কারাদ- ও অর্থদ-। তাদের মধ্যে পাঁচজনকে দেওয়া হয় আজীবন কারাদ-। ৫৫ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- হয়েছে। এ ছাড়া ১ হাজার ২০০ জন অভিযুক্ত খালাস পেয়েছেন। আর ১ হাজার ৭৯টি মামলায় নতুনভাবে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে আদালতে।