আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দৃঢ়প্রত্যয় তুলে ধরে এ বিষয়ে বাধা আসবে জানিয়ে সতর্ক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, ‘যারা অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচন পর্যন্ত পৌঁছাতে দিতে চায় না, তারা যত রকমভাবে পারবে বাধা দেবে। বাংলাদেশের সত্তাকে গড়ে তুলতে তারা বাধা দেবে। তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে নির্বাচন বানচাল করার। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করার চেষ্টা করবে, যাতে নির্বাচন না হয়। এগুলোর কিছু লক্ষণ এখন দেখা যাচ্ছে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, সামনে আরও আসবে। এ জন্য আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে।’ একই সঙ্গে বৈঠক শেষে ৭ দলের নেতারা জানান, প্রধান উপদেষ্টা সুষ্ঠু নির্বাচনে বদ্ধপরিকর।
গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় সাতটি রাজনৈতিক দল ও হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে এসব কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ওই বৈঠক শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকের ব্রিফিংয়ে বৈঠকের আলোচনা তুলে ধরেন। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘নির্বাচন ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচিত সরকারের হাতে আমরা ক্ষমতা হস্তান্তর করব।’ এ নির্বাচন নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর, সাহস অর্জনের নির্বাচন হবে বলে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘নিজের ভূমিতে দেশ পরিচালনার নির্বাচন। এ নির্বাচনে অন্য কোনো দেশের থাবা মারার কোনো সুযোগ যেন না থাকে।’
প্রেস সচিব জানান, প্রধান উপদেষ্টা বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোকে বলেছেন আনন্দ ও উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন হবে। যারা আগে কখনো ভোট দিতে পারেনি তাদের জন্য এ নির্বাচনে ভালো অভিজ্ঞতা দিতে হবে। আগে যারা ভোট দিতে গিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন, তাদেরও ভালো অভিজ্ঞতা দিতে হবে। কেউ যেন বলতে না পারে ভোট দিতে দেওয়া হয়নি। এ নির্বাচন আয়োজনে প্রতি পদে পদে বাধা আসবে উল্লেখ করে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সতর্ক করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘সবার মনে দ্বন্দ্ব তৈরি করার চেষ্টা করবে। আমরা যেন সঠিক থাকি, স্থির থাকি। সবাই একসঙ্গে সহযোগিতা করি।’
এবারের নির্বাচন অনন্য নির্বাচন হবে বলে আশাবাদ জানান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘এটা অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচন নয়। এটা এ দেশের সব মানুষের, সব রাজনৈতিক দলের নির্বাচন। আমরা এ নির্বাচন আয়োজনে আপনাদের সর্বাত্মক সমর্থন চাই।’ প্রধান উপদেষ্টা আসন্ন দুর্গাপূজায় সবাইকে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন বলেও জানান প্রেস সচিব শফিকুল আলম। বৈঠকে উপদেষ্টাদের মধ্যে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার, পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
যা বললেন ৭ দলের নেতারা:
দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করতে সাতটি রাজনৈতিক দল ও হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল বিকেল ৫টার পরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় এ বৈঠক হয়। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে কথা বলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন বলেন, বৈঠক ছিল দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্নে। আমরা উপদেষ্টাম-লীকে ধন্যবাদ জানিয়েছি। স্বাধীনতার পর থেকে যারাই ক্ষমতায় ছিল, তারা জনপ্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। যে লাউ, সেই কদু করে নির্বাচন দিলে এবারও জাতির প্রত্যাশা পূরণ হবে না। ঐকমত্য কমিশনে ২৬টি দল পিআরের পক্ষে মত দিয়েছে। দেশের দুর্নীতি সন্ত্রাস, ভোট ডাকাতি, এককভাবে নির্বাচন, ডামি প্রার্থী এগুলো মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন। পিআর পদ্ধতি নির্বাচন না দিলে গণভোটের ব্যবস্থা করেন। জিয়াউর রহমান, এরশাদ সাহেবকে চায় কি চায় না, এর জন্য গণভোট হয়েছে। তারা বলেছেন, এসব বিষয়ে চিন্তাভাবনা উনারা করবেন।
এলডিপির সেক্রেটারি জেনারেল রেদোয়ান আহমেদ বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য কী কী পদক্ষেপ নিতে পারি এসব জানতে চেয়েছেন। আমরা বলেছি, আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা উন্নতিকল্পে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। বিগত সরকার তাদের লোক এমনভাবে বসিয়েছে, প্রশাসনের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত আছে। একটা নিরপেক্ষ করার জন্য সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।’
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুর রহমান ইসলামাবাদী বলেন, ‘আমরা দাবি জানিয়েছি, সংবিধানে আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস পুনর্বহাল করতে। জুলাই সনদে শাপলা চত্বরে যে গণহত্যা হয়েছে, তা অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছি। আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারের চিহ্নিত ক্রিমিনাল, দোসর তাদের গ্রেপ্তার করুন। প্রশাসনের মধ্যে যারা আছে, তাদের বহিষ্কার করুন।’
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বদ্ধপরিকর। একটা উৎসবমুখর নির্বাচন তারা আয়োজন করতে চান। তাই তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পরামর্শ সহযোগিতা চেয়েছেন। আমরা দুটি বিষয় বলেছি। একটা হচ্ছে, সরকার যেভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে, রাষ্ট্র পুনর্গঠন যথার্থ হয়নি। সে কারণে নানা সংকট তৈরি হচ্ছে। এতে রাজনৈতিক মহলে একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে। নির্বাচনের পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।’
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘আমরা বলেছি সরকারের কার্যক্রমে শৃঙ্খলার অভাব দেখতে পাচ্ছি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় দেখা গেছে, সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয়হীনতা আছে। এটা ঠিক না হলে নির্বাচন নিয়ে সংশয় কাটবে না। এসব ঘটনায় সরকারের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।’ মঞ্জু আরও বলেন, জাতীয় ও জেলা উপজেলা পর্যায়ে একটা সমন্বিত কমিটি করার কথা বলেছি, যাতে আসনভিত্তিক সংকট সমাধানে তারা ভূমিকা রাখতে পারে।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, ‘নুরুল হক নুরের ওপর হামলার ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে আজ দুঃখ প্রকাশ করেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটির কথা বলা হয়েছিল, আইন উপদেষ্টা জানিয়েছেন, বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি আজ রাতেই প্রকাশ করা হবে। আজ সকালে আমি ঢাকা মেডিকেলে গিয়েছিলাম, নুর কথা বলতে পারছেন না। কথা বললে গলা দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। আমাকে নুর বলেছেন, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। নুরুল হক নুরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়া হবে এটার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।’