২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলন চলাকালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সেই সময়কার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের নেতৃত্বে দেশব্যাপী গণহত্যা চালানো হয়। সেই সময়ে আন্দোলন দমনে মারণাস্ত্র ব্যবহার, হেলিকপ্টার থেকে গুলি ও ব্লক রেইডের সিদ্ধান্ত দেন হাসিনা। আন্দোলন দমন ও হত্যাযজ্ঞ চালাতে সবচেয়ে বেশি অতিউৎসাহী ছিলেন তৎকালীন ডিএমপির ডিবিপ্রধান হারুন-অর-রশীদ; যাকে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘জিন’ বলে ডাকতেন।
গতকাল মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ০১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন বিচারিক প্যানেলে জবানবন্দিতে এসব কথা জানান আসামি থেকে রাজসাক্ষী হওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন। তিনি বলেন, একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগের রাতে ৫০ শতাংশ ভোট ব্যালট বাক্সে ভরে রাখতে শেখ হাসিনাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন তৎকালীন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) জাবেদ পাটোয়ারী। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান ও পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত আইজিবি ও বিশেষ শাখার (এসবি) সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলামের নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনীতে দুটি গ্রুপ গড়ে উঠেছিল। এই দুই গ্রুপের লোকজনের সঙ্গে ঊর্ধ্বতন মহলের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। আর দুই গ্রুপের নেতৃত্ব দেওয়া হাবিবুর রহমান ও মনিরুল ইসলাম চাইতেন তাদের নিজস্ব বলয়ের লোকজন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পোস্টিং পাক এবং ঢাকায় থাকুক।
সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন বলেন, লেথাল ওয়েপন ব্যবহারের নির্দেশনা এসেছিল শেখ হাসিনার কাছ থেকে। আর নির্দেশ বাস্তবায়িত হয়েছিল আসাদুজ্জামান খান কামালের নেতৃত্বে। তা ছাড়া সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান হাবিব, ডিবির হারুন ছিলেন মারণাস্ত্র ব্যবহারে অতিউৎসাহী। জবানবন্দিতে তিনি আরও বলেন, র্যাব-১-এ টিআইএফ নামে গোপন বন্দিশালা ছিল। অন্যান্য র্যাবের ইউনিটেও ছিল এমন বন্দিশালা। রাজনৈতিক ভিন্নমত ও সরকারের জন্য হুমকি হয় এমন মানুষদের ধরে আনা হতো এখানে। তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে আসত এসব নির্দেশনা। কখনো নির্দেশনা দিতেন তারেক সিদ্দিকী। আর আয়নাঘরে আটক ও ক্রসফায়ারে হত্যার মতো কাজগুলো করতেন র্যাবের এডিসি অপারেশন ও গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক।
জবানবন্দিতে সাবেক এই আইজিপি বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর পুলিশের রাজনৈতিক প্রভাব আরও বেড়ে যায়। প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন কিছু কিছু কর্মকর্তা। ঊর্ধ্বতন রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তাদের সরাসরি যোগাযোগ ছিল। এসব কর্মকর্তা প্রায় রাতেই সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বাসায় বৈঠক করতেন। গোপন সেসব বৈঠক গভীর রাত পর্যন্ত চলত।
সাবেক আইজিপি বলেন, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিবিপ্রধান হারুন-অর-রশীদ, এসবির মনিরুল ইসলাম, ঢাকার ডিআইজি নুরুল ইসলাম, অ্যাডিশনাল ডিআইজি বিপ্লব কুমার, এএসপি কাফী, ওসি মাজহার, ফোরকান অপূর্বসহ আরও অনেকে বৈঠকে অংশ নিতেন। এর মধ্যে কারো কারো সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি যোগাযোগ ছিল।
রাজসাক্ষী মামুন বলেন, ‘সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের ব্যক্তিদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ থাকায় চেইন অব কমান্ড মানতেন না এসব কর্মকর্তা। কিন্তু আমি চাইতাম তারা পেশাদারির সঙ্গে দায়িত্ব পালন করুক। মূলত পুলিশ বাহিনীতে গড়ে তোলা দুটি গ্রুপই এসব কর্মকা- চালাত। একটির নেতৃত্ব দিতেন হাবিব ও আরেকটির নেতৃত্বে ছিলেন মনির। দুই গ্রুপের নেতৃত্বদানকারীরা চাইতেন তাদের নিজস্ব বলয়ের লোকজন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পোস্টিং পাক এবং ঢাকায় থাকুক।’ জবানবন্দিতে র্যাবে থাকাকালীন টাস্কফোর্স ইন্টারোগেশন বা টিএফআই সেলসহ বহু বন্দিশালার বর্ণনাও দেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী মামুন।
এ বছর ২৪ মার্চ মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন। তিনি জানান, স্বেচ্ছায় আসামি থেকে রাজসাক্ষী হয়ে সত্য উন্মোচন করতে চান তিনি। এর আগে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে জুলাই আন্দোলনে আহত, শহিদ পরিবারের সদস্য, চিকিৎসকসহ ৩৫ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। এ মাসেই এ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হওয়ার প্রত্যাশা করছে প্রসিকিউশন।