ঢাকা শনিবার, ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ইসলামি দল নিয়ে ঐক্য অনিশ্চিত জামায়াতের

এফ এ শাহেদ
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৬, ২০২৫, ১২:৫৫ এএম
ছবি- রূপালী বাংলাদেশ গ্রাফিক্স

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রায় এক যুগ নিষ্ক্রিয় ছিল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জামায়াত রাজনৈতিক নিবন্ধন ও প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে সাংগঠনিক লড়াইয়ের গুরুত্বপূর্ণ নজির স্থাপন করে। ফলে দলটি আনুষ্ঠানিকভাবে আবারও ভোটের মাঠে ফেরে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল জনসমাবেশ থেকে জামায়াতের সাংগঠনিক শক্তি প্রদর্শনের সঙ্গে ইসলামি দলগুলো নিয়ে একটি সম্মিলিত বিরোধী জোট গড়ার দিকটি স্পষ্ট হয়।

তবে বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় ইসলামি দলগুলো নিয়ে জামায়াতের বৃহৎ ঐক্য অনিশ্চিত বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। অবশ্য দলের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, এখনো সময় রয়েছে ঐক্য প্রক্রিয়াটি একটি পরিণতির দিকে যাবে। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক বলেন, জামায়াত এবং আমাদের চিন্তার পার্থক্যটা বিরাট। একই সাথে ঐক্যের বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছে আরও কিছু দল।

দেশে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের পালে লেগেছে জোর হাওয়া। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। যার পরিপ্রেক্ষিতে কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ায় আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশে ভোটারদের কাছে বিএনপির বিকল্প হতে চায় জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামি দলগুলো। তারা এক ছাতার নিচে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আগামী নির্বাচনে লড়তে চায়। তবে ইসলামি দলগুলোর পূর্বের ইতিহাস দেখলে ঐক্যের তেমন নজির চোখে পড়ে না।

যদিও নির্বাচন ঘিরে ঐক্য গড়ার জোর প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে, তবুও কতটা সফল হবে নাকি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে তা নিয়ে চলছে জল্পনা-কল্পনা। এমন পরিস্থিতিতে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট বেঁধে ভোটে যেতে চাচ্ছে না অধিকাংশ ইসলামি দল। এসব দলের নেতারা জোট বেঁধে ভোটে যাওয়ার ব্যাপারে সরাসরি কিছু না বললেও জামায়াতের সঙ্গে তাদের দলের আদর্শ ও চিন্তাধারার পার্থক্য সামনে আনছেন। ফলে জামায়াতের নেতৃত্বে ইসলামি দলগুলোর সমন্বয়ে একটি জোট গঠনের আলোচনা জোরেশোরে উঠলেও তা খুব সহজ হবে না বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাজনৈতিক জোট বা সমঝোতার বিষয়ে অনেক ধাপ থাকলেও ইসলামিক দলগুলোর অগ্রগতি বলতে শুধু এখন পর্যন্ত টেবিল আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। দিন যত গড়াচ্ছে, বৃহৎ জোট বা সমঝোতা নিয়ে দেখা দিচ্ছে নানা সন্দেহ ও সংশয়। 

এমন অবস্থায় সব ইসলামপন্থি দল মিলে বৃহত্তর ঐক্য গড়ার সম্ভাবনা অনেকটা ধোঁয়াশা বলেই মনে করছেন বিভিন্ন ইসলামি দলের নেতারা। দলগুলোর অনেক নেতা জামায়াতের সঙ্গে জোট করবেন নাÑ বিষয়টি এখনই প্রকাশ্যে বলতে চান না। এমনকি জামায়াতে ইসলামীকে ছাড়াই একটি পৃথক ইসলামি জোট করার কথাও ভাবছেন তারা। তবে জামায়াতে ইসলামী জোট করার বিষয়ে এখনো আশাবাদী। দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া যায়। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোটের ব্যাপারে বেশ সক্রিয় চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।

অতীতের বৈরিতা ভুলে দল দুটির মধ্যে বেশ সখ্য গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে পিআর ইস্যুতে দল দুটিকে অভিন্ন সুরে কথা বলতে দেখা গেছে। এটা ঐক্য প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করেন অনেকে। যদিও জামায়াত আশাবাদী, শেষ মুহূর্তে ঐক্য সম্ভব হবে, কিন্তু জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলনসহ অনেক দলের শীর্ষ নেতারা স্পষ্ট করেছেন, তারা জামায়াতের সঙ্গে জোটে যেতে চান না।

ঐক্যের বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ঐক্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে, খুব দ্রুতই একটা প্রক্রিয়ার দিকে যাবে ইনশাল্লাহ। তিনি বলেন, ঐক্য-মেরূকরণের এখনই সময়; ডিসেম্বরে যদি তপশিল ঘোষণা হয়, তার আগেই ঐক্যের চূড়ান্ত রূপ দেখা যাবে। ঐক্য গড়তে নানা প্রক্রিয়া চলমান থাকে সেগুলো এখন চলছে। তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদী আমলে ইসলামপন্থি দলগুলো নানাভাবে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশকে বিবেচনায় আদর্শিক দ্বন্দ্ব ভুলে বৃহত্তর স্বার্থে এক হওয়ার জন্য ঐক্যের প্রক্রিয়া চলমান। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগর উত্তরের আমির সেলিম উদ্দীন বলেন, ঐক্যের ব্যাপারে আমরা আশাবাদী। নিজ নিজ দলে কাজ চলমান রয়েছে। সব ধরনের মতভেদ, আদর্শিক বিভক্তি নতুন বাংলাদেশে কোনো ইস্যু হবে না বলে মনে করি। ইসলামি দলগুলোর ঐক্যের প্রক্রিয়াটি খুবই পজিটিভলি এগোচ্ছে। 

বৃহত্তর ঐক্য প্রসঙ্গে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফিন্দী বলেন, দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট বা সমঝোতার কোনো সম্ভাবনা আমরা দেখছি না। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে কোনো জোটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। তবে সমমনা দলগুলোর সঙ্গে জোট করার বিষয়ে আলোচনা চলমান। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক বলেন, ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে প্রথম থেকে থাকলেও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোটে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখছে না তার দল।

তিনি আরও বলেন, নির্বাচনি সমঝোতার বিষয়ে তেমন কিছু ভাবছি না। ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে নির্বাচনি সমঝোতার বিষয়ে আমাদের একাধিক বৈঠক ও কথাবার্তা হয়েছে। তবে জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনি সমঝোতার বিষয়ে এখনো কোনো অফিসিয়াল আলোচনা আমরা করিনি। জামায়াত এবং আমাদের চিন্তা ও দর্শনের পার্থক্যটা বিরাট।

ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি সাখাওয়াত হোসেন রাজী বলেন, মাঠপর্যায়ে জামায়াতের ব্যাপারে আলেমদের নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। ইসলামী ঐক্যজোট সবসময় আলেমদের নিয়েই চলে। আলেমদের মতামতের বাইরে আমরা যাব না। তা ছাড়া জোটগত নির্বাচনের বিষয়ে আমরা দলীয় কোনো সিদ্ধান্ত এখনো নিইনি। বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী বলেন, রাজনৈতিকভাবে জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলেও জোট ও ভোট নিয়ে তারা কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে রয়েছেন। এ লক্ষ্যে তারা একাধিকবার কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক বিভিন্ন ইসলামি দলের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন। তারা ইসলামপন্থিদের ভোট ‘এক বাক্সে’ আনার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তবে জামায়াতের সঙ্গে জোটের ব্যাপারে এখনো তেমন আগ্রহ সৃষ্টি হয়নি।

বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মুহাম্মদ আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, সবসময় ইসলামি শক্তির ঐক্য চাই। তবে জামায়াতের সঙ্গে ঐক্যের বিষয়ে এখনো আমাদের দলীয় কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। দেশের শীর্ষ আলেমদের তত্ত্বাবধানে আমরা সংগঠন পরিচালনা করি, তাদের মতামতের বাইরে গিয়ে আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নেব না। খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির মাওলানা আহমদ আলী কাসেমী বলেন, জামায়াতের সঙ্গে আমরা জোটে যাচ্ছি, এ কথা বলতে চাই না। তবে আমরা ইসলামি শক্তির ঐক্য চাই। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে আমরা যারা একসঙ্গে ছিলাম, সবাই মিলে দেশ গড়তে চাই। বিরোধী শক্তির একটি মজবুত প্ল্যাটফর্ম থাকলে রাজনীতিতে ভারসাম্য আসবে।