ঢাকা সোমবার, ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

রাজবাড়িতে দরবারে হামলা জামায়াত-বিএনপি নেতাদের উসকানিতে

রাজবাড়ী প্রতিনিধি
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৭, ২০২৫, ১১:৪৩ পিএম
নুরাল পাগলার দরবারে হামলা

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে নুরাল পাগলার মাজারে গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর ঈমান-আকিদা রক্ষা কমিটির পূর্বঘোষিত বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে হামলায় একজন নিহত ও অর্ধশত ব্যক্তি আহত হন। এ হামলার নেপথ্যে রয়েছে উপজেলা জামায়াত ও বিএনপি নেতাদের উসকানি।  

গত শুক্রবার ৫ সেপ্টেম্বর জুমার নামাজের পর ‘ঈমান আকিদা রক্ষা কমিটি’র ব্যানারে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ফকীর মহিউদ্দিন আনসার ক্লাবে বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়। বিক্ষোভ সভায় বক্তব্য শেষে বিক্ষুব্ধ জনতা দরবারের দিকে যেতে চাইলে স্থানীয় প্রশাসন ও থানা পুলিশ তাদের ঠেকানোর চেষ্টা করে। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতা গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সরকারি গাড়ি, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও গোয়ালন্দ ঘাট থানার ওসির গাড়ি ভাঙচুর করে। সেইসঙ্গে পাঁচ পুলিশ সদস্য ও স্থানীয় প্রশাসনের দুজনকে পিটিয়ে ও ঢিল ছুড়ে আহত করে। এরপর বিক্ষুব্ধ জনতা নুরাল পাগলার বাড়ি ও দরবারের গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে ভবন ও দরবার শরিফ ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। একপর্যায়ে তৌহিদী জনতা নুরুল হক ওরফে নুরাল পাগলার লাশ কবর থেকে তুলে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পদ্মার মোড় এলাকায় নিয়ে পুড়িয়ে দেয়।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নুরাল পাগলাকে মাটি থেকে কয়েক ফুট উঁচুতে বেদি তৈরি করে দাফন করা হয়েছে দাবি করে গত মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টায় সংবাদ সম্মেলন করেছিল উপজেলা ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি। সেইসঙ্গে বিক্ষোভের ঘোষণা দিয়েছিল। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন উপজেলা ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটির সভাপতি মাওলানা জালাল উদ্দিন প্রামাণিক। তিনি গোয়ালন্দ পৌর জামায়াতের আমির। এ কমিটির সদস্যসচিব উপজেলা বিএনপির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আইয়ুব আলী খান। এ ছাড়া কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন খন্দকার আবদুল মুহিত, গোয়ালন্দ পৌর বিএনপির সভাপতি আবুল কাশেম ম-ল, সাংগঠনিক সম্পাদক আমজাদ হোসেন, সাইদুল সরদার, সাবেক অধ্যক্ষ খন্দকার আব্দুল মুহিত, প্রিন্সিপাল আমিনুল ইসলাম কাসেমীসহ বিএনপি এবং জামায়াতের নেতারা।

ওইদিন সংবাদ সম্মেলনে জালাল উদ্দিন প্রামাণিক বলেছিলেন, নিজেকে ইমাম মাহদি দাবি করায় তীব্র আন্দোলনের মুখে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন নুরুল হক। দীর্ঘদিন পর আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে তাকে পুনর্বাসন করেছে একটি কুচক্রী মহল। গত ২৩ আগস্ট তার মৃত্যুর পর ব্যাপারটা ঘনীভূত হয়। মৃত্যুর আগে নুরুল ১২ ফুট উঁচু বেদি তৈরি করেন। সেই বেদির ওপর তাকে কবর দেওয়া হয় এবং পবিত্র কাবার আদলে রং করা হয়। এতে ধর্মপ্রাণ মুসলমান বিক্ষুব্ধ হন। উত্তেজনা প্রশমনে প্রশাসন তাদের সঙ্গে একাধিকবার আলোচনায় বসেছে। আলোচনায় প্রথমে নুরুলের পরিবার এক সপ্তাহ সময় নিলেও এ ব্যাপারে অগ্রগতি নেই। তারা তাদের সিদ্ধান্তে অনড়।

রাজবাড়ী জেলা ইমাম কমিটির সভাপতি ইলিয়াস মোল্লা বলেছিলেন, আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে নুরুল হকের কবর সমান না করা হয় এবং অন্যান্য দাবিদাওয়া পূরণ না হয়, তাহলে এর দায়িত্ব কে নেবে? প্রশাসন আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যেই এর সমাধান করবে বলে তাদের বিশ্বাস। অন্যথায় শুক্রবার জুমার নামাজের পর গোয়ালন্দ আনসার ক্লাব মাঠে বিক্ষোভ সমাবেশ ও পরে ‘মার্চ ফর গোয়ালন্দ’ কর্মসূচি পালন করা হবে।

একই সংবাদ সম্মেলনে উপজেলা ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটির সদস্যসচিব ও উপজেলা বিএনপির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আইয়ুব আলী খান বলেছিলেন, নুরুল পাগলার কবর নিচু না করা পর্যন্ত আন্দোলন চলতেই থাকবে। এটিকে ঠেকাতে যারা কাজ করবে, তাদের বিরুদ্ধেও আন্দোলন করা হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গোয়ালন্দ পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডে নিজ বাড়িতে দরবার শরিফ গড়ে তোলেন নুরুল হক। আশির দশকের শেষদিকে নিজেকে ইমাম মাহদি দাবি করলে জনরোষ তৈরি হয়। পরে ১৯৯৩ সালের ২৩ মার্চ মুচলেকা দিয়ে এলাকা ছাড়েন। কয়েকদিন পর আবার দরবারে ফিরে কার্যক্রম শুরু করেন। গত ২৩ আগস্ট ভোরে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় মৃত্যু হয়। ওইদিন রাতে দরবারে এলাকাবাসীর অংশগ্রহণে প্রথম জানাজা ও ভক্তদের অংশগ্রহণে দ্বিতীয় জানাজা শেষে রাত সাড়ে ১০টার দিকে মাটি থেকে কয়েক ফুট উঁচুতে বিশেষ কায়দায় তাকে দাফন করা হয়। এরপর বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ হন স্থানীয় লোকজন। তাদের আন্দোলনের মুখে ইতিমধ্যে কবরের রং পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে কবর নিচে নামানো হয়নি।

এদিকে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, শুক্রবার জুমার নামাজের পর আনসার ক্লাব চত্বরে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে উপজেলা ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি। বেলা ২টার পর থেকে আনসার ক্লাবে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে জড়ো হতে থাকেন শত শত মানুষ। বেলা আড়াইটার দিকে হাতুড়ি, শাবল ও লাঠিসোটা নিয়ে একদল লোক মিছিল নিয়ে আসে। এ সময় আয়োজকদের পক্ষ থেকে লাঠিসোটা, হাতুড়ি মঞ্চে জমা দিতে বলা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলে উত্তেজনা দেখা দেয়। একপর্যায়ে মঞ্চে বক্তব্য চলাকালে কিছু লোক পুলিশের ওপর হামলা করে দুটি গাড়ি এবং ইউএনওর গাড়ি ভাঙচুর করেন। এ সময় পুলিশের ছয় সদস্য আহত হন।

বিকেল ৩টার দিকে মঞ্চ থেকে ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক মাওলানা জালাল উদ্দিন প্রামাণিক, সদস্যসচিব বিএনপি নেতা আইয়ুব আলী খান সবাইকে সমাবেশে থাকার আহ্বান জানান। কিন্তু উত্তেজিত লোকজন মিছিল নিয়ে নুরাল পাগলার দরবারে হামলা করেন। ভেতর থেকে প্রতিরোধের চেষ্টা করেন নুরাল পাগলার ভক্তরা। এ সময় ইটপাটকেল নিক্ষেপসহ সংঘর্ষে দুই পক্ষের অন্তত অর্ধশত ব্যক্তি আহত হন। এ সময় কিছু লোক দরবারের দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে আগুন ধরিয়ে দেন এবং মালামাল লুটপাট করেন। একপর্যায়ে বিকেল ৫টার দিকে নুরাল পাগলার লাশ কবর থেকে তুলে গোয়ালন্দ পদ্মার মোড়ে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ওপর নিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। 

ওইদিন সন্ধ্যায় স্থানীয় একটি মাদ্রাসা মাঠে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে ইমান-আকিদা রক্ষা কমিটি। সম্মেলনে নেতারা বলেন, প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে তারা শহরের আনসার ক্লাব মাঠে শুধু বিক্ষোভ সমাবেশ করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যে দোয়া-মোনাজাতের মধ্য দিয়ে সমাবেশ শেষ করেন। কিন্তু সমাবেশে আসার পথে পুলিশ বাধা দিলে পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বিক্ষুব্ধ জনতা সংঘবদ্ধ হয়ে নুরাল পাগলার বাড়িতে গিয়ে হামলা চালান। এই সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন জালাল উদ্দিন প্রামাণিক, বিএনপি নেতা আইয়ুব আলী খান, আবুল কাশেম, সাবেক অধ্যক্ষ খন্দকার আব্দুল মুহিত প্রমুখ। 

তবে সেদিন সমাবেশে আসার পথে লোকজনকে বাধা দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন গোয়ালন্দ ঘাট থানার ওসি রাকিবুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে কাউকে বাধা দেওয়া হয়নি।’

এদিকে পুলিশের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় গোয়ালন্দ ঘাট থানায় মামলা হয়েছে। গত শুক্রবার রাতে থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সেলিম মোল্লা বাদী হয়ে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার জনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করেন। এ মামলায় গত শনিবার রাতে ৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গতকাল রোববার আদালতে একজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছে। এ ছাড়া চারজনের বিরুদ্ধে রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে।

গ্রেপ্তাররা হলেনÑ দেওয়ানপাড়া গ্রামের আফজাল সরদারের ছেলে শাফিন সরদার (১৮), উজানচর ইউনিয়নের দিরাজতুল্লা মৃধাপাড়ার মৃত আক্কাস মৃধার ছেলে ও উজানচর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের (নিষিদ্ধ ঘোষিত) সহসভাপতি মাসুদ মৃধা, বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের লাল মিয়া মৃধার ছেলে ও উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক হিরু মৃধা, দেওয়ানপাড়া গ্রামের মো. জহির উদ্দিনের ছেলে এনামুল হক জনি (৩২), কাজীপাড়া গ্রামের কাজি আরিফের ছেলে কাজী অপু (২৫), উজানচর মৃধাপাড়া গ্রামের মোকলেসুর রহমানের ছেলে হায়াত আলী (২৯) এবং গোয়ালন্দেও নতুন পাড়া মোল্লা পট্টির মো. শওকত সরদারের ছেলে মো. জীবন সরদার (২২)।