ডাকসু নির্বাচনের দিন সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছিল টানটান উত্তেজনা। দিনভর বিভিন্ন প্রার্থী একে অপরের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনসহ পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তোলেন। তবে কোনো ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা না ঘটলেও উত্তেজনা কম ছিল না। বেলা ৩টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনের সামনে ডাকসুতে শিবিরের ভিপি পদপ্রার্থী সাদিক কায়েমকে লক্ষ্য করে ছাত্রদলের সমর্থক ও নেতা-কর্মীরা ‘রাজাকার’ স্লোগান দেন। এ সময় বলতে শোনা যায়, ‘রাজাকার আর স্বৈরাচার, মিলেমিশে একাকার’। এ ছাড়া বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে ডাকসু নির্বাচন-সংক্রান্ত একটি মিটিং চলাকালে সেখানে আকস্মিকভাবে প্রবেশ করেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। পরে তারা ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খানের মুখোমুখি হন। এ সময় তারা বর্তমান প্রশাসনকে ‘জামায়াতি প্রশাসন’ আখ্যা দিয়ে স্লোগান দিতে শুরু করলে সভাকক্ষে হট্টগোল ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।
দিনভর আচরণবিধি নিয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তুললেও ভোটগ্রহণ শেষে শিবিরের বিরুদ্ধে ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলেছে ছাত্রদল। দলটির ভিপি পদপ্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্বাচন আয়োজনে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। অমর একুশে হলে গিয়েছি, সেখানে কারচুপির প্রমাণ পেয়েছি। রোকেয়া হলেও কথা বলেছি। তারা বলেছেন, কারচুপি হয়েছে। এটা কোনোভাবেই আশা করিনি।’ ভোটের ফলাফল ব্যাহত করা হলে প্রতিরোধ করা হবে বলেও জানান তিনি।
ভোটগ্রহণ শেষে মধুর ক্যান্টিনে আয়োজিত এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে আবিদুল বলেন, ‘আমরা যখন বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে গিয়েছি, আমাদের এতিমের মতো দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। আমাদের সময় নষ্ট করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, রোকেয়া হলের এক ছাত্রী ভোটকেন্দ্র থেকে বের হয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ করেন, ‘ভাই, আমাদের যে ব্যালট পেপার দেওয়া হয়েছে, তাতে আগে থেকেই সাদিক কায়েম এবং এস এম ফরহাদের নামে ক্রস চিহ্ন দেওয়া ছিল।’ এটা শুধু রোকেয়া হলের ক্ষেত্রেই হয়নি, এমন ঘটনা অমর একুশে হলের ভোটকেন্দ্রেও ঘটেছে। পরে আমি যখন কেন্দ্রের চিফ রিটার্নিং কর্মকর্তার অনুমতি নিয়ে অনুসন্ধান করতে গেলাম, তখন তারা জানালেন যে এটা কীভাবে হয়েছে তারা জানেন না। সুতরাং, দুটি কেন্দ্রে যেহেতু প্রমাণ পেয়েছি, সেহেতু অন্য জায়গায়ও এমন ঘটনা ঘটতে পারে। আমরা জানি না কত ব্যালটে এমন করা হয়েছে, আমরা এখনো নিশ্চিত হতে পারিনি।
তবে ছাত্রদলের এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে ছাত্রশিবির। দলটির জিএস পদপ্রার্থী এস এম ফরহাদ পাল্টা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ছাত্রদল নিজেদের অনিয়মের দায় শিবিরের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছে। আর ভিপি পদপ্রার্থী সাদিক কায়েম বলেন, যারা বিশ্ববিদ্যালয় অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করবে, তাদের পরিণতি হাসিনার মতো হবে। ডাকসু নির্বাচন আমাদের জুলাই আকাক্সক্ষার মৌলিক ইস্যু। এই নির্বাচন যারা বানচালের চেষ্টা করবে, শিক্ষার্থীরা তাদের ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দেবে হুঁশিয়ারি দিয়ে আরও বলেন, ‘এখানে জয়-পরাজয়ের কিছু নেই, শিক্ষার্থীদের রায় মেনে নেব।’
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের জিএস পদপ্রার্থী আবু বাকের মজুমদার বলেন, ‘দুই পক্ষই (বিএনপি-জামায়াত) ক্যাম্পাসের আশপাশে লোকবল জড়ো করছে। ডাকসুতে ভাগবাঁটোয়ারার পাঁয়তারা করতেছে। ছাত্রদল পেশিশক্তির মহড়া দিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে হুমকি দিচ্ছে ফলাফল প্রভাবিত করার জন্য। আমরা মাঠে আছি।’
এ ছাড়া সন্ধ্যায় ঢাকসু নির্বাচনে ভোট চুরির অভিযোগ তুলে ভিপি পদপ্রার্থী আবিদুল ইসলাম আবিদের নেতৃত্বে বিক্ষোভ মিছিল করেছে ছাত্রদল। এ সময় তারা জামায়াত-শিবির রাজাকার’, ‘নির্বাচনে কারচুপি, মানি না মানব না’, ‘ভোট চোর ভোট চোর, জামায়াত-শিবির ভোট চোর’, ‘প্রশাসন ভোট চোর’ বলে স্লোগান দিতে থাকে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) ব্যাপক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে।
সন্ধ্যার পর থেকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে উত্তেজনা আরও বাড়তে থাকায় ফলাফল প্রকাশের জন্য বিশ^বিদ্যালয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংখ্যা বাড়ানো হয়। একই সঙ্গে গোয়োন্দা নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে। বিশ^বিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রবেশপথেও জড়ো হন বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা।
এর আগে আমর একুশে হলে ভোটগ্রহণের সময় এক ভোটারকে একসঙ্গে দুটি ব্যালট পেপার দেওয়া হয়। এই অনিয়ম চোখে পড়তেই বিষয়টি নিয়ে হইচই শুরু হয়। পরে নির্বাচন কর্তৃপক্ষ দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে সংশ্লিষ্ট পোলিং কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়। এ ঘটনা ভোটের স্বচ্ছতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তোলে এবং সামাজিক মাধ্যমে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রের বাইরে আচরণবিধি লঙ্ঘনের একাধিক অভিযোগ ওঠে। ভোটগ্রহণের সময় কেন্দ্রের আশপাশে প্রার্থীদের সমর্থকদের প্রচারণা চালাতে দেখা যায়, কেউ কেউ ভোটারদের কাছে প্রচার স্লিপ বিতরণ করছিলেন। নির্বাচন আইন অনুযায়ী ভোটকেন্দ্রের ১০০ গজের মধ্যে প্রচার নিষিদ্ধ হলেও অনেক জায়গায় এ নিয়ম মানা হয়নি। এ ধরনের কর্মকা-ের ছবি ও ভিডিও ক্যাম্পাস-জুড়ে এবং সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
দুপুরের দিকে এফ রহমান হলে ভোটকেন্দ্রের আশপাশে হঠাৎ করে উত্তেজনা দেখা দেয়। কয়েকজন সমর্থকের মধ্যে তর্কাতর্কি থেকে পরিস্থিতি দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। উভয় পক্ষের সমর্থকেরা স্লোগান দিতে শুরু করলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকায়ও। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ ও প্রক্টরিয়াল টিম এগিয়ে আসে এবং উভয় পক্ষকে সরিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করে। যদিও এ ঘটনা স্বল্প সময়ের জন্য হলেও ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করে।
আরেকটি আলোচিত ঘটনা ঘটে সহকারী প্রক্টর ও ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন নাসিরের মধ্যে। ভোটের পরিবেশ নিয়ে কথা বলার একপর্যায়ে তাদের মধ্যে তর্ক শুরু হয়। ঘটনাস্থলে থাকা অন্যরা এসে পরিস্থিতি সামাল দেন, তবে এই মুহূর্তও সংবাদকর্মী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের নজর এড়ায়নি। পরে এ ঘটনাও ক্যাম্পাসে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে।
ভোটে অনিয়মের অভিযোগ করেছেন বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ প্যানেলের ভিপি পদপ্রার্থী আবদুল কাদেরও। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মূলত নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। এত ষড়যন্ত্রের পরেও শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিতে এসেছেন। কিন্তু তাদের সঙ্গে তামাশা করা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন সব সময়ই একটি গোষ্ঠীর স্বার্থে কাজ করছে।’
কাদের আরও বলেন, ‘ভোটকেন্দ্রের ভেতরে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা সরাসরি ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন। বিএনপি সমর্থিত ভিপি পদপ্রার্থী আবিদুল কেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশ করে ভোট প্রার্থনা করেছেন। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ করলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’
ভোটগ্রহণ শেষে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে ডাকসু নির্বাচনসংক্রান্ত একটি মিটিং চলাকালে সেখানে আকস্মিকভাবে প্রবেশ করেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। পরে তারা ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খানের মুখোমুখি হন। এ সময় তারা বর্তমান প্রশাসনকে ‘জামায়াতি প্রশাসন’ আখ্যা দিয়ে স্লোগান দিতে শুরু করলে সভাকক্ষে হট্টগোল ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।
ছাত্রদলের অভিযোগ, ডাকসু নির্বাচন ঘিরে ক্যাম্পাসের আশপাশে বহিরাগত জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের জড়ো করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের নেতাকর্মীরা। উপাচার্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানালেও তারা তা মানতে রাজি হননি।
একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস টেবিল চাপড়ে উপাচার্যকে ‘জামায়াতি প্রশাসন’ বলে আখ্যায়িত করেন। জবাবে উপাচার্য তিনি কোনো দলের নন এবং কখনো রাজনীতি করেননি বলে দাবি করেন।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব উপাচার্যকে বলেন, আজকের পর আনুষ্ঠানিকভাবে আপনাকে ‘জামায়াতি প্রশাসন’ হিসেবে আখ্যা দিলাম। যদি আপনি এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেন, তাহলে আমরা আর আপনাকে কোনো সহযোগিতা করব না।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন