ঢাকা শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

রাজধানীর সরকারি হাসপাতাল 

দালাল থাকাটাই যেন হালাল!

স্বপ্না চক্রবর্তী
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১২, ২০২৫, ১১:০৮ পিএম
  • অঘোষিত নেটওয়ার্কে সক্রিয় সব সময়
  • রোগীদের বিভ্রান্ত করে বেসরকারি হাসপাতালে পাঠানোই লক্ষ্য
  • বাইরে থেকে নিয়ে আসা হয় প্যাথোলজিস্টও 
  • বারবার অভিযানেও হয় না স্থায়ী সমাধান 
  • দালালদের দৌরাত্ম্যে নাভিশ^াস রোগীদের
  • দালালেরা গ্রেপ্তার হলেও ছাড়া পান দ্রুতই
  • চিকিৎসকেরাও রোগীদের বাইরে থেকে প্রয়োজনীয় পরীক্ষার জন্য বলেন

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব সরকারি হাসপাতালে রোগীর সেবার পাশাপাশি সক্রিয় এক ‘অঘোষিত নেটওয়ার্ক’Ñ দালাল চক্র। এরা মূলত রোগী ও স্বজনদের বিভ্রান্ত করে প্রাইভেট ক্লিনিক বা নির্দিষ্ট ডাক্তারদের চেম্বারে পাঠান। কখনো সরকারি সেবার প্রাপ্যতা গোপন করেন, আবার কখনো হাসপাতালের ভেতরের অসাধু কর্মচারীর সঙ্গে যোগসাজশে হাতিয়ে নেন অর্থ। নানান সংকটে জর্জরিত দেশের সরকারি হাসপাতালগুলো সীমিত সাধ্যের মধ্যেও রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা দিতে তৎপর থাকে। কিন্তু এসব প্রতষ্ঠানে সেবা নিতে আসা রোগীরা যেন জিম্মি এই দালাল চক্রের হাতে। গ্রাম থেকে আসা সহজ-সরল রোগীদের বাগিয়ে নির্ধারিত বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াই এসব দালালের প্রধান কাজ। এমনকি বাইরে থেকে প্যাথোলজিস্ট এনে রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজেও ওস্তাদ তারা। এতে করে রাজধানীর প্রায় সব সরকারি হাসপাতালেই চিকিৎসা নিতে আসা সাধারণ রোগীদের পোহাতে হয় চরম দুর্ভোগ।

হাসপাতালের গেট, জরুরি বিভাগ, বহির্বিভাগে দালালেরা অবস্থান করেন দিনভর। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা বা পরীক্ষা হবে নাÑ এমন ভয় দেখিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে রোগী বাগিয়ে নেওয়াই তাদের কাজ। কমিশনের ভিত্তিতে এসব দালালের সঙ্গে সরাসরি যোগসাজশ থাকে অনেক ক্ষেত্রে নিরাপত্তাকর্মী, ওয়ার্ডবয়, আয়া কিংবা অফিস সহকারীর। এদের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি প্রতারিত হয় গরিব ও লেখাপড়া কম জানা রোগীরা। সরকারি হাসপাতালে ফ্রি বা কম খরচের সেবা প্রাইভেট সেন্টারে কয়েক গুণ খরচে নিতে বাধ্য হয় তারা। এতে করে প্রকৃত চিকিৎসা বিলম্বিত হয়, অনেক ক্ষেত্রে ভুল চিকিৎসারও শিকার হতে হয় অনেককে। 

হাসপাতালের সরেজমিন চিত্র

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গেট ও জরুরি বিভাগে দীর্ঘদিন ধরেই দালালদের প্রভাব নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ রয়েছে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল (পঙ্গু হাসপাতাল) ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একাধিকবার অভিযান চালিয়ে দালালচক্রের সদস্যদের আটক করলেও কয়েক দিন পরেই তারা আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে। সম্প্রতি রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), সেনাবাহিনী ও পুলিশের অভিযানে পাঁচ নারীসহ ২২ দালাল গ্রেপ্তার হন। পরে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তাদের কারাগারে পাঠানো হলেও পরক্ষণেই ছাড়া পেয়ে যান তারা। 

হাসপাতালটিতে গিয়ে দেখা যায়, জরুরি বিভাগে রক্ত দিতে এসেছেন এক যুবক। এক দালাল তাকে টাকার বিনিময়ে রক্ত দিতে নিয়ে এসেছেন জানিয়ে ওই যুবক বলেন, ‘আমি একটি ফার্মেসিতে চাকরি করি। এখানে রক্ত দিতে এসেছি। ঠিক তখনই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের তাকে আটক করতে দেখা যায়।’ কেন তাকে আটক করেছেন জানতে চাইলে এক পুলিশ সদস্য জানান, সে এখানে আসা রোগীদের জিম্মি করে রক্ত বাণিজ্য করে। টাকার বিনিময়ে রক্তদাতা এনে দেয়। শুধু এই যুবক নয়, এদিন হাসপাতালটির জরুরি বিভাগ-বহির্বিভাগ থেকে আটক করা হয় সুমাইয়া আক্তার, আজাদ শেখ, আজিজুর মুন্সি, আবুল বাসার, আশিক আহম্মেদ, ইলিয়াস, ওহিদুজ্জামান, জীবন ইসলাম, তরিকুল ইসলাম, মোসা. ফারজানাসহ ২২ জনকে। তাদের প্রায় সবার বিরুদ্ধে অভিযোগ হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে নেওয়ার। তবে কেউ কেউ রোগীদের প্রভাবিত করে বিনা মূল্যের ওষুধ না কিনে পাশের ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে বাধ্য করেন। কেউ আবার হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করিয়ে অন্য বেসরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য রোগীদের নিয়ে যান।

শাস্তি মাত্র ১৫ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড 

এসব অভিযোগে যৌথ বাহিনীর অভিযানে ৩২ সন্দেহভাজনকে আটক করা হয়। পরে যাচাই-বাছাই শেষে ২২ জনের বিরুদ্ধে দালালির স্পষ্ট প্রমাণ মেলায় তাদের ১৫ দিনের বিনাশ্রম কারাদ- দেওয়া হয়। তাদের আটকের বিষয়ে ডিএমপির স্পেশাল মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মহিদুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘হাসপাতালটিতে অনেক দিন ধরেই দালালদের দৌরাত্ম্য চলছিল। তারা মূলত স্থানীয় হওয়ায় কেউ সহজে মুখ খুলতে সাহস করত না। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে তথ্য পেয়ে আমরা আজ অভিযান চালিয়ে এদের আটক করেছি। এমন অভিযান নিয়মিতভাবে চলবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা নিয়মিত অভিযান চালাই। কিন্তু কিছুদিন পরেই আবার তারা সক্রিয় হয়ে ওঠে। এর জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কঠোর হওয়া এবং নজরদারি বাড়ানোর বিকল্প নেই।’

আটকের পরও ঔদ্ধত্য আচরণ

হাতেনাতে আটক করার পরও তাদের ঔদ্ধত্য আচরণ ছিল লক্ষণীয়। এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় আটক আশিক আহম্মেদ বলেন, ‘আমাদের আটক করেছে তো কী হয়েছে। ১৫ দিনেরই তো ব্যাপার। তারপর দেখা যাবে।’ একই রকম ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ দেখা যায় আরও অনেকের মধ্যেই।

এ সময় আটক এক দালাল জানান, তার বাসা পাশের একটি বস্তিতে। কোনো কাজ করেন না তিনি। হাসপাতালে এসে রোগীদের সেবা পাইয়ে দিতে আয় করার পথ বেছে নিয়েছেন। তার বিবরণ থেকে জানা যায়, অনেক রোগী ঢাকার বাইরে থেকে আসে। তারা হাসপাতালের কোন ভবনে, কোথায় কী করতে হবে, ভর্তির প্রক্রিয়া, ল্যাবে পরীক্ষার কাজ করতে পারে না। অথবা চিকিৎসকের রুমেও বিড়ম্বনায় পড়ে। কিন্তু তিনি কাজটি স্বাভাবিকভাবে করে দিয়ে কিছু টাকা নেন। এর মাধ্যমে তার সংসার চলে। আর হাসপাতালের বিভিন্ন স্তরের সঙ্গে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন তিনি। ফলে রোগীর চিকিৎসাসেবায় হয়রানি কম হয় বলে এই দালালের দাবি।

কোথায় কত টাকা দিতে হয়

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় প্রতিটি হাসপাতালে রোগী ভর্তি ও পরীক্ষার দায়িত্ব নেন হাসপাতালের একজন কর্মচারী। বিনিময়ে তাকে দিতে হয় ৪০০ টাকা। আরও বেশি টাকা দিলে এক্স-রে, সিটি স্ক্যানসহ যেকোনো পরীক্ষা করা যায় লাইনে না দাঁড়িয়েই। সিরিয়ালে ন্যূনতম ২০ জন রোগী থাকলেও নিজের রোগীকে নিয়ে দাল লেরা সরাসরি চলে যান নির্দিষ্ট রুমে। সেখানে সব প্রক্রিয়া শেষ করে দেন। অবশ্য এর জন্য এ ক্ষেত্রে পরীক্ষা যারা করেন, সেই রুম-সংশ্লিষ্টদের আরও ১০০ টাকা দিতে হয়। এভাবে দালালদের মাধ্যমে যেসব রোগী ভেতরে আসে, তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা দিতে দিতে ফতুর হতে হচ্ছে সাধারণ রোগীদের।

ভুক্তভোগীদের বক্তব্য

হাসপাতালে কথা হয় এই রোগীর স্বজন নাজমুল হুদার সঙ্গে। তিনি বলেন, আগে থেকে তিনি শুনেছেন সরকারি হাসপাতালে সেবা নিতে গেলে পদে পদে হয়রানি। এখানে দালালদের দৌরাত্ম্য। তার ছোট বোনের বাচ্চা প্রসব হবে। একটা আলট্রাসনোগ্রাম করাতে হবে। নির্দিষ্ট ডাক্তারের টোকেন নিয়ে ঘুরছেন এখানে-সেখানে। এমনকি গিয়েছিলেন হাসপাতালটির পরিচালক ডা. মেজবাউর রহমানের রুমের সামনেও। কিন্তু সিকিউরিটি গার্ডরা তাকে ঢুকতেই দেননি। তাই বাধ্য হয়ে ৫০০ টাকায় একজন দালালকে ম্যানেজ করেছেন। তার প্রশ্ন, গর্ভবতী বোনকে নিয়ে আর কত ছোটা যায় বলেন?  

সম্প্রতি রাজধানীর জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চোখের ছানি অপারেশন করাতে কুমিল্লা থেকে আসেন চম্পক রায় ও তার পরিবারের সদস্যরা। এক সপ্তাহ আগে প্রাথমিকভাবে এখানে চোখ দেখিয়ে গেলেও এবার অপারেশন করাবেন এমন প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন। কিন্তু সকালে হাসপাতালের গেটে এসে দাঁড়াতেই জব্বার নামের এক লোক নিজেকে একটি ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেনটিটিভ পরিচয় দিয়ে বললেন, এখানে অপারেশনের তারিখ পেতে তো আপনাদের এক মাসেরও বেশি সময় লাগবে। চলেন আমি আপনাদের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। ওখানে এখন ভর্তি হলে বিকেলেই আপনার অপারেশন হয়ে যাবে। এমনকি কালকে বাড়িও চলে যেতে পারবেন। খামোখা এই হাসপাতালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় বসে থেকে কী করবেন? ওই বেসরকারি হাসপাতালে অপারেশন করাতে কত টাকা লাগবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ নিয়ে আপনাদের কোনো চিন্তা করতে হবে না। আমার পরিচিত তো, অন্তত ২০ শতাংশ কমাতে পারব আপনাদের জন্য। কিংকর্তব্যবিমূঢ় চম্পক রায়ের পরিবার তখন দিশেহারা অবস্থায় এদিক-সেদিক তাকাতে লাগলেন।

ঠিক এরকমই দিশেহারা অবস্থায় রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে বাড়ি যাওয়ার অপেক্ষায় দিন গুনছেন নওগাঁ থেকে আসা শিপনের বাবা। একটি সড়ক দুর্ঘটনায় কোমরের হাড় ভেঙে গেলে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে নিয়ে এসেছিলেন বাবাকে ভর্তি করাতে। কিন্তু হাসপাতালের বারান্দায় অপেক্ষমাণ থাকার সময় এক দালালের খপ্পরে পড়ে এই বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন। পাঁচ দিনের চিকিৎসার জন্য দেড় লাখ টাকা বিল ধরিয়ে দেওয়ার পর দিশেহারা অবস্থা পার করছেন বাবা-ছেলে দুজনে। 

বেশি দুর্ভোগ ঢাকা মেডিকেলে

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল নানা দুর্ভোগের কারণে আলোচিত হলেও সারা দেশের হাজার হাজার রোগী এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসে। প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক গরিব ও স্বল্প আয়ের রোগী ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসে, যাদের অনেকের প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা এই হাসপাতালে করানো সম্ভব হয় না। 

এমনও অভিযোগ পাওয়া গেছে, খোদ চিকিৎসকেরাই এসব রোগীকে বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে আনেন। এতে রোগীর অতিরিক্ত অনেক অর্থ খরচ হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, হাসপাতালের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি নষ্ট থাকার সুযোগ নিচ্ছে আশাপাশের বেসরকারি ক্লিনিক হাসপাতালগুলো। বিভিন্ন ক্লিনিকের দালালেরা ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসারত রোগীদের টেস্টের স্যাম্পল সংগ্রহে একধরনের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, শুধু ঢামেক হাসপাতালেই বিভিন্ন ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিকের দেড় শতাধিক দালাল সকাল-সন্ধ্যা অফিস ডিউটির মতোই উপস্থিত থাকেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। 

এমনই একটি বেসরকারি হাসপাতালের প্রতিনিধি উজ্জ্বলের (ছদ্মনাম) কাছে রোগীপ্রতি কত টাকা কমিশন পান জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই হিসাবটা জটিল। যদি অপারেশনের রোগী হয়, মোট খরচের ১০ ভাগ পাই। শুধু চিকিৎসা নিলে ৫ শতাংশ টাকা দেয়।’ অসহায় গরিব রোগীদের ঠকাতে খারাপ লাগে নাÑ এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি যে কাজ করি, এটা দিয়ে তিনটা পরিবারের উপকার হয়। এক নম্বরে যার উপকার হয় সে হচ্ছে রোগী। ঢাকা মেডিকেলের যে পরিবেশ আর রোগীর চাপ, একটা অপারেশন করাতে মাসের পর মাস হাসপাতালে কাটাতে হয়। আর বেসরকারি হাসপাতালে সকালে ভর্তি করালে বিকেলে অপারেশন। রোগীর তো আর বাড়তি কোনো খরচ নেই। এতে করে রোগীর যেমন উপকার হচ্ছে, তেমনি করে কমিশনের টাকা দিয়ে আমার সংসারের খরচও জোগাড় হচ্ছে। পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালগুলোরও উপকার হচ্ছে। এতে কোনো ভুল দেখছি না কারো।’

তবে যদি সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘আমরা নিয়মিতই এসব দালালের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করি। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এ ব্যাপারে তৎপর। কিন্তু এতসবের পরেও ভবিষ্যতে যদি এমনটা ঘটে এবং আমরা সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পাই, অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’ 

পঙ্গু হাসপাতালের চিত্র

রাজধানীসহ দেশের প্রায় সব জায়গার দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হওয়া রোগীরা আসে জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন সেন্টার তথা পঙ্গু হাসপাতালে। হাসপাতালটিতে রোগীর পরিমাণ এত বেশি যে, একটি অপারেশনের জন্য অপেক্ষা করতে হয় মাসের পর মাস। বাধ্য হয়ে রোগীরা নিজেই দালালদের দ্বারস্থ হয়। আর দালালেরাও খুশিমনে পাশর্^বর্তী বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে বাগিয়ে নেন রোগী। যেসব বেসরকারি হাসপাতালের আবার অধিকাংশেরই নেই অনুমোদন। বাবর রোড, খিলজি রোড, টিবি হাসপাতাল রোড ঘিরে এসব হাসপাতালের রমরমা ব্যবসা চালাচ্ছেন তারা। আশিকুর রহমান নামের এক দালাল বলেন, ‘আমাদের দোষ কী বলেন? পঙ্গু হাসপাতালে আসা রোগীরাই আমাদের খুঁজে বের করে দ্রুততম সময়ে সঠিক চিকিৎসা পাওয়ার আশায়। আমাদের দোষ দেখেন শুধু আপনারা। রোগীর সেবা করছি যে, সেটা আর দেখেন না। কেউ বলেনও না।’ 

তবে এই দালালদের ব্যাপারে সম্প্রতি কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির পরিচালক মো. আবুল কেনান। রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘এই এলাকার আধা কিলোমিটার রাস্তায় অন্তত দেড়শ বেসরকারি হাসপাতাল হয়েছে। এগুলোকে কেন্দ্র করেই দালালচক্র সক্রিয় রয়েছে। আমরা তাদের বিরুদ্ধে প্রায় প্রতিদিন অভিযান চালাচ্ছি। কাউকে কাউকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতেও তুলে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আইনের মারপ্যাঁচে তারা সহজেই বের হয়ে যান। এ ক্ষেত্রে আইনের সংশোধনও জরুরি।’

আরও কয়েকটি হাসপাতালের চিত্র

দালালের দৌরাত্ম্য কম নেই জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা শিশু হাসপাতাল, জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স, শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং জাতীয় বাতজ¦র ও হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রসহ এই এলাকায় সরকারি হাসপাতালগুলো ঘিরে দালালদের দৌরাত্ম্যের কথা স্বীকার করেছে খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা এসব এলাকায় নিয়মিতই অভিযান পরিচালনা করি। কিন্তু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অভিযান পরিচালনা করতে আমাদের সুবিধা হয়। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে বিদ্যমান অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমরা অভিযান পরিচালনা করি। এর পরও যদি দালালদের দৌরাত্ম্য থাকে, তাহলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেব।’