শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


আরিয়ান স্ট্যালিন

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১২, ২০২৫, ১১:১৯ পিএম

ক্ষুধা কিংবা গুলিতে মরব তবুও ফিলিস্তিন ছাড়ব না

আরিয়ান স্ট্যালিন

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১২, ২০২৫, ১১:১৯ পিএম

ক্ষুধা কিংবা গুলিতে মরব তবুও ফিলিস্তিন ছাড়ব না

  • ভয়াবহ ঝুঁঁকিতে ৯ লাখ ফিলিস্তিনি
  • দুর্ভিক্ষের ‘মারাত্মক ঝুঁঁকিতে’ গাজার ২১ লাখ বাসিন্দা: জাতিসংঘ
  • কমপক্ষে ৩ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ নিখোঁজ
  • ৫৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি এখন জীবন সংশয়ে আছেন।
  • দুর্ভিক্ষের তিন ধাপের দুই ধাপ অতিক্রম করেছে গাজা

‘তারা (ইসরায়েল) বলছে, দক্ষিণে চলে যাও। কিন্তু উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিমÑ কোথাও কেউ নিরাপদ নয়। আমরা এখানে থাকব।’ সংবাদমাধ্যম আলজাজিরাকে জানান গাজা শহরের বাসিন্দা উম্মে ইমরান নামে একজন ফিলিস্তিনি নারী। একই কথা বলেছেন তার মা উম্মে ইয়াসেরও, ‘আমরা গাজা সিটি ছাড়ব না। এখানে বাঁচব, এখানে মরব। এমনকি যদি আমরা সবাই মারা যাই। বাড়ি ধ্বংস করলেও আমরা যাব না।’

পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ স্থানগুলোর একটি গাজা। হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধের আগেও গাজাবাসীর জীবন কঠিন ছিল। ইসরায়েলি অবরোধ, হামাসের কঠোর শাসন, অর্থনৈতিক স্থবিরতার মধ্য দিয়ে বছরের বছর বছর কাটিয়ে এসেছেন গাজাবাসী। তবে এত প্রতিকূলতার মধ্যেও গাজাবাসী উপত্যকার ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে গর্ববোধ করে এসেছেন।

সামরিকভাবে গাজা সিটি দখলের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে ইসরায়েল। তা নিয়ে বাস্তুচ্যুত হওয়ার শঙ্কার মুখে পড়েছেন বাসিন্দারা। শহরটিতে নতুন করে উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এতে প্রাণ হারাতে পারেন আরও কয়েক হাজার ফিলিস্তিনি। তবুও গাজা সিটিতেই থাকার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করছেন বাসিন্দারা। 

গাজা সিটি দখল ও প্রায় ১০ লাখ ফিলিস্তিনিকে দক্ষিণের তথাকথিত ‘কনসেনট্রেশন জোনে’ সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে ইসরায়েলের নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা। তবে দখল ও বাস্তুচ্যুতির এই হুমকিকে উপেক্ষা করে শহরের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, তারা ঘরবাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবেন না। দুর্ভোগ, অনাহার ও মৃত্যুর আশঙ্কা সত্ত্বেও তাদের অঙ্গীকারÑ ‘আমরা এখানেই মরব।’

উপত্যকার সবচেয়ে বড় শহরটি নিয়ে ইসরায়েলের এই পরিকল্পনার খবরে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ভয় এবং প্রতিরোধের মনোভাব একসঙ্গে জেগে উঠেছে। তারা আশঙ্কা করছেন, এর ফলে আবারও নতুন করে বাস্তুচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর থেকে কমপক্ষে ৮ বার পরিবারসহ বাস্তুচ্যুত হওয়া আহমেদ হির্জ। তিনি বলেছেন, ‘আমি স্রষ্টার নামে শপথ করছি, আমি ১০০ বার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি। তাই আমার জন্য এখানেই মৃত্যুবরণ করা ভালো। আমি কখনো এখান থেকে যাব না। আমরা দুর্ভোগ, অনাহার, নির্যাতন ও করুণ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছি এবং আমাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো এখানেই মৃত্যুবরণ করা।’ 

গাজা সিটিতে বসবাসরত অন্যদেরও একই অনুভূতি। বাসিন্দা রজব খাদের বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই গাজায় আমাদের পরিবার এবং প্রিয়জনদের সঙ্গে থাকতে হবে। ইসরায়েলিরা আমাদের দেহ এবং আত্মা ছাড়া আর কিছুই পাবে না।’ 

গাজা সিটি থেকে আলজাজিরার সাংবাদিক হানি মাহমুদ জানিয়েছেন, ইসরায়েলের পরিকল্পিত জাতিগত নিধনের আশঙ্কায় বাসিন্দারা ‘আতঙ্কের মধ্যে’ আছেন। কেউ কেউ তাদের অবশিষ্ট সামান্য জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করেছেন, কোথায় যাবেন তা জানেন বলে নয়, বরং শেষ মুহূর্তে আটকা পড়া এড়াতে। তারা প্রস্তুত থাকতে চান, যখন ইসরায়েলি সেনারা জোর করে বের করে দেবে তার জন্য।

জাতিসংঘে ফিলিস্তিনি দূত রিয়াদ মানসুর বলেছেন, ‘কেবল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপই গাজায় ইসরায়েলের পূর্ণ সামরিক দখল রোধ করতে পারে। ইসরায়েলের বিতর্কিত উত্তেজনা বৃদ্ধির খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে দখলদার বাহিনী ক্ষুধায় দুর্বল হয়ে পড়া ফিলিস্তিনিদের ওপর আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে।’

৫২ বছর বয়সি আবু ফিরাস গাজার বাসিন্দা। তিনি এখন থাকছেন উপত্যকার উপকূল এলাকার একটি তাঁবুতে। তার বসতবাড়ি খান ইউনিসের পূর্বাঞ্চলে। ইসরায়েলি হামলায় তার বসতবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। যুদ্ধে তিনি ৮০ জন আত্মীয়-স্বজনকে হারিয়েছেন। বাড়িঘর পুনর্নির্মাণে সাহায্য চান ফিরাস। কিন্তু তিনি গাজা ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে চান না। দ্য গার্ডিয়ানকে ফিরাস বলেন, ‘আমরা মরব, তবুও এই ভূমি ছেড়ে যাব না।’ মাতৃভূমির বিনিময় অর্থ দিয়ে হয় না বলে মন্তব্য করেন ফিরাস।

ইসরায়েলের সঙ্গে চলমান যুদ্ধ শুরুর পর গত প্রায় ২৩ মাসে ফিলিস্তিনে হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার জনসংখ্যা ৬ শতাংশ কমেছে। ফিলিস্তিনের পরিসংখ্যান দপ্তরের পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে। 
ফিলিস্তিনের কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান দপ্তর (পিসিবিএস) বলছে, যুদ্ধের কারণে লাখখানেক ফিলিস্তিনি গাজা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। আরও ৫৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি এখন জীবন সংশয়ে আছেন।

ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েল মানবিক ও ত্রাণসহায়তা ঢুকতে না দেওয়ায় সেখানে তীব্র খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। এতে অবরুদ্ধ উপত্যকার ২১ লাখ বাসিন্দা, বিশেষ করে শিশুরা দুর্ভিক্ষের মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশন (আইপিসি)’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ ও দাতব্য সংস্থার উদ্যোগে গঠিত একটি সংস্থা হচ্ছে আইপিসি। আইপিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজার খাদ্যসংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এখনো দুর্ভিক্ষ শুরু হয়নি। তবে পরিস্থিতির যেভাবে অবনতি হচ্ছে, তাতে দুর্ভিক্ষের মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

৫০ বছর বয়সী রামজ গাজার বাসিন্দা। তিনি চার সন্তানের পিতা। তিনি বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি যেখানেই চলে যান না কেন কিংবা সুন্দর শহরে বসবাসের যতই চেষ্টা করুক না কেন, নিজ শহর, নিজ ভূমি ছাড়া তিনি কখনোই শান্তি পাবেন না। এত ধ্বংসের পরও আমরা শেষ পর্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে ও মরতে এখানে, আমাদের ভূমিতেই থাকব।’

টানা যুদ্ধে এরই মধ্যে প্রায় ৬৫ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি নারী ও শিশু। আহত হয়েছে আরও দেড় লাখের বেশি। গাজার মানবিক সংকটের কারণে হাজার হাজার মানুষ নিখোঁজ রয়েছে, যাদের মধ্যে অনেকে নিহত, ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে আছেন অথবা গুমের শিকার হয়েছেন। 

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের ফলে কমপক্ষে ৩ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন, যার মধ্যে অর্ধেকের বেশি শিশু। এই নিখোঁজদের প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি এবং তাদের অনেকেই সম্ভবত ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন অথবা গুমের শিকার হয়েছেন।  

গাজা সিটিতে প্রায় ১০ লাখ মানুষ বর্তমানে ঠাঁই নিয়েছেন। তাদের সামনে আরও একবার বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাদের মধ্যে ভয় ও প্রতিরোধের মিশ্র অনুভূতি। কারণ ইসরায়েল ঘোষণা করেছে, তারা এই অঞ্চলের বৃহত্তম শহরটি সামরিকভাবে দখল করবে।

ইসরায়েলের নিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রিসভা গাজা দখল করে নেওয়ার পরিকল্পনা অনুমোদন করার পর  শহরে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। এর অংশ হিসেবে বারবার বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক দক্ষিণের তথাকথিত কেন্দ্রীভূত অঞ্চলগুলোতে সরিয়ে নেওয়া হবে। 

উত্তর-পূর্ব বেইত হানুন থেকে বাস্তুচ্যুত মাগজুজা সা’দা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘পুরো গাজা উপত্যকার কোথাও নিরাপদ নয়, অথচ আবারও স্থানান্তরের জন্য বাধ্য করা হচ্ছে। তিনি বলেন, দক্ষিণ দিকটা নিরাপদ নয়। গাজা সিটি নিরাপদ নয়, উত্তরও নিরাপদ নয়। আমরা কোথায় যাব?’

গাজার বর্তমান খাদ্যসংকট পরিস্থিতি তুলে ধরে আইপিসির মূল্যায়নে বলা হয়েছে, গাজার প্রায় ৫ লাখ বাসিন্দা, অর্থাৎ উপত্যকাটির প্রতি পাঁচজনে একজন বর্তমানে অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। এ খাদ্যসংকট যদি চলতেই থাকে, তাহলে আগামী ৮ মাসÑ অর্থাৎ ২০২৬ সালের এপ্রিল নাগাদ পাঁচ বছরের কম বয়সি গাজার প্রায় ৭১ হাজার শিশু মারাত্মক পুষ্টিহীনতায় ভুগবে।

জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা গাজার পরিস্থিতিকে মানবিক বিপর্যয় হিসেবে সতর্ক করেছেন। জাতিসংঘের খাদ্য নিরাপত্তাবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাজার পরিস্থিতি দুর্ভিক্ষের চেয়ে খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এই শতাব্দীতে আমরা এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি কখনো দেখিনি। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস গাজার দুর্বিষহ পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘সাহায্যের প্রবাহ সমুদ্রের মতো হতে হবে। খাদ্য, পানীয়, ওষুধ ও জ্বালানি আসতে হবে বাধাহীন ঢেউয়ের মতো। তবেই এই দুঃস্বপ্নের সমাপ্তি হবে।’

পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, গাজার প্রতি তিনজনে একজন মানুষ কয়েক দিন যাবৎ না খেয়ে থাকছে। গত এপ্রিল থেকে ২০ হাজারের বেশি শিশুকে তীব্র অপুষ্টির জন্য চিকিৎসা দিতে হয়েছে। গত মার্চ মাস থেকে ইসরায়েল গাজার ওপর তীব্র অবরোধ আরোপ করার পর থেকে গাজার পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েল গাজায় অত্যাবশ্যকীয় মানবিক সাহায্যও প্রবেশ করতে দিচ্ছে না।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!