২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৮ হাজার ৯৭ জন। এ সময় মৃত্যু হয়েছিল ৮৭ জনের। চলতি বছর গতকাল সোমবার পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৭৪৫ জনে। এর মধ্যে প্রাণ হারিয়েছে ৬৩ জন। গতকালও মৃত্যু হয়েছে দুজনের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে সম্প্রতি জ্যামিতিক হারে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। এমন পরিস্থিতিতি চলতে থাকলে এ মাসের শেষেই আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ডেতে পারে বলে শঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
তারা বলছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পর দ্রুততম সময়ে চিকিৎসা না নেওয়ার কারণে বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, অর্ধেক রোগীই মারা যাচ্ছেন হাসপাতালে দেরিতে আসার কারণে। এদিকে এমন পরিস্থিতিতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নেই মশা নিধনের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মশা নিধনে ছিটানো ওষুধের ধোঁয়ার কার্যকারিতা নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা।
রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে তীব্র জ¦রে আক্রান্ত নিজের ছোট বোনকে ভর্তি করান সংবাদকর্মী শাহাদত নিশাদ। তিনি বলেন, সকালে সামান্য জ¦র আসে বোনের গায়ে। ভাইরাস জ্বর মনে করে প্যারাসিটামল খাওয়ানো হয়। কিন্তু বিকেল হতে না হতেই পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে থাকে। সন্ধ্যার পর প্রায় অচেতন অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসি। পরীক্ষা করে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। প্লাটিলেট ৪০ হাজারের কম। পুরো পরিবার ভেঙে পড়েছে। চিকিৎসকরা আন্তরিক হলেও খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে।
নিশাদের পরিবার দুশ্চিন্তায় যখন দিন কাটাচ্ছে তখন নিজের একমাত্র সন্তান সিয়ামের মৃত্যুতে বাকরুদ্ধ আশরাফুজ্জামান ও তার পরিবার। মাত্র দুই দিনের ডেঙ্গু জ¦রে ভুগে তরতাজা প্রাণটির মৃত্যু কোনোভাবেই মানতে পারছে না পরিবার। তাদের একটাই কথা বিনা দোষে কেন মরতে হলো প্রাণের ধনকে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, চলতি বছর ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া রোগীদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই মারা গেছেন। এর কারণ হিসেবে অধিদপ্তর জানায়, এটি ঘটছে দেরিতে হাসপাতালে আসার কারণেই চিকিৎসার সুযোগ কমে যাচ্ছে এবং বেড়ে যাচ্ছে মৃত্যুর ঝুঁকি। মৃত্যুর পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ডেঙ্গুতে যারা মারা গেছেন, তাদের অনেকেই খারাপ অবস্থায় হাসপাতালে এসেছেন। অনেক সময় দেরিতে ভর্তি হচ্ছেন, ফলে চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ খুব সীমিত হয়ে যাচ্ছে।
গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর বলেন, চলতি বছর ডেঙ্গুতে এখন পর্যন্ত মারা গেছে ১৭৯ জন। তাদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি রোগী ভর্তি হওয়ার পর ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই মারা গেছে। তাই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পরপরই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রয়োজনে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হলে মৃত্যুঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়। তিনি বলেন, ডেঙ্গু শনাক্তের জন্য এনএস১ কিট সব জায়গায় মজুত আছে এবং পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে।
মূল সমস্যা মশা নিধনে
সম্প্রতি রাজধানীবাসী মশার কামড়ে অতিষ্ঠ জীবনযাপন করছে। বিমানবন্দর থেকে শুরু করে রেলস্টেশন, লঞ্চঘাট, বিপণিবিতান, বাস টার্মিনাল এবং বাসাবাড়িতে মশার দৌরাত্ম্য বেড়েই চলছে। মশা নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্ত ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন হলেও সেখানে কোনো জনপ্রতিনিধি না থাকায় মশার ওষুধের ধোঁয়া কতটা কার্যকর তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। এর আগে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জন্য সিঙ্গাপুর থেকে মশা নিধনের জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়ায় আমদানিকারককে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ওই আমদানিকারক সিঙ্গাপুরের পরিবর্তে জৈব কীটনাশক বাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস বা বিটিআই নিয়ে আসে চীন থেকে।
এ ওষুধ গ্রহণ করে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। যদিও এ জালিয়াতি সামনে এলে পরবর্তী সময়ে এই ওষুধ প্রয়োগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। গত বছরের ৩ আগস্ট কীটনাশক বিটিআই প্রয়োগ কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়। আর এই প্রয়োগ বন্ধ করার পর নতুন করে এই বিটিআই আমদানি করা হয়নি। কিন্তু এই বিটিআই প্রয়োগেও মশা মরছে না বলে স্বীকার করেছেন খোদ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারাও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, নিয়মিতই ফগার মেশিন দিয়ে ধোঁয়া ছিটানো হয়। কিন্তু লাভের তো কিছুই হয় না। আমার নিজের স্ত্রী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ডিএনসিসি হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন। এই ধোঁয়া দিয়ে কি হবে যদি মশা নিয়ন্ত্রণ না হয়?
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাঝেমধ্যে বিকেলে কিছু এলাকায় মশা মারার নামে ফগার মেশিনের ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়। এতে মশার দাপট আদৌ কমছে বলে নগরবাসী বিশ্বাস করতে পারছেন না। এ বিষয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা দাবি করেন, দক্ষিণ অঞ্চলের পুরোদমে মশা দমনের কাজ চলছে। এ বিষয়ে তারা সফল দাবি করে বলেন, সকালে লার্ভাসাইডিং এবং ফগিং করা হয়। তাদের ওষুধ ভারত ও চীন থেকে এনে মজুত করা হয়েছে।
রাজধানীর ১৯৬ দশমিক ২২ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে ডিএনসিসির ৫৪ ওয়ার্ড। অধিকাংশ এলাকারই ডোবা-নালা ও জলাশয়ে জন্ম নেয় কিউলেক্স মশা। প্রায় ৯৫ ভাগ প্রজনন হয় এ উৎস থেকে। যেগুলো আবার বেশির ভাগের মালিক সরকারি সংস্থা। অথচ এসব জলাশয় পরিষ্কার ও সঠিক তদারকির অভাবে বাড়ছে কিউলেক্সের উপদ্রব।
কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, এখন ঢাকায় ৯৯ শতাংশই কিউলেক্স মশা। এডিস মশা ডেঙ্গুর বাহক হওয়ায় মানুষ অতি সতর্ক থাকেন। কিন্তু কিউলেক্সের ব্যাপারে অনেকটাই উদাসীন। দেশের ৯০ থেকে ৯৯ শতাংশ মশার এ প্রজাতি ফাইলেরিয়া বা গোদরোগের জীবাণু বহন করে। এ ছাড়া কিউলেক্স মশার কামড়ে চর্মরোগও হয়ে থাকে।
মৃত্যু বেশি ঢাকা মেডিকেলে, দ্বিতীয় কুর্মিটোলায়
দেশজুড়ে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ঘটনা ছড়িয়ে পড়লেও সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র রাজধানীর বড় হাসপাতালগুলোয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছে ৩৩ জন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে আরও ১৪ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, এসব হাসপাতালে অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামলাতে না পারায় মৃত্যুর হার তুলনামূলক বেশি হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ (সিডিসি) শাখার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. হালিমুর রশিদ জানান, চলতি বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশে ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সি রোগীদের মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি হলেও মৃত্যুর ঘনত্ব রাজধানীর বড় হাসপাতালগুলোতেই বেশি। ডেঙ্গুর ডেথ রিভিউ চলমান রয়েছে।
এখন পর্যন্ত ১১৪টি ডেথ রিভিউ সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে দেখা যাচ্ছে, বড় হাসপাতালে রোগীর চাপ বেশি থাকায় মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি। হালিমুর রশিদ আরও জানান, ভর্তি হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মারা গেছে ৫৭ জন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মারা গেছে ৭৮ জন। অনেকে ভর্তি হওয়ার সময়েই গুরুতর অবস্থায় থাকে। এ ছাড়া মারা যাওয়া রোগীদের প্রায় ৪০ শতাংশের অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি রোগ ছিল।
জনসচেতনতার বিকল্প নেই
যতই মশার ওষুধ ছিটানো হওক না কেনো জনগণ সচেতন না হলে মশার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার সুযোগ কম উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর বলেন, আমরা যত ব্যবস্থাপনা নেই, জনগণ সচেতন না হলে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। তবে স্বীকার করতে হবে, বড় হাসপাতালে অতিরিক্ত চাপ তৈরি হলে সেবা দেওয়ায় সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়। এতে দ্রুত চিকিৎসা জটিল হয়ে পড়ে। তিনি আরও জানান, গত বছরের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গু রোগী বেড়েছে তবে মৃত্যুর সংখ্যা তুলনামূলক কম। সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি হচ্ছে।
অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বলেন, বড় হাসপাতালে চাপ সামলাতে আলাদা টিম গঠন করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন মেনে আধুনিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তিনি জানান, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযানে নেমে আসার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি হাসপাতালে পর্যাপ্ত প্লুইড মজুদ রাখা হয়েছে, যাতে চিকিৎসায় কোনো ঘাটতি না হয়।
২৪ ঘন্টায় মৃত্যু আরও ২ জনের, হাসপাতালে ভর্তি ৬৭৮
এদিকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় আরও দুজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছরে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮১ জনে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৬৭৮ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়াদের মধ্যে বরিশাল বিভাগে ১৪৯ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৯০, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১১৩, ঢাকা উত্তর সিটিতে ১২৬, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ৭৪, খুলনা বিভাগে ২৫, ময়মনসিংহ বিভাগে ৩৩, রাজশাহী বিভাগে ৫৫, রংপুর বিভাগে ১০ ও সিলেট বিভাগে তিনজন রয়েছে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন