সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতির আওতায় নির্বাচন আয়োজনের সম্ভাবনা নাকচ করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। তিনি স্পষ্ট বলেছেন, পিআর পদ্ধতি সংবিধান ও আরপিও (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২)Ñ উভয় জায়গাতেই নেই। ফলে এটি বাস্তবায়নের জন্য আগে আইন সংশোধন করতে হবে, যা নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারে পড়ে না।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি। নির্বাচন কমিশন আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে রোজার আগে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের জোর প্রস্তুতি নিচ্ছে জানিয়ে সব রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা চেয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। একজন সম্পাদকের লেখা থেকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেছেন, ‘সব খেলোয়াড় যদি ফাউল করার জন্য মাঠে নামে, ম্যাচ প- হওয়া ছাড়া উপায় নেই। সবাই ফাউল করার জন্য মাঠে নামলে তো মুশকিল। কেউ যেন ফাউল না করে, সে বিষয়ে আমরা তৎপর। নির্বাচনে কেউ ফাউল করতে নামবে না, ভালো নিয়তে নামবেন আশা করি।’
সাংবাদিকরা জানতে চান, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন প্রচলিত পদ্ধতিতে হবে, নাকি পিআর পদ্ধতিতে? উত্তরে সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আরপিওটা পরিবর্তন করে যদি এটা (পিআর) অন্য একটা দিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে আইন বদলাতে হবে। আমরা তো আইন বদলাতে পারি না।’ আর যদি পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন আয়োজন করতে হয়, তাহলে সময়মতো (ফেব্রুয়ারিতে) নির্বাচন আদৌ সম্ভব হবে কি নাÑ এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, ‘সেটা তো আইন বদলাতে হবে, আরপিও বদলাতে হবে। আর এখানে আরপিওতে যে সিস্টেম আছে, সেটা বদলাতে হলে সংবিধানও বদলাতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সংবিধান বদলাতে বলা হলে আবার আমার বিরুদ্ধে কথা বলবে। তখন বলবে, উনি তো পিআরের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়া গেছে।’ সিইসি বারবারই রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকার দিকে ইঙ্গিত করেন। বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো একটা ফয়সালায় বা মীমাংসায় আসুক। ওনারা তো বুঝবেন যে, আমাদের পক্ষে সম্ভব কি না। যদি ওনারা পিআর চান, তাহলে বুঝবেনÑ আমাদের কী করণীয়।’
বাংলাদেশে নির্বাচন এখন পর্যন্ত একক আসনভিত্তিক প্রথম ভোটে বিজয়ী পদ্ধতিতে হয়ে থাকে। পিআর চালু করতে হলে সংবিধান সংশোধনের পাশাপাশি পরিবর্তন আনতে হবে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশেও। অথচ সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা একমাত্র সংসদের হাতে। নির্বাচন কমিশনের হাতে আইন প্রণয়ন বা সংশোধনের ক্ষমতা না থাকায় তারা এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নিতে পারবে না বলেই জানিয়ে দেন সিইসি।
শাপলা প্রতীক নিয়ে বিতর্ক
নিবন্ধনপ্রত্যাশী জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির আগে নিবন্ধিত দল নাগরিক ঐক্য শাপলা প্রতীক চাইলেও তা নাকচ করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এখন এনসিপির দাবি নাকচ হওয়ায় কেন এতে আলোচনা হচ্ছে, তা বোধগম্য হচ্ছে না সিইসির। তিনি বলেন, ‘এনসিপি শাপলা চেয়েছেÑ এটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। অথচ শপলা চেয়েছিল নাগরিক ঐক্য, তারা প্রথম চেয়েছিল। তখন আলোচনায় আসেনি। এখন কেন এত আলোচনা? নাগরিক ঐক্যকে শাপলা দিইনি আমরা। সচিব এ বিষয়ে বলেছেন, আর বলতে চাই না।’
নির্বাচনি প্রতীকের চূড়ান্ত তালিকা বুধবার জারি হয়েছে। ইসি সচিব এনসিপিকে বিকল্প প্রতীক চেয়ে আবেদন করার পরামর্শ দিলেও এনসিপি ফের শাপলা চেয়ে আবেদন করেছে। এ বিষয়ে সিইসি বলেন, ‘চিঠি নিয়ে কমিশনে বসে সিদ্ধান্ত নেব। আমাদের কমিশনের সভায় আলোচনার পর পরবর্তী কার্যক্রম সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেব। কমিশন সভার আলোচনার পর কথা হবে।’
এনসিপির চিঠির প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘যেকোনো দল চিঠি দিতে পারে। অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া দল এনসিপি। চিঠি দেওয়ায় অসুবিধা নেই। দল তো দেবেই। রাজনীতিবিদরা দেশের স্বার্থে সব কিছু একমোডেট করেন। চিঠি বিবেচনা করব, কী করা যায় দেখা যাক।’
শাপলা প্রতীক বরাদ্দ না দিলে তা কীভাবে আদায় করতে হয় জানা আছে বলে হুমকি দিয়েছেন এনসিপির নেতারা। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সিইসি বলেন, ‘রাজনীতিবিদরা অনেক কথা বলতে পারেন। আমরা তো জবাব দিতে পারব না, শ্রোতা। আমাদের কাজ আইন মোতাবেক করব। এটা হুমকি মনে করি না। ওনারা তো দেশদ্রোহী না, ওনারা দেশপ্রেমিক। দেশের জন্য, আমাদের জন্য হুমকি মনে করি না।’
জাপা নিয়ে ‘কনফিউজড’ সিইসি
বিগত দিনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সখ্যের কারণে জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধের দাবি তুলেছে কয়েকটি দল। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায়ও জাতীয় পার্টিকে রাখা হয়নি। এ অবস্থায় ইসির সংলাপে জাপাকে ডাকা হবে কি না জানতে চাইলে সিইসি বলেন, ‘সময় আসুক, দেখব। এখনো তো সংলাপ শুরু করিনি। ঐকমত্য কমিশন এখনো সংলাপ করছে। আমরা একটু পরে করব। সিভিল সোসাইটিসহ অন্যদের সাথে আলোচনা করে শেষের দিকে দলের সঙ্গে বসব। এখন (জাপা নিয়ে) রাজনৈতিক বিতর্ক চলছে, দেখি কী অবস্থা হয়।’
জিএম কাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি ইসিতে নিবন্ধিত। ইতিমধ্যে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রুহুল আমিন হাওলাদারের একাংশ নিজেদের ‘মূল জাপা’ দাবি করে ইসিতে চিঠি দিয়েছে। এই ভাঙনের মধ্যে কোনটি আসল জাপা, তা নিয়ে নিশ্চিত নন সিইসি। তিনি বলেন, ‘জাতীয় পার্টি ৫টি পেয়েছি, আপনারা কয়টি পেয়েছেন? লাঙলের দাবিদার তো একাধিক। জাপা বললে আমি কনফিউজড, হাফ ডজন আছে। এ জন্য কনফিউজড। সময় এলে দেখবেন, ভাবতে দেন।’
নতুন দল নিবন্ধনে বিলম্ব কেন?
সেপ্টেম্বরের মধ্যে নতুন দলের নিবন্ধন শেষ করার কথা ছিল। ২২টি দলের মাঠ পর্যায়ের পরিস্থিতি সরেজমিন তদন্ত শেষে নিবন্ধনযোগ্যদের বিষয়ে আপত্তি আছে কি না পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির প্রক্রিয়া চলছে। কিন্তু কিছু দলের বিষয়ে আরও যাচাইয়ের কাজে সময় লাগছে বলে জানান সিইসি। তিনি বলেন, ‘কাজ দ্রুত চলছে। টার্গেট ছিল এ মাসে করে ফেলতে পারব। বিভিন্ন দল নানা অভিযোগ নিয়ে আসছে। আমাদের কিছু অতিরিক্ত ইনফরমেশন কালেক্ট করতে হচ্ছে। নিশ্চিত হতে হচ্ছে, তারা সঠিকভাবে তথ্য দিয়েছে কি না। এ জন্য সময় লাগছে। কোন কোন দল নিবন্ধন পাচ্ছে তা নিয়ে এখন কথা বলতে নারাজ সিইসি নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, নিবন্ধনের জন্য ইসি ‘নিজস্ব পদ্ধতিতে’ কাজ করছে, গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে না।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন