ঢাকা বুধবার, ০১ অক্টোবর, ২০২৫

খাগড়াছড়ি সংঘর্ষের ঘটনায়  ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি

রূপালী প্রতিবেদক ও খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৫, ১১:১৬ পিএম
  • অবরোধ প্রত্যাহার করলে ১৪৪ ধারাও তুলে নেওয়ার ঘোষণা ডিসির
  • পাহাড়ে ফ্যাসিস্টরা এসব ঘটনা ঘটিয়েছে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
  • ৪১ বিশিষ্ট নাগরিকের বিবৃতি

খাগড়াছড়ির গুইমারায় মারমা স্কুলছাত্রীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় সহিংসতার তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। এ ছাড়া ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ, নিহত ও আহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা ও পুনর্বাসনে কাজ করছে প্রশাসন। চলমান পরিস্থিতিতে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান বের করতে কাজ করছে সংশ্লিষ্টরা। তবে পাহাড়ের পরিস্থিতি এখন শান্ত উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, পাহাড়ের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, সুষ্ঠুভাবে দুর্গাপূজা আয়োজনে বাধা এবং দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পাহাড়ে ফ্যাসিস্টরা এসব ঘটনা ঘটিয়েছে। এদিকে খাগড়াছড়িতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগের’ অভিযোগের তদন্তসহ ৯ দফা দাবি জানিয়ে ৪১ বিশিষ্ট নাগরিক বিবৃতি দিয়েছেন।  

গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে রামসু বাজার এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণে যান খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তে জেলা প্রশাসন পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছি। আন্দোলনকারী জুম্ম ছাত্র-জনতার নেতাদের সঙ্গেও আমরা বৈঠক করেছি। আলোচনার টেবিলে বসে শান্তিপূর্ণ একটি সমাধান বের করতে কাজ করছি।’ এ ছাড়া ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ, নিহত ও আহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা ও পুনর্বাসনে কাজ করছে প্রশাসন।

তিনি বলেন, ‘ঘটনার পরদিন গতকালও (সোমবার) আমরা এখানে এসেছি। আজ (মঙ্গলবার) আবার ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়াতে অল্প কিছু ত্রাণ নিয়ে এসেছি। আহতদের ইতিমধ্যে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রামে পাঠানো হয়েছে। নিহতদের পরিবারকে পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া চলমান।

তিনি আরও বলেন, এ ছাড়া আন্দোলনকারীদের দেওয়া আট দফা দাবির মধ্যে সাতটি দাবি বাস্তবায়নে আমরা ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছি।

জেলা প্রশাসক বলেন, ‘আন্দোলনকারীদের ১৪৪ ধারা প্রত্যাহরের দাবিও আমরা বিবেচনা করছি। তবে এর জন্য বাধা হচ্ছে চলমান অবরোধ। অবরোধ প্রত্যাহার করা হলে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলেই আমরা ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করে নেব।’

এ সময় স্থানীয় মারমা অধিবাসীরা আস্থার সংকট দূর করে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার দাবি জানান। তারা অভিযোগ করেন, ঘটনার পর থেকে গ্রাম থেকে বের হতে পারছেন না। আত্মীয়স্বজনও তাদের দেখতে আসতে পারছেন না। আহতদের মামলার হয়রানি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আহ্বান জানান তারা।

এর জবাবে জেলা পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে কাজ করছে পুলিশ। নিহতদের পরিবারকে মামলা করার আহ্বান জানানো হয়েছে। তারা মামলা করতে না চাইলে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে।’
এ সময় খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শেফালিকা ত্রিপুরা বলেন, ‘আস্থার সংকট কাটাতে সব পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে। হানাহানি পরিহার করে সহমর্মী হতে হবে।’

এ সময় বাংলাদেশ মারমা ঐক্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা ও স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান উ-ম্রাসাথোয়াই মারমা ও বাংলাদেশ মারমা যুব ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক চাইহলাপ্রু মারমা উপস্থিত ছিলেন।

পাহাড়ে ফ্যাসিস্টরা এসব ঘটনা ঘটিয়েছে: গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে পাহাড়ের পরিস্থিতি এখন শান্ত উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, পাহাড়ের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সুষ্ঠুভাবে দুর্গাপূজা আয়োজনে বাধা এবং অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পাহাড়ে ফ্যাসিস্টরা এসব ঘটনা ঘটিয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। 

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘এখন পাহাড়ে কোনো সমস্যা নাই। এই জিনিসটা করা হয়েছিল যেন হিন্দুরা ভালোভাবে তাদের পূজাটা উদযাপন না করতে পারে। কিন্তু তারা আসলে সফল হয়নি।’

এরপর গতকাল শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে রাজধানীর আজিমপুর ঢাকেশ্বরী কেন্দ্রীয় মন্দির পরিদর্শন শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘পাহাড়ে যেন শান্তিপূর্ণভাবে পূজা উদযাপন না হয়, সে জন্য একটা মহল বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল। ইতিমধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তা প্রতিহত করেছে।’

উপদেষ্টা বলেন, খাগড়াছড়ির ঘটনায় কিছু সন্ত্রাসী চিহ্নিত করা গেছে। কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। 

পূজাকে কেন্দ্র করে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা গুজব ছড়ানো হচ্ছে জানিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে। যাচাই-বাছাই না করে কোনো সংবাদ পরিবেশন না করতে গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।

৪১ বিশিষ্ট নাগরিকের বিবৃতি: খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগের ঘটনায় দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্ত এবং অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করাসহ ৯ দফা দাবি জানিয়েছেন ৪১ জন বিশিষ্ট নাগরিক। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তারা এ দাবি জানান।

ওই বিবৃতিতে মারমা কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ-সহিংসতা ও গুলিবর্ষণে তিনজন নিহত ও ৩০ জন আদিবাসী আহত হয়েছেন বলে জানান বিশিষ্ট নাগরিকেরা। এ ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগের অভিযোগের বিষয়ে স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনেরও দাবি জানান তারা।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, কোনো বাহিনী আইনের শাসন ও মানবাধিকারের ঊর্ধ্বে নয়। মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগের ঘটনায় কেউ জড়িত থাকলে তাকে অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। দায়মুক্তির সংস্কৃতি অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।

নাগরিক সমাজের ৯ দফা দাবি হলো:

১. খাগড়াছড়িতে মারমা কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে দ্রুত, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ভুক্তভোগী কিশোরী ও তার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সহায়তা দিতে হবে।

২. সংঘর্ষে প্রাণহানির ঘটনায় সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ও মদদের অভিযোগের বিষয়ে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে।

৩. সহিংসতায় জড়িত ব্যক্তিরা যে বাহিনীর সদস্যই হোক না কেন, তাদের সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

৪. নিহত ও আহতদের পরিবারকে সুরক্ষা, যথার্থ ক্ষতিপূরণ, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।

৫. পাহাড়ে দীর্ঘদিনের সামরিকীকরণ নীতি পর্যালোচনা করে শান্তিপূর্ণ, রাজনৈতিক সমাধানের পথে এগোতে হবে।

৬. পাহাড়ে বসবাসরত সব নাগরিকের জীবনের অধিকার, নিরাপত্তা ও সম্প্রীতিনির্ভর সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে।

৭. পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ওপর যেন কাঠামোগত নিপীড়ন চালানো না হয় এবং এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তারা যেন আরও হয়রানি, গ্রেপ্তার ও আইনি নিপীড়নের শিকার না হয়, রাষ্ট্রকে তা নিশ্চিত করতে হবে।

৮. পাহাড়ে অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ভুক্তভোগীদের কণ্ঠস্বর দমন না হয় এবং জনগণ সত্য জানতে পারে।

৯. নারীদের ওপর সংঘটিত নির্যাতন ও নিপীড়নের ঘটনাগুলোর প্রতিকার ও জবাবদিহি নিশ্চিতে স্বাধীন তদন্ত করতে হবে। দৃকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা, আসিফ শাহান, মোশাহিদা সুলতানা, রুশাদ ফরিদী, তাসনীম মাহবুব, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সারা হোসেন, মানজুর আল মতিন, কাজী জাহেদ ইকবাল, সাংবাদিক সায়দিয়া গুলরুখ, সংগীতশিল্পী বীথি ঘোষ, লেখক ফিরোজ আহমেদসহ ৪১ বিশিষ্ট নাগরিক এই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন।