ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর, ২০২৫

দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজন সংস্কার এবং টেকসই  পরিবহন কৌশল

সাইদুর রহমান
প্রকাশিত: অক্টোবর ২, ২০২৫, ১২:২৯ এএম

দেশে কোনো টেকসই পরিবহন কৌশল নেই। আইনকানুন, নীতি-নৈতিকতার গুরুত্ব ও প্রয়োগ নেই। ফলে সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগই আলোর মুখ দেখে না। শুধু কমিটি গঠন এবং সুপারিশমালা তৈরির মধ্যেই ঘুরপাক খায় সব উদ্যোগ। দীর্ঘ ৭ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি নতুন সড়ক পরিবহন আইন। অদক্ষ চালক, ত্রুটিপূর্ণ মোটরযান এবং অতি মুনাফালোভী ব্যবস্থাপনার কারণে সড়কে অহরহ দুর্ঘটনা ঘটছে। অগণিত মানুষ আহত-নিহত ও পঙ্গু হচ্ছে। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় আক্রান্তদের অধিকাংশই দরিদ্র এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিরাই আহত-নিহত হচ্ছেন। দুর্ঘটনায় উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুর কারণে আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে এবং আহতদের সহায়-সম্পদ বিক্রি করে চিকিৎসা করতে গিয়ে নি¤œ ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো সর্বস্বান্ত হচ্ছে।

চিকিৎসার পরেও যারা পঙ্গু হচ্ছে, তাদের অবস্থা আরও করুণ। এভাবেই সড়ক দুর্ঘটনার কারণে অসংখ্য পরিবার সামাজিক অর্থনীতির মূল ¯্রােত থেকে হারিয়ে বিপন্ন হয়ে পড়ছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের ৭৯ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে। এই বিপুল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মৃত্যুতে দেশে আর্থসামাজিক সংকট তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার অভাবে দুর্ঘটনায় দায়ীদের শাস্তি হচ্ছে না। 

মূলত সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অব্যবস্থাপনা ও কাঠামোগত ত্রুটির কারণে সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। একটি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী রাজনীতিকীকরণের মাধ্যমে গোটা গণপরিবহন খাত চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির রাজ্যে পরিণত করেছে। যত বেশি অব্যবস্থাপনা থাকবে, তত বেশি দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির সুযোগ থাকে। এ কারণেই স্বার্থবাদী গোষ্ঠী পরিবহন খাতে অব্যবস্থাপনা টিকিয়ে রাখছে। রাজধানীর গণপরিহনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য কোম্পানীভিত্তিক বাস পরিচালনার উদ্যোগও বাধাগ্রস্ত করছে এই গোষ্ঠী। অথচ বিআরটিএ প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে এই দুর্বৃত্ত গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না।

ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটি (ডিটিসিএ) বা ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের কাজের কোনো সাফল্য নেই। এই প্রতিষ্ঠানের নামই মানুষ জানে না। অথাঁৎ, প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম নেই। রাষ্ট্রীয় পরিবহন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বিআরটিসি প্রত্যাশিত পরিবহন সেবা প্রদান করতে পারছে না। দুর্নীতির কারণে এটা লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এই দুর্ভাগ্যজনক প্রেক্ষাপটে বিআরটিএ, বিআরটিসি ও ডিটিসিএÑ এই তিন প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা ও কাঠামোগত সংস্কার করে প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারলে সড়ক পরিবহনব্যবস্থায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে। 

নিরাপদ সড়কব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হলে সরকারকে দক্ষ চালক তৈরি, চালকদের বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্টকরণ, পরিবহন শ্রমিকদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, মেয়াদোত্তীর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন বন্ধ, ত্রুটিপূর্ণ সড়ক মেরামত ইত্যাদি বাস্তবায়ন করতে হবে। বিআরটিএ সারা দেশে উন্নত পরিবহন সেবা বিস্তৃত করবে। এতে বেসরকারি পরিবহন মালিকদের দৌরাত্ম্য কমার পাশাপাশি উন্নত সেবা দেওয়ার প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। রাজধানী ঢাকায় রুট ফ্রাঞ্চাইজ পদ্ধতিতে কোম্পানীভিত্তিক গণপরিবহন চালু করতে হবে। এই পদ্ধতি চালু হলে সড়কে যত্রতত্র যাত্রী তোলার প্রতিযোগিতা বন্ধ হবে।

উন্নতমানের এসি, নন-এসি দুই প্রকারের ৪ হাজার নতুন যাত্রীবাহী বাসের ব্যবস্থা থাকলে রাজধানীতে ব্যক্তিগত গাড়ি নিরুৎসাহিত করা সম্ভব। রাজধানীতে যারা চলাচল করেন, তাদের মধ্যে গণপরিবহন ৫৩ শতাংশ যাত্রী বহন করে আর ব্যক্তিগত গাড়ি বহন করে ১১ শতাংশ যাত্রী। অথচ ব্যক্তিগত গাড়ি ও রিকশার দখলে ঢাকার ৭০ শতাংশ সড়ক। রাজধানীর রিকশাও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ব্যক্তিগত গাড়ি ও রিকশা কমলে রাজধানীতে অসহনীয় যানজট থাকবে না। এটাই যানজট কমানোর একমাত্র টেকসই পদ্ধতি। সিএনজি অটোরিকশার সিন্ডিকেট ভেঙে এর ক্রয়মূল্য কমানো প্রয়োজন। একটি সিএনজি অটোরিকশার দাম কোনোভাবেই ২৭ লাখ টাকা হতে পারে না। রাজধানীতে ২০ লাখের মতো মোটরসাইকেল চলছে। মানসম্মত গণপরিবহনের অভাব এবং যানজটের কারণে মোটরসাইকেলের ব্যবহারও অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে বলে বলে মনে করি। যানজট কমলে মোটরসাইকেলের ব্যবহারও কমবে।

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বর্তমানে দেশে নিবন্ধিত মোটরযানের ৭১ শতাংশই মোটরসাইকেল। এসব মোটরসাইকেলের একটি বড় অংশ অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরেরা ব্যবহার করছে। এরা বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালিয়ে থাকে। ফলে নিজেরা যেমন দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে, পাশাপাশি অন্যদেরও আক্রান্ত করছে। গত পাঁচ বছরে অর্থাৎ, ২০২০ সাল থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১১ হাজার ৭২৫টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ১১ হাজার ৮৬৪ জন, যা সড়ক দুর্ঘটনায় মোট নিহতের ৩৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ। নিহতদের ৫৯ শতাংশের বয়স ১৪ থেকে ৪৫ বছর।

এই ভয়াবহ চিত্র রোধ করতে হলে মোটরসাইকেল চালানোর ক্ষেত্রে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। মোটরসাইকেল চার চাকার যানবাহনের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। মোটরসাইকেল চালকদের হেলমেট ব্যবহারও মনিটর করতে হবে। মানসম্পন্ন হেলমেট দুর্ঘটনায় ৪৮ শতাংশ মৃত্যুঝুঁকি কমাতে পারে। মোটরসাইকেল উৎপাদন ও বিপণন প্রতিষ্ঠানগুলোর বিজ্ঞাপনে যে ধরনের উত্তেজনাকর ভাষা-ভঙ্গি ব্যবহার করা হয়, তাতে কিশোর-যুবক শ্রেণি মোটরসাইকেলে গতির প্রতিযোগিতায় উৎসাহিত হয়।

কারণ কিশোর-যুবরা গতির মধ্যে রোমাঞ্চ অনুভব করে। সরকারের উচিত এসব বিজ্ঞাপন সেনসর করা। মোটরসাইকেলের লাগামহীন বাণিজ্যের মাধ্যমে বছরে ৫ থেকে ৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের জন্য ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকার মানবসম্পদ হারানোর কোনো মানে নেই। তাই সরকারের উচিত মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে একটি টেকসই সাশ্রয়ী ও জনবান্ধব গণপরিবহনব্যবস্থা গড়ে তুলতে মনোযোগী হওয়া। 

দেশে সড়ক অবকাঠামো বিস্তৃত হয়েছে। বর্তমানে জাতীয় ও আঞ্চলিক সড়কের দৈর্ঘ ২২ হাজার ৪৭৬ দশমিক ২৮ কিলোমিটার। গ্রামীণ সড়ক প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার কিলোমিটার। দেশব্যাপী এসব সড়কে নানা ধরনের যানবাহন যেমন বেড়েছে, তেমনি যানবাহনের গতিও বেড়েছে। গতি নিয়ন্ত্রণ এবং মনিটরিংয়ের জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অমান্যকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ৮৫ শতাংশ দুর্ঘটনার প্রধান কারণ যানবাহনের অতিরিক্ত গতি। যানবাহনের গতি ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটারের ওপরে প্রতি পাঁচ কিলোমিটার বৃদ্ধিতে দুর্ঘটনার ঝুঁকি দুই থেকে চার গুণ বাড়ে। যানবাহনের চাকা ফেটে দুর্ঘটনার সংখ্যাও বাড়ছে; যার সঙ্গে অতিরিক্ত গতির সম্পর্ক রয়েছে।  

সারা দেশের গ্রামে-গঞ্জে সড়ক অবকাঠামো গড়ে উঠলেও আধুনিক ও নিরাপদ যানবাহনব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ফলে মানুষের প্রয়োজনের তাগিদে ইজিবাইক, অটোরিকশা, নসিমন, করিমন, ভটভটি, আলমসাধু ইত্যাদির মতো অনিরাপদ যানবাহনের প্রচলন ঘটেছে। তাই যান্ত্রিক উন্নতি ঘটিয়ে এসব যানবাহন স্বচ্ছতার সঙ্গে রেজিস্ট্রেশনের আওতায় এনে চালকদের  টেকনিক্যাল ও মোটিভেশনাল প্রশিক্ষণ দিতে হবে। একই সঙ্গে এসব অনিরাপদ যানবাহনের উন্নত বিকল্পও ভাবা সময়ের দাবি। সব মহাসড়কে ডিভাইডার নির্মাণ এবং স্বল্প গতির ছোট যানবাহনের জন্য সার্ভিস রোড নির্মাণ করতে হবে। স্বল্প গতির যানবাহনের জন্য নিরাপদ সড়ক নকশা করা প্রয়োজন। কেননা, এসব যানবাহনের ওপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি।

এ ছাড়া পথচারী নিহতের মাত্রাও চরমভাবে বেড়েছে। পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, পথচারী নিহতের ক্ষেত্রে ৫৭ শতাংশ দায়ী যানবাহনের বেপরোয়া গতি এবং ৪৩ শতাংশ দায়ী পথচারীদের অসতর্কতা। উভয় ক্ষেত্রেই সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতার বিকল্প নেই। এ জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের সমন্বিত উদ্যোগে নিরাপদে সড়ক ব্যবহার বিষয়ে হাট-বাজার, বাস টার্মিনাল, রেল স্টেশনে গণসংগীত, নাটক ইত্যাদির মাধ্যমে সর্বসাধারণকে সচেতন করতে হবে। দেশের সব কর্মক্ষেত্রের প্রবেশপথ এবং ভেতরের দৃশ্যমান স্থানে সড়ক নিরাপত্তাবিষয়ক নির্দেশিকা বোর্ড স্থাপন করা প্রয়োজন, যাতে মানুষের মধ্যে নিরাপদ সড়ক ব্যবহারের বিষয়টি সার্বক্ষণিক কাজ করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতি বছর নিয়মিত সড়ক নিরাপত্তাবিষয়ক ক্যাম্পেইন পরিচালনাও জরুরি। শিক্ষার্থীরা সচেতন হলে জীবনভর সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি লালনের মাধ্যমে অন্যদের উৎসাহিত করবে। পাশাপাশি গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জীবনমুখী প্রচারণা চালাতে হবে। 

উল্লেখিত প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং টেকসই পরিবহন কৌশলের মাধ্যমে সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, যার মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনাও রোধ হবে। তবে এর জন্য সরকারের সদিচ্ছা জরুরি। এমনটা না হলে নিরাপদ সড়কব্যবস্থা আমাদের কাছে দূরবর্তী স্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে। 

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, রোড সেফটি ফাউন্ডেশন