জুলাই সনদ ইস্যুতে গণভোটের পক্ষে সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ। ফলে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একধরনের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জনগণের সম্মতি অর্জনের জন্য গণভোটের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে। এখন শিগগিরই জাতীয় ঐকমত্য কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেবে।
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ গতকাল রোববার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় কমিশনের বৈঠক শেষে এ তথ্য জানান। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন কমিশনের প্রধান ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। কমিশনের সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. মো. আইয়ুব মিয়া ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
প্রায় ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে জুলাই জাতীয় সনদের বিষয়বস্তু, এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান নিয়ে কমিশনের অগ্রগতি উপস্থাপন করা হয়। প্রধান উপদেষ্টা কমিশনের কাজের অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করে সদস্যদের ধন্যবাদ জানান এবং দ্রুততম সময়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দেন।
অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ জানান, দলীয় অবস্থান থেকে সরে এসে রাজনৈতিক দলগুলো একটি জায়গায় আসার জন্য সচেষ্ট হয়েছে। এ বিষয়ে ইতিপূর্বে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। এখন অনেকে এ বিষয়ে কিছুটা সরে আসছেন। এ জন্য দলগুলোকে ধন্যবাদ। আশা করি, একটি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে জমা দিতে পারব। প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, ‘আমরা ১৫ অক্টোবরের মধ্যে একটি মীমাংসায় আসতে পারব।’
তিনি জানান, জুলাই সনদে স্বাক্ষর করার বিষয়ে তিন-চতুর্থাংশ দলের কাছে নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। অনেকে নাম দিয়েছেন, অনেকে এখনো দেননি। দ্রুত নাম দিতে তিনি দলগুলোকে অনুরোধ করেন। আর দু-এক দিনের মধ্যে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আবারও বৈঠকে বসবে কমিশন।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে ব্যাপক সহযোগিতা পেয়েছে। পাশাপাশি গণমাধ্যম থেকেও অকল্পনীয় সমর্থন পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যদি এক জায়গায় আসতে পারে, তাহলে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন অনেক সহজতর হবে। তবে ঐকমত্য না হলে সনদ বাস্তবায়নের জন্য একাধিক প্রক্রিয়া সম্পর্কেও প্রস্তাব দেওয়া হবে।
রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আজ চতুর্থ দিনের আলোচনায়ও কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ একই বিষয় তুলে ধরেন। তিনি বলেন, জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান সম্পর্কিত ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের খসড়া ইতিমধ্যে চূড়ান্ত হয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে এখনো ঐকমত্য হয়নি। দলগুলোর পক্ষ থেকে ছয়টি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কমিশনের লক্ষ্য হলো আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে এটিকে একটি জায়গায় আনা।
তিনি আরও বলেন, যদি ৩০টি রাজনৈতিক দল সম্মিলিতভাবে একটি প্রস্তাব দেয়, তাহলে আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সেই প্রস্তাব উপস্থাপন করব। কিন্তু প্রয়োজন হলে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আবারও আলোচনা করা হতে পারে।
কমিশন চাইছে, ১৫ অক্টোবরের মধ্যেই সব রাজনৈতিক দলের স্বাক্ষরের মাধ্যমে জুলাই সনদকে পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক দলিলে রূপ দেওয়া হোক। কারণ ওই তারিখে কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে। আলী রীয়াজ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনি প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। তাই আমরা চাই এই প্রক্রিয়া যাতে কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত না হয় এবং সময়সীমার মধ্যেই সম্পন্ন হয়।
অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৈঠকে কমিশনের প্রচেষ্টা ও অগ্রগতির প্রশংসা করে দ্রুত চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, সনদকে এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে, যাতে এটি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে এবং দেশের রাজনৈতিক দলগুলো সম্মিলিতভাবে স্বাক্ষর করতে পারে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে প্রায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে অগ্রসর হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ।
জুলাই সনদ নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সালাহউদ্দিন আহেমদ বলেন, বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে একটা ফাইনাল স্টেজে (চূড়ান্ত ধাপে) আমরা আছি; মোটা দাগে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে মনে হয় আমরা এগোতে পেরেছি।
গণভোটের প্রস্তাব প্রসঙ্গে এই বিএনপি নেতা বলেন, আমরা সব রাজনৈতিক দল মিলে সমগ্র জনগোষ্ঠীকে প্রতিনিধিত্ব করি কি নাÑ এটা একটা প্রশ্ন। তাই জনগণের যদি সম্মতি নেওয়া যায় যে আমরা রাজনৈতিক দলসমূহ জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর করেছি, অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছিÑ জনগণ তার পক্ষে আছে কি না, তখনই হবে জনগণের পক্ষ থেকে এই জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য একটা চূড়ান্ত অভিমত।
গণভোটের জন্য সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন নেই বলে উল্লেখ করেন সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, রেফারেন্ডামের (গণভোট) যে আর্টিকেল ১৪২ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার উড়িয়ে দিয়েছিল, সেটা হাইকোর্টের রায়ের মধ্য দিয়ে রিইনস্টেট (পুনঃপ্রতিষ্ঠা) হয়েছে। এখন সংবিধানের আর কোথাও রেফারেন্ডাম করা যাবে নাÑ এমন কোনো বিধান নাই। সুতরাং একটা অর্ডিন্যান্স জারি করে নির্বাচন কমিশনকে এখতিয়ার দেওয়া যেতে পারে একই দিনে সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি আলাদা ব্যালটে রেফারেন্ডাম (গণভোট) করার জন্য।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, রেফারেন্ডামের (গণভোট) মাধ্যমে যে জনরায় আসবে, সেটা সার্বভৌম ক্ষমতার একটা রায়। সুতরাং সব সংসদ সদস্য সেটা মানতে বাধ্য হবে।
এ সময় সাংবাদিকেরা প্রশ্ন রাখেন, যদি আগামী সংসদে জুলাই সনদের বিরোধী এমপিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়, তবে কি তারা গণরায় মানতে বাধ্য থাকবে? জবাবে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জনরায় হচ্ছে চূড়ান্ত। যখন পক্ষে বলবে, তখন সেই সংসদ ও সংসদ সদস্যরা সেটা মানতে বাধ্য।
বৈঠকে জুলাই সনদের বিভিন্ন ধারার ওপর ‘নোট অব ডিসেন্ট’ থাকা নিয়ে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করলে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জুলাই সনদ প্রণীত হবে, স্বাক্ষরিত হবে, অঙ্গীকারনামায় সবাই সই করবেÑ ওয়েবসাইটে যাবে, সমস্ত পার্টির ইশতেহারে থাকবে, জনগণ জানবে জুলাই সনদে কী আছে। যারা ম্যান্ডেট পাবে, তারা তাদের নোট অব ডিসেন্ট অনুসারে যেতে পারবে।
এদিকে জুলাই সনদকে আইনি ভিত্তি দিতে এবং আরও পাকাপোক্ত করতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোটের পক্ষে মত দিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেন, জুলাই সনদ সাংবিধানিকভাবে পাকাপোক্ত করতে গণভোটের আয়োজন করতে হবে। জাতীয় সংসদের আগে এই গণভোট আয়োজন করা সম্ভব বলে আমরা মনে করি। এ জন্য নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকেই গণভোট আয়োজন করা যেতে পারে বলে জানায় জামায়াত। জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আইনি ভিত্তির জন্য জাতীয় নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগে গণভোট হতে পারে বলে জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ।
গণভোট কবে হবেÑ এমন প্রশ্নের জবাবে হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, জনগণ গণভোটে অভ্যস্ত না। আমরা মনে করি, এটি যাতে জাতীয় নির্বাচনকে কোনো ধরনের সমস্যায় না ফেলে, নভেম্বর অথবা ডিসেম্বরেই এটা করা যায়। তপশিলের আগেও করতে পারেন। গণভোট হয়ে গেলে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে কোনো ধরনের বাধা নেই। জনগণকে একটা জটিল অবস্থায় না ফেলে বা মহাপরীক্ষায় না ফেলে সহজভাবে এগিয়ে গেলে আমরাও বাঁচি, জাতিও বাঁচে।
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য না হলে দেশে আরেকটি অভ্যুত্থান অনিবার্য হয়ে উঠবে বলে মন্তব্য করেছেন আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু। সনদ নিয়ে আমরা যদি ঐকমত্যের ভিত্তিতে সমঝোতা বা সমাধানে না আসি, তাহলে আরেকটি অভ্যুত্থান অনিবার্য। তখন কেউ পালানোর পথ পাবে না।
মঞ্জু মনে করেন, অহেতুক সাংবিধানিক বিতর্ক তুলে রাজনৈতিক সংকটকে দীর্ঘায়িত করা হলে পরিস্থিতি ফের অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। তিনি বলেন, আমরা স্পষ্ট করে বলেছি, জুলাই সনদের ব্যাপারে যেহেতু আমরা একমত হয়ে গেছি, এখন এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে অহেতুক সাংবিধানিক জটিলতা তৈরি হচ্ছে এবং মানুষ বিরক্ত হচ্ছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশে মঞ্জু হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, যদি আপনারা আবার সাংবিধানিক বিতর্ক তুলে জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বিলম্বিত করেন, তাহলে আরেকটি গণঅভ্যুত্থান অনিবার্য হয়ে পড়বে। তখন পাঁচ-সাতটা হেলিকপ্টার লাগবে। কারণ নতুন অভ্যুত্থানে কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় ৮০ শতাংশ ইতিবাচক বলে জানিয়েছেন গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান। তিনি বলেন, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ৮০ শতাংশ ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। কমিশন সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার রাখে। বাকি ২০ শতাংশ নিয়ে ঐকমত্য কমিশনকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বলেন, সরকার তিনটি দলকে গুরুত্ব দেয়। সেই তিন দলকে এক জায়গায় আনা যাচ্ছে না। একই দিনে জাতীয় নির্বাচন এবং সনদের পক্ষে ভোটগ্রহণ নিয়ে সবাই একমত। জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকের অনুমোদন দিতে হবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেছেন, এই সরকারের সময়েই জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হবে। কারণ পরবর্তী সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে তা বাদ দিয়ে দিতে পারে। তাই জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী এই সরকারকেই বিষয়টি সমাধান করতে হবে।
তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচনের দিন সাধারণ ভোটের পাশাপাশি গণভোটের জন্য আলাদা ব্যালট থাকবে, যেখানে সনদের আইনি ভিত্তির বিষয়ে জনগণ মতামত দেবে। এ বিষয়ে অধিকাংশ দল একমত হয়েছে, যেখানে সনদ বাস্তবায়নে জনগণ হ্যাঁ বা না ভোট দেবে। নোট অব ডিসেন্টে যেসব বিষয়ে দলগুলো একমত হয়েছে, সেগুলোকেও ‘একমত’ বলে ধরে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের বিষয়টিও অনুসরণ করা যেতে পারে। আমরা মনে করি, সব রাজনৈতিক দল একমত হলে জনগণ জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করার পক্ষে রায় দেবে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন