আঁতুড়ঘর থেকে খাঁটিয়া সবকিছুতেই তাদের কষ্টভোগের তিলক আঁকা। ভোগবাদী এই পৃথিবীতে জীবন তাদের মলিনময়। বলছি দেশের অনাথ ও পথশিশুদের কথা। গত সপ্তাহে কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে তালতলা আসার পথে চোখে পরে কয়েকজন কিশোর-কিশোরীর দিকে। খেয়াল করে দেখলাম শীর্ণকায় দেহে তারা বিভোর হয়ে কিছু একটা বিষয় নিয়ে জটলা পাকিয়ে আছে। রিকশা চালকের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম তারা ড্যান্ডি খাচ্ছে। ড্যান্ডি মূলত একধরনের আঠা। ড্যানড্রাইট অ্যাডহেসিভ বা ড্যান্ড্রাইট নামের আঠাটিকেই মাদকসেবিরা ড্যান্ডি বলে চেনে। এই আঠা দিয়ে নেশা করে তারা। আঠায় থাকা কার্বন-ট্রাই-ক্লোরাইড, টলুইন, অ্যাসিটোন ও বেনজিন স্বাভাবিক তাপমাত্রাতেই বাষ্পে পরিণত হয়। এসব রাসায়নিক শ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করে মাদকসেবী পথশিশুরা। যার ফলে একধরনের মানসিক অবসাদ সৃষ্টি হয়। ক্রমশ ব্যবহারের কারণে ধীরে ধীরে চরম আসক্তিতে পরিণত হয়। আবেগকে পরিবর্তন করতে পারা, সহজলভ্য ও সস্তা হওয়ায় পথশিশুদের কাছে ড্যান্ডি অনেক জনপ্রিয় মাদক। আহারে জীবন! পারিবারিক বিচ্ছেদ এই ছেলেমেয়েদের জীবনে অভিশাপ হয়ে ধরা দিয়েছে। বিবেকের তাড়নায় গত কয়েকদিন কমলাপুর রেলস্টেশন, গুলিস্তান, মতিঝিল, খিলগাঁও রেলগেট, তালতলা, মালিবাগ, তেজগাঁও রেলস্টেশন, এবং বিমানবন্দর রেলস্টেশনে কিছু পথশিশুর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি। যাদের সঙ্গে কথা বলেছি তাদের সবার বয়স ১৮ বছরের নিচে। তাদের বিষাদময় জীবনের সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করেছি কিন্তু খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারিনি। শুধু এতটুকু অনুভব করতে পেরেছি আমাদের সমাজব্যবস্থার মাঝে থেকেও তারা বিচ্ছিন্ন এক সমাজে বসবাস করে। সংবিধান অনুযায়ী একজন মানুষ রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা এই মৌলিক চাহিদাগুলো পাওয়ার অধিকার রাখে। কিন্তু অনাথ ও পথশিশুরা এই অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত হয়। অনাথ ও পথশিশুদের নিয়ে ভাবলেই মস্তিষ্কে নাড়া দেয় কিছু রুক্ষ মলিন চেহারা। যাদের জীবন কেটে যায় উদ্দেশ্যহীন ঘোরাফেরায়। বিভিন্ন সময় পরিচালিত সরকারি ও বেসরকারি গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে বাংলাদেশে অন্তত ১১ লাখ অনাথ ও পথশিশু আছে। শুধু রাজধানী ঢাকাতেই পথশিশুর সংখ্যা দুই লাখের বেশি। দেশে কত-শত উন্নয়ন হচ্ছে। নতুন ভবন, সেতু, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, টানেল, স্যাটেলাইটসহ আরও হাজারো অবকাঠামোগত উন্নয়নে আমরা উচ্ছ্বসিত হচ্ছি। কিন্তু সামাজিক সুরক্ষার যে মৌলিক উন্নয়ন সেখানে রাষ্ট্র কি করেছে? এই সমাজের অসহায় মানুষদের জীবনমান উন্নয়নে রাষ্ট্র তথা সরকার ব্যবস্থা কি ভূমিকা রেখেছে? আমাদের রাজনীতিবিদগণ আসলেই কতটা জনকল্যাণমুখী চিন্তা করেন? মা-বাবা ও সামাজিক নিগ্রহের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় অবহেলার শিকার এই অনাথ ও পথশিশুরা। অনাথ ও পথশিশুদের এখনো করুণার দৃষ্টিতে গণ্য করা হয় অথচ তারা সব ক্ষেত্রে সমান সুযোগ-সুবিধা লাভের অধিকার রাখে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেই অধিকার গ্রহণের পথ বন্ধ হয়ে যায় রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা আর অবহেলার কারণে। দেশের বৃহৎ এই জনগোষ্ঠীর প্রায় ৯১ শতাংশ এখনো সরকারি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর বাইরে রয়েছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ প্রকাশিত ‘সার্ভে অন স্ট্রিট চিলড্রেন ২০২২’ প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের পথশিশুর ৪৮.৫ শতাংশ ঢাকা বিভাগে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় ২২.৭ শতাংশ এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় ১৮.৩ শতাংশের বসবাস। সবচেয়ে কম পথশিশু সিলেট বিভাগে ৪ শতাংশ। পথশিশুর ৮২ শতাংশ ছেলে ও ১৮ শতাংশ মেয়ে। অর্ধেকের বেশি পথশিশুর বয়স ১০-১৪ বছরের মধ্যে। ৩৩ শতাংশের বেশি পথশিশু জীবনের মৌলিক সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত। প্রায় অর্ধেক শিশু পাটের ব্যাগ, শক্ত কাগজ, প্লাস্টিকের টুকরা বা পাতলা কম্বল নিয়ে মাটিতে ঘুমায়। বিবিএসের তথ্য বলছে, প্রতি ১০ পথশিশুর মধ্যে ৯টি বিভিন্ন কাজে যুক্ত। এর মধ্যে ভিক্ষুক ও ভিক্ষুকের সহায়তাকারী ১৮.৪ শতাংশ। ময়লা কুড়িয়ে জীবন যাপন করছে ২০.৯ শতাংশ। ঝাড়ু দেওয়া ও পরিচ্ছন্নতা কাজে যুক্ত ০.৫ শতাংশ পথশিশু। আর ঝুঁকিপূর্ণ পরিবহন খাত ও নির্মাণকাজে যুক্ত ১৬ শতাংশ পথশিশু। চায়ের দোকান, কারখানা ও ওয়ার্কশপে কাজ করে ১৪.৮ শতাংশ। জীবিকার তাগিদে একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে যৌনকর্মী হিসেবে যুক্ত হচ্ছে মেয়ে পথশিশুরা। উন্নয়নের গালগল্পে ভরা রাষ্ট্র ব্যবস্থা এসব অনাথ ও পথশিশুদের নিরাপদ মানবিক জীবনের ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ। তবে রাষ্ট্রের পাশাপাশি এই ব্যর্থতার দায় এড়ানোর সুযোগ আমাদের কারোরই নেই। কারণ পৃথিবীর বুকে কেউ অনাথ ও পথশিশু হিসেবে আগমন করে না, এই সমাজ তাদেরকে অনাথ ও পথশিশু হিসেবে নির্ধারণ করে। অনাথ ও পথশিশুদের আমরা সবাই মিলে আলাদা শ্রেণি বানিয়ে রেখেছি। ফলে তারা খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ প্রায় সকল ক্ষেত্রেই বঞ্চিত হয়ে বেড়ে ওঠে। এই বঞ্চনার সুযোগ নেয় অপরাধচক্র। পথশিশুদের একটা বড় অংশ মাদক পাচার, ভিক্ষাবৃত্তি, চুরি কিংবা যৌন শোষণের ফাঁদে পড়ে। অনেকে হয়তো চেষ্টাও করে স্বাভাবিক জীবন যাপনে কিন্তু সঙ্গদোষ তাকে বাধ্য করে খারাপ হতে, মাদকাসক্ত হতে। সম্প্রতি পথশিশুদের নিয়ে পরিচালিত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) গবেষণায় বলা হয়, দেশে ৫৮ শতাংশ পথশিশু মাদকাসক্ত। ১৪ শতাংশ শিশু ১০ বছর বয়সের আগেই মাদক সেবন করে। তুলনামূলক সহজলভ্য ও সস্তা হওয়ায় পথশিশুদের অধিকাংশই ড্যান্ডি সেবন করে। পথশিশুদের মধ্যে ৩১.৭ শতাংশ গাঁজা সেবন করে। পারিবারিক শৃঙ্খলা, শাসন ও আদর না থাকায় তারা মাদকে জড়িয়ে পড়ছে। মাদক গ্রহণের পাশাপাশি মাদক বিক্রিতেও তারা ব্যবহৃত হচ্ছে। শুধু রাজধানী ঢাকাতেই ড্যান্ডিতে আসক্ত পথশিশুর সংখ্যা প্রায় ৭৫ হাজার। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত পথশিশুদের কাছে কেউ যেন ড্যান্ডি বিক্রি না করে সে পদক্ষেপ গ্রহণ করা। অনাথ ও পথশিশুদের নিয়ে অনেক সময় বিত্তশালীদের কিছু মৌসুমভিত্তিক কার্যক্রম দেখা গেলেও স্থানীয় পুনর্বাসনের কার্যক্রম শূন্যের কোঠায়। বাস্তবতা হচ্ছে এ সমাজে মানুষ তাদের পোষা কুকুর, বিড়াল ও পাখিকে যে পরিমাণ সহানুভূতি প্রদর্শন করে তার একচতুর্থাংশ যদি এই অনাথ ও পথশিশুদের দেখাত তাহলে গোটা সমাজের পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীর চিত্রটাই পরিবর্তন হয়ে যেত। পথশিশুদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পুনর্বাসনের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় কারিগরি শিক্ষা প্রদান করার মাধ্যমে মানবসম্পদে পরিণত করা সম্ভব। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রের তথাকথিত জনদরদি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং কর্তাব্যক্তিরাই লুটপাটের যে মহাসমারোহে নিয়োজিত সেখানে অনাথ ও পথশিশুদের নিয়ে ভাবার সময় তাদের হয়ে ওঠে না। সংবিধানের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রতিটি শিশুর শিক্ষা গ্রহণের অধিকার রয়েছে। ২৮(৪) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নারীদের ও শিশুদের বিশেষ নিরাপত্তা ও সুবিধা দেওয়া হবে। অথচ বাস্তবতা বলছে, অনাথ ও পথশিশুরা এই ন্যূনতম অধিকার থেকেও বঞ্চিত। অনাথ ও পথশিশুদের জন্য রাষ্ট্রীয় সান্ত¡না হিসেবে প্রতিটি জেলায় সরকারি আশ্রয় কেন্দ্র ও শিশুপরিবার আছে। খোঁজখবর নিলে বুঝা যায় এসব প্রতিষ্ঠানের অবস্থা কতটা ভয়াবহ। অধিকাংশ জায়গায় খাদ্যের মান নি¤œমানের, শিশুদের জন্য আলাদা চিকিৎসক নেই, শিক্ষার মান খুবই দুর্বল। দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার কারণে সরকার যে টাকা বরাদ্দ করে তার বড় অংশই ভিন্ন খাতে চলে যায়। শিশুদের হাতে পৌঁছায় না পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার, ভালো বই বা দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ। উন্নত বিশ্বের তুলনায় সামাজিক কুসংস্কার ও আইনি জটিলতার কারণে আমাদের দেশে শিশু দত্তক নেওয়ার পরিমাণ খুবই কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রজনন বয়সি দম্পতিদের প্রায় ১৫ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের বন্ধ্যত্ব সমস্যার জন্য সন্তান ধারণে অক্ষম। রাষ্ট্র যথাযথ উদ্যোগ ও প্রচার-প্রচারণা কার্যক্রম গ্রহণ করলে এ ধরনের দম্পতিদের কাছে সহজেই অনাথ ও পথশিশুদের দত্তক প্রদানের মাধ্যমে সমাজের মূলধারায় বেড়ে উঠার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। যদি আইনি জটিলতায় দত্তক প্রদানের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান সম্ভব না হয় তাহলে সরকারি আশ্রমগুলোকে আধুনিক করতে হবে। খাদ্য, মানসম্মত শিক্ষা, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা, তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা, কর্মমুখী প্রশিক্ষণ সবকিছু নিশ্চিত করতে হবে। আশ্রমকে হতে হবে একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাকেন্দ্র। অর্থাৎ আশ্রম তথা শিশু পরিবারগুলোকে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাকেন্দ্রে পরিণত করতে হবে। সেই সঙ্গে এসব কার্যক্রম যথাযথভাবে পরিচালিত হওয়ার জন্য তদারকি দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সর্বদাই তৎপর থাকতে হবে। পথশিশুদের জন্য গৃহীত উদ্যোগগুলো যদি হঠাৎ করে হ্যালির ধূমকেতর মতো গ্রহণ করা হয় তাহলে সেগুলো তাদের জীবনমানের মৌলিক উন্নয়নে খুব একটা কাজে লাগবে না। তাই তাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি স্থায়ী কার্যক্রম চালু করতে হবে। আমরা এমন মানবিক রাষ্ট্র চাই যেখানে অনাথ ও পথশিশুদের একমুঠো ভাতের জন্য রাস্তায় নামতে না হয়। খাবারের অভাবে কাউকে ভিক্ষাবৃত্তি কিংবা চুরি করতে হবে না। রাষ্ট্রের কাছে প্রত্যাশা আমাদের উন্নয়নের গর্ববোধের গল্প যেন শুধু অবকাঠামোগত ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ না থাকে। উন্নয়নের গল্প যেন জীবনবোধে ধাবিত হয়। লাখো বঞ্চিত অনাথ ও পথশিশু যেন রাষ্ট্রীয়ভাবে সকলক্ষেত্রে সমান সুযোগ-সুবিধা লাভের মাধ্যমে জনশক্তিতে পরিণত হয়। তাদের জনশক্তিতে পরিণত করতে রাষ্ট্র যেন দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম চালু করে। পথচলতে তাদের দেখে যেন হৃদয় বীণায় ভেসে না ওঠে ‘অনাথের কেউ নেই বঞ্চিত সব কিছুতেই’।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন