ক্ষুধামুক্ত, বেকারত্বহীন ও কার্বন-নিঃসরণমুক্ত ‘তিন-শূন্য বিশ্ব’ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, এটি কোনো কল্পনা নয়, বরং মানবতার টিকে থাকার একমাত্র পথ। এ জন্য প্রয়োজন পুরোনো মুনাফাভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার এবং ন্যায়ভিত্তিক নতুন কাঠামো গঠন প্রয়োজন।
গতকাল সোমবার ইতালির রোমে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সদর দপ্তরে আয়োজিত বিশ্ব খাদ্য ফোরাম ২০২৫-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মূল বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ইউনূস। তিনি বৈশ্বিক খাদ্য ও অর্থনৈতিক কাঠামোর সংস্কার এবং ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গঠনের লক্ষ্যে ৬ দফা প্রস্তাব তুলে ধরেন।
ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের মাধ্যমে বিচার ও জনগণের ক্ষমতায়নের প্রতিশ্রুতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হবে বলে অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আজ সেই তরুণরাই আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠনে অংশ নিচ্ছে। তারা নতুন এক বাংলাদেশ গড়ছে, যেখানে জনগণই শাসনের কেন্দ্রে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে আমরা জাতীয় নির্বাচন করব এবং এর মাধ্যমে আমরা ন্যায় বিচার এবং জনগণের ক্ষমতায়নের প্রতিশ্রুতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিচ্ছি।
ছয় দফা প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে
১. যুদ্ধ বন্ধ ও সংলাপ শুরু :
সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে খাদ্য পৌঁছানোর নিশ্চয়তা দিতে হবে, যাতে ক্ষুধা ও যুদ্ধের দুষ্টচক্র ভাঙা যায়; ২. অর্থায়ন ও জলবায়ু পদক্ষেপ : টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে অর্থায়নের অঙ্গীকার পূরণ করতে হবে, জলবায়ু সংকটে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে টিকে থাকার সক্ষমতা গড়ে তুলতে সহায়তা দিতে হবে; ৩. আঞ্চলিক খাদ্য ব্যাংক : খাদ্য সরবরাহ চেইন স্থিতিশীল রাখতে আঞ্চলিক খাদ্য ব্যাংক গঠন জরুরি; ৪. তরুণ ও স্থানীয় উদ্যোক্তা সহায়তা : তরুণ কৃষি উদ্যোক্তা ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অর্থায়ন, অবকাঠামো ও বৈশ্বিক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে ক্ষমতায়ন করতে হবে; ৫. বাণিজ্যনীতি সংস্কার : খাদ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে এবং বাণিজ্যনীতিকে খাদ্য নিরাপত্তার সহায়ক করতে হবে; ও ৬. প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সুযোগ : বিশেষ করে গ্লোবাল সাউথের তরুণ কৃষক ও উদ্যোক্তাদের জন্য প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. ইউনূস বলেন, ‘‘২০২৪ সালে ৬৭৩ মিলিয়ন মানুষ ক্ষুধার্ত ছিল, অথচ আমরা পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন করেছি। এটি উৎপাদনের ব্যর্থতা নয়Ñ এটি অর্থনৈতিক ও নৈতিক ব্যর্থতা।’ তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘ক্ষুধা দূর করতে যেখানে কয়েক বিলিয়ন ডলার জোগাড় করা যায়নি, সেখানে বিশ্ব অস্ত্র কিনতে ব্যয় করেছে ২ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলারÑ একে কি আমরা অগ্রগতি বলব।”
নতুন অর্থনৈতিক কাঠামোর আহ্বান : প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের পুরোনো মুনাফাভিত্তিক ব্যবসা পদ্ধতি কোটি কোটি মানুষকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। এখন সময় এসেছে এমন এক নতুন ব্যবসা কাঠামো গড়ে তোলার যা সমস্যার সৃষ্টি করে না, বরং সমাধান দেয়। এই মডেল হলো সামাজিক ব্যবসা (সোশ্যাল বিজনেস) যা ব্যক্তিগত লাভের জন্য নয়, মানবকল্যাণের জন্য।”
তিনি উল্লেখ করেন, ‘বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংক দেখিয়েছে দরিদ্র নারীরাও উদ্যোক্তা হতে পারেন। গ্রামীণ দানোন শিশু অপুষ্টির বিরুদ্ধে কাজ করছে। এ রকম বহু সামাজিক ব্যবসা বিশ্বজুড়ে বাস্তব পরিবর্তন আনছে।’
তরুণদের ক্ষমতায়নের ওপর জোর : তরুণদের ভূমিকাকে গুরুত্ব দিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আজকের প্রজন্ম আগের তুলনায় বেশি সৃজনশীল, সংযুক্ত ও প্রযুক্তিনির্ভর। তাদের চাকরির অপেক্ষায় না রেখে চাকরি সৃষ্টির ক্ষমতায়ন করতে হবে।’ তিনি প্রস্তাব দেন, তরুণ ও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিনিয়োগ তহবিল ও সামাজিক ব্যবসা তহবিল গঠন করা উচিত। পাশাপাশি কৃষি উদ্ভাবন কেন্দ্র, কৃষি প্রযুক্তি, পরিবেশবান্ধব খাদ্য উৎপাদন ও জলবায়ু-স্মার্ট উদ্যোক্তা তৈরিতে সহায়তা দিতে হবে। ‘যদি আমরা তরুণদের ওপর বিনিয়োগ করি, তাহলে শুধু খাদ্য নিরাপত্তাই নয়, গোটা বিশ্বকেই বদলে দিতে পারব,’ বলেন অধ্যাপক ইউনূস।
বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা ও অঙ্গীকার: প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশ আজ ১৭ কোটি মানুষের খাদ্য নিশ্চিত করছে এবং মিয়ানমারের সহিংসতা থেকে পালিয়ে আসা ১৩ লাখ রোহিঙ্গাকেও আশ্রয় ও খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে।’ তিনি জানান, বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে, সবজি ও স্বাদুপানির মাছ উৎপাদনেও শীর্ষ দেশগুলোর একটি। কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ হয়েছে, ৭০% পর্যন্ত ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে, এবং জলবায়ু-সহনশীল ১৩৩ প্রজাতির ধান উদ্ভাবন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা ক্ষুধা ও দারিদ্র্যবিরোধী বৈশ্বিক জোটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। এফএও ও জি-২০-এর সঙ্গে আমরা প্রযুক্তিগত, আর্থিক ও নৈতিক সহায়তায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
‘তিন-শূন্য বিশ্ব’ : ভবিষ্যতের রূপরেখা : অধ্যাপক ড. ইউনূস বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হলো একটি ‘তিন-শূন্য বিশ্ব’। অর্থাৎ শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য কার্বন নিঃসরণ। এটি কোনো কল্পনা নয়, এটি বাস্তব প্রয়োজনÑ বিশ্বকে বাঁচানোর একমাত্র উপায়।’ তিনি যোগ করেন, ‘এই ফোরামের তিনটি স্তম্ভ-তরুণ, বিজ্ঞান ও বিনিয়োগÑ শুধু স্লোগান নয়, এগুলোই আমাদের খাদ্যব্যবস্থা ও সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার।’
বক্তৃতার শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা এফএও’র ৮০ বছর পূর্তিকে ‘ভবিষ্যতের প্রস্তুতির আহ্বান’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, ‘খাদ্য শুধু ক্যালরির বিষয় নয়; এটি মর্যাদা, ন্যায় ও মানবতার প্রতীক।’
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন