- ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন ভুক্তভোগীরা। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত সবাই
- ভয়ে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায় প্রায় সবার। চিৎকার করেন অনেকেই
- হায়েস গাড়ি দেখলে ভয় পান অনেকে। কেউ গানের শব্দ বা লাক্স সাবানের ঘ্রাণে অস্থির হয়ে যান
‘মা-মরা ছেলেটা আমার। লেখাপড়া করত, গুম থেকে ফেরার পর সব শেষ। ও বসে থাকত, হঠাৎ রেগে যাইতো। কেউ কথা জিগাইলেই থাপড় দিত। এখনও খালি একা একা হাসে, কিছু কইলে ফেনায়, ঠিকমতো কথা কয় না। ডাক্তার দেখাইলাম, ওষুধ দেয়, খায় না। কয় শরীর কাঁপে, ঘুমে ধরে। ওষুধ ফালায় দেয়। ডাক্তার কয়, নিয়মমতো ওষুধ খাওয়াইতে হইবো’, রাজ্যের হতাশা নিয়ে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন ১৬ বছরের এক কিশোর ভুক্তভোগীর বাবা। তার ছেলে ২০১৯ সালে র্যাব গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-৩ কর্তৃক অপহৃত হন। দীর্ঘ ১ বছর ৮ মাস ১৩ দিন গুম ছিলেন।
ভুক্তভোগী ওই বাবা বলেন, ‘আমার ছেলে পাইলাম, এইটাই বড় কথা। সবাই কয়, যা হইছে হইছে, এখন খাইয়া-পইরা বাঁচ। কিন্তু আমি জানি কত কথা হজম কইরা এই পর্যন্ত আইছি। এখন আমি আর উকিলের কাছেও যাই না, কারণ টাকা-পয়সার অভাব।’
শুধু ভুক্তভোগী ওই কিশোরই নয়, আওয়ামী সরকারের আমলে গুমের শিকার ব্যক্তিদের লোমহর্ষক নির্যাতনে অনেক ভুক্তভোগীরই এখনো অজানা আতঙ্কে দিন কাটছে। ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে মানসিকভাবে দীর্ঘমেয়াদি ট্রমাটাইজ তারা। গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের প্রামাণ্যচিত্রে ভুক্তভোগীদের বয়ানে এসব বিষয় উঠে এসেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের মূল ভূমিকায় ছিলÑ র্যাব, বাংলাদেশ পুলিশ, ডিবি, সিটিটিসি, ডিজিএফআই ও এনএসআই। এসব বাহিনীর সদস্যদের তত্ত্বাবধানে গুমের শিকার ব্যক্তিদের দিনের পর দিন আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতন করা হয়।
গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, অমানুষিক নির্যাতনের ফলে ভুক্তভোগীরা দীর্ঘদিনের জন্যই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। অনেক ভুক্তভোগী এখন হায়েস গাড়ি দেখলে ভয় পান, কেউ কেউ এসিরুম ভয় পান। কেউ বা সাবানের ঘ্রাণ, কেউ আবার নির্দিষ্ট কিছু গান বা শব্দ শুনলে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কারণ ভুক্তভোগীদের গোপন বন্দিশালা থেকে নির্যাতনের জন্য সাউন্ডপ্রুফ কক্ষে নিয়ে যাওয়া হতো।
সেখানে কখনো চোখে গামছা বেঁধে, কখনো যমটুপি পরিয়ে হাত ওপরে বেঁধে বেধড়ক পেটানোসহ নানা ধরনের নির্যাতন করা হতো। গোপন বন্দিশালায় মাস ও বছরের পর বছর রাখা হতো। নির্যাতনের জন্য সেখানে বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার চেয়ার, ঘূর্ণায়মাণ চেয়ার, হাত-পা বাঁধার বিশেষ রশি, নখ তুলে ফেলাসহ শারীরিক নির্যাতনের জন্য বিভিন্ন যন্ত্র রাখা হতো। এসব কক্ষ র্যাব ও ডিজিএফআই ব্যবহার করত।
২২ বছরের ভুক্তভোগী এক যুবক র্যাব গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১০ কর্তৃক ১৩৪ দিন গুম ছিলেন। তিনি বলেন, টর্চার সেলে শুধু চিৎকারের আওয়াজ আসত। ফলে গান বাজিয়ে মারধর করা হতো। ওই গানের সাউন্ড আসতেই আমি ঠিক থাকতে পারি না। তিনি বলেন, আমি গানটা কয়েকবার দেখার চেষ্টা করছি। কিন্তু ঠিকমতো দেখতে পারি না। গানটা ছিলÑ চিটিয়া কালিয়া রে... গভীর রাতে আতঙ্কে এখনো ঘুম ভেঙে যায়।
কমিশন সদস্য জানতে চানÑ ওই গানটা আপনি দেখতে পারেন নাই? উত্তরে ভুক্তভোগী যুবক বলেন, জি, ওই গানটা আমি কয়েকবার দেখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু দেখতে পারিনি।
তিনি বলেন, প্র¯্রাব-পায়খানার জন্য ফ্লোরে বাইড়াতে হইতো। তাহলে তারা আসতো। দেখা গেছে, প্র¯্রাবে ধরছে। ওদিকে একজনকে মিউজিক ছেড়ে পেটাচ্ছে। ফলে প্র¯্রাবের জন্য ফ্লোরের আওয়াজ ওই গানের আওয়াজের জন্য তাদের কাছে পৌঁছায় না। এ রকম হইছে সইতে না পেরে প্রশ্রাব-পায়খানা করে দিসে, আমার সামনে। এটা আবার তারে দিয়েই পরিষ্কার করায়।
অপর এক ভুক্তভোগী। যার বয়স ছিল ৩৫ বছর। তিনি এনএসআই কর্তৃক অপহৃত হয়ে ১৪ দিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন। তিনি বলেন, বাথরুমে একটা লাক্স সাবান ছিল। এখন ওই লাক্স সাবানের ঘ্রাণ পেলে আমার মাথা কাজ করে না। সাবানের ওই স্মেলটা পেলে আমার ভেতরে অস্থিরতা চলে আসে। আমি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যাই।
গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন জানায়, বন্দিশালার কক্ষগুলো অত্যন্ত ছোট ও সংকীর্ণ ছিল। স্যানিটেশনের জন্য শুধু একটি বিল্ট-ইন প্যান ব্যবহার করতে হতো। তবে মাঝে কোনো দেয়াল না থাকায়, ভুক্তভোগীরা যখন শুয়ে থাকতেন, তখন তাদের শরীর প্রায়শই ওই প্যানের ওপরেই পড়ে থাকত। যার ফলে তারা ময়লা, প্রস্রাব ও মলের অস্বাস্থ্যকর অবস্থার মধ্যে থাকতে বাধ্য হতেন। আরো ভয়াবহ ছিল, এসব সেলে স্থাপন করা সিসিটিভি ক্যামেরা, যা প্রতিটি কর্মকা- পর্যবেক্ষণ করত। ফলে ভুক্তভোগীদের সবচেয়ে ব্যক্তিগত মুহূর্তেও, যেমন প্রাকৃতিক কাজের জন্য টয়লেট প্যান ব্যবহারের সময়ও, চরম অপমান ও লজ্জার মধ্যে থাকতে হতো।
ভুক্তভোগীদের ১০ ধরনের শারীরিক নির্যাতন করা হতো। নির্যাতনে শরীরে ক্ষত সৃষ্টি হলে ওষুধ ও মলম দেওয়া হতো। এরপর শরীরের দাগ মুছলে তাদের জনসমক্ষে আসামি হিসেবে উপস্থাপন করা হতো। ফলে মুক্তির পরও নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরা দীর্ঘমেয়াদি মানসিক ট্রমার বহন করেন। তাদের চলমান চিকিৎসা ও মনোস্বাস্থ্য সহায়তার প্রয়োজন হয়, এবং অনেকের শিক্ষা ও কর্মজীবন ব্যাহত হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় নিরাপত্তা বাহিনীর দায়ের করা ভুয়া মামলাগুলোর আইনি লড়াইয়ের ব্যয়; প্রতিটি মামলার জন্য একজন ভুক্তভোগীর গড়ে প্রায় ৭ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। অনেকের পারিবারিক জীবন, যেমন বিয়ে ও সন্তান-সম্পর্কিত বিষয়, মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবারগুলো এই চাপ সহ্য করতে পারে না, ফলে ভুক্তভোগীরা এক অনিশ্চয়তা ও প্রান্তিকতার জীবনে আটকে পড়েন।
প্রমাণ্যচিত্রে গুম কমিশনের সদস্য নুর খান বলেন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গোপন বন্দিশালা নির্যাতনের পরে যে মানুষগুলো মুক্তি পেয়েছে, জীবন নিয়ে ফিরে এসছে। তারা কিন্তু ওই নির্মমতা ভুলতে পারেননি। অনেক ভুক্তভোগীর এখনো গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যায়। চিৎকার করেন। তারা ওই ট্রমার থেকে এখনো বেরিয়ে আসে নাই। শুধু যে তারাই বেরিয়ে আসে নাই তা না। এই সমাজটাও কিন্তু এক ধরনের ভীতিকর ভয়ার্ত পরিবেশের মধ্যে প্রবাহিত।
গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্য ড. নাবিলা ইদ্রিস বলেন, অনেক ভুক্তভোগী সঙ্গে কথা বলে জানা গেছেÑ তাদের অনেকেই ট্রমায় আক্রান্ত। কেউ হায়েস গাড়ি ভয় পান, কেউ গান, এসিরুমসহ নানা বিষয়ে আতঙ্ক কাজ করে এখনো।
তিনি বলেন, সব ধরনের মানুষ ছিলেন ভুক্তভোগী। দিনমজুর ভুক্তভোগী এসেছেন আমাদের কাছে, অত্যন্ত ধনী ভুক্তভোগী আসেন, কলেজ-বিশ^বিদ্যালয় পড়–য়া ছাত্র আসেন যেমন, তেমন নারী ভুক্তভোগীও আছে। এমনকি দশ বছরের কম বয়সি ভুক্তভোগী আমাদের কাছে আসেন।
তেজগাঁও ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বেলাল হোসেন ২০১৫ সালে গুমের শিকার হন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, যারা গুমের শিকার হয়ে বেঁচে ফিরেছেন, তারা ট্রমার মধ্যে আছেন। আর যারা ফেরেননি তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা একমাত্র আল্লাহ জানেন। সেখানে যে কদিন রাখা হয়েছে, সেই দিনগুলো যেন জাহান্নামের ভেতরে ছিলাম। প্রতিটি সেকেন্ড কেটেছে মৃত্যুভয়ে। সেই নির্মম কষ্টের জন্য যারা দায়ী, তাদের অবশ্যই মৃত্যুদ-ের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তাদের ওই রকম কষ্টের মধ্য দিয়ে মৃত্যুর মুখে নিতে হবে। তাহলে হয়তো এই ভয়াবহ অপরাধ কমতে পারে।
প্রামাণ্যচিত্রে নিজের ওপর হওয়া ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে আহমাদ বিন কাসেম আরমান বলেন, দিনের বেলা চোখ বেঁধে ও হাতকড়া পরিয়ে রাখত। রাতের বেলা পিছমোড়া করে বেঁধে হাতকড়া পরিয়ে রাখত। কেন জানতে চাইলে তারা কিছু বলত না। নামাজের সময় পর্যন্ত দিত না। আট বছর ধরে তারা আমাকে নারকীয় অভিজ্ঞতা দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের অর্থনৈতিক পুনর্বাসন করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের পুনর্বাসনের জন্য আলাদা কমিশন বা কমিটি গঠন করা হোক। যারা গুম করেছে তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে। নইলে বিচারের বাণী আজীবন কাঁদবে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন