আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে চলছে নানা মেরুকরণ। কে কার সঙ্গে জোট করে ভোটের মাঠে লড়বেÑ এ নিয়ে চলছে নানা চুলচেরা বিশ্লেষণ আর দৌড়ঝাঁপ। সব ইসলামী দল নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে একটি বৃহৎ জোট হওয়ার কথা থাকলেও নানা দলের আপত্তিতে তা কিছুটা গতি হারিয়েছে। পিআর পদ্ধতিতে ভোটের দাবিতে যুগপৎভাবে এসব দল মাঠে থাকলেও জোট নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। বেশ কয়েকটি ইসলামি দলের প্রকাশ্যে শঙ্কা ও আপত্তি থাকায় শেষ পর্যন্ত জোট হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন কয়েকটি দলের শীর্ষ নেতারা।
আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে নানান অঙ্ক কষছে জামায়াত। জুলাই সনদের ভিত্তি ও পিআর পদ্ধতিতে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ পাঁচ দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলো নিয়ে নির্বাচনি জোটের চেষ্টায় আরও কিছু ছোট দলকে যুক্ত করার চেষ্টা করছে তারা। জামায়াতের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের নির্বাচনে মনোনয়ন দেয় না জামায়াত, এমন সমালোচনা প্রচলিত রয়েছে।
তবে ডাকসু ও জাকসুতে শিবিরের ভূমিধস বিজয় হয়েছে। সেই জায়গা থেকে আগামী নির্বাচনেও প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে পরিবর্তনের চিন্তা-ভাবনা চলছে। যেখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও আদিবাসীদের মধ্য থেকে দেওয়া হতে পারে মনোনয়ন। বিশেষ করে বিএনপিকে টেক্কা দিতে এবার ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থী করার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হচ্ছে। দলীয় সর্বোচ্চ ফোরামের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগ্রহ ও যোগ্যতা অনুযায়ী বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। অন্যদিকে জোটের ক্ষেত্রে শরিকদের জন্য সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে জোরেশোরে নির্বাচনি প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি।
জামায়াতে ইসলামী দলের সূত্রে জানা যায়, তৃণমূলের ভোটে ২৯৮টি আসনে প্রার্থী বাছাই করেছে দলটি। যদিও দুটি আসনে চেইন অব কমান্ডের ঐতিহ্য ভেঙে প্রার্থী নিয়ে প্রকাশ্যে অসন্তোষের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘ সময়ের জোটসঙ্গী ও পরবর্তী সময়ে যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী জামায়াতে ইসলামী এখন বিএনপির মিত্র থেকে নির্বাচনি ময়দানে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়িয়েছে। সংস্কার, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা এবং যুক্তি-তর্কেও কয়েকটি বিষয়ে বিএনপির বিপরীত অবস্থানে রয়েছে জামায়াত। বিশেষ করে উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতি নিয়ে দূরত্ব আরও স্পষ্ট হয়েছে। যদিও শুধু বিএনপি নয়, নি¤œকক্ষে পিআর বিষয়ে রাজি নয় এনসিপিসহ অনেক ইসলামি দলও।
রজনৈতিক জোটের বিষয়ে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের জানান, নির্বাচনের এখনো অনেক সময় বাকি রয়েছে। নানা সমীকরণ তো বিবেচনায় থাকে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে আরও কিছু সময়ের প্রয়োজন। একই সাথে সমঝোতা হলে জামায়াতের প্রার্থীরা ছাড় দেবেন এবং প্রয়োজনে কিছু আসনে নির্বাচন থেকেও সরে যাবেন।
জামায়াতের এক জ্যেষ্ঠ নেতা নাম না প্রকাশ করার শর্তে জানান, পিআর পদ্ধতি নিয়ে আন্দোলন চলছে এবং এ দাবিতে শেষ পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবে জামায়াত। দাবি আদায় না হলেও বিদ্যমান পদ্ধতিতে কীভাবে নির্বাচনে ভালো ফল আসবে, সেই প্রস্তুতিও নিচ্ছে দল।
তবে ইসলামি দলগুলোর নির্বাচনি জোট নিয়ে যখন হিসাব-নিকাশ চলছে, তখন সেখানে জামায়াতকে ভোট দিতে সরাসরি নিরুৎসাহী করেছেন হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী। এক সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘কুফরি যাতে প্রতিষ্ঠা করতে না পারে, সে জন্য সামনের নির্বাচনে ভোট দেওয়া যাবে না। যারা পূজা আর রোজা একই বলে, এগুলো কি ইসলাম? নবী ও রাসুলদের দেখানো সোজা রাস্তায় চলতে হবে। তাহলে দুনিয়া ও আখিরাত ঠিক থাকবে। সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি। তাদের দেখানো রাস্তা সোজা রাস্তা।’
তবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে হেফাজত আমিরের বক্তব্য তার ব্যক্তিগত। এর দায় হেফাজতে ইসলাম নেবে না বলে দাবি করেন হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক। তিনি বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম সরাসরি কখনোই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বা রাজনৈতিক তৎপরতার সঙ্গে জড়িত নয়; বিশেষ করে দলীয় রাজনীতির সঙ্গে হেফাজতের কোনো সাংগঠনিক সম্পৃক্ততা নেই। সে হিসেবে নির্বাচনি তৎপরতা, কোনো জোট বা অ্যালায়েন্স করা হেফাজতের মৌলিক নীতিমালার পরিপন্থি। সেটি করার সুযোগ নেই।’
জোটের বিষয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাই পীর মুফতী সৈয়দ রেজাউল করিম জানান, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে কোনো ইসলামী জোট গঠন করা হবে না। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা চলছে। অধিকাংশ দল ইতিমধ্যে এ বিষয়ে ঐকমত্য প্রকাশ করেছে। তবে চূড়ান্তভাবে নির্বাচনে কোনো জোট তৈরি হবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচনে অংশ নেওয়া দলগুলোর সমর্থন ও সমন্বয় নিশ্চিত করতে আসনভিত্তিক একটি লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করা হবে। এটি নির্বাচনি প্রস্তুতি ও পদক্ষেপগুলো সমন্বিতভাবে বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এই পদক্ষেপ মূলত দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা।’
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী বলেন, ‘নির্বাচনে জোটের ক্ষেত্রে আমাদের মূলনীতি স্পষ্ট। এমন কারো সঙ্গে জোট করতে চাই না, যার ফলে হাজার বছরের ইসলামি শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিন্তা ও দর্শন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে জোট হলে অন্তত সরাসরি ইসলামের ক্ষতি আমরা দেখি না। কারণ বিএনপি একটি রাজনৈতিক দল, তারা নিজেকে ইসলামি দল বলে দাবি করে না।’
প্রসঙ্গত, দেশে নিবন্ধিত ইসলামি রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ১০টি। একই সাথে কয়েকটি অনিবন্ধিত ইসলামি রাজনৈতিক সংগঠন মাঠে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। এসব দলের মধ্যে ইতিপূর্বে একাধিকবার ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা হলেও শেষ পর্যন্ত তা আলোর মুখ দেখেনি। মতাদর্শগত ভিন্নতা, নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা ও সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতার কারণে প্রতিবারই ঐক্য প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ১৯৯৬ সালের পর এককভাবে নির্বাচন করেনি জামায়াতে ইসলামী। তবে ২০০১ সালে ৩১, ২০০৮ সালে ৩৮ এবং ২০১৮ সালে ২২টি আসনে বিএনপির সঙ্গে জোট করে জামায়াত। এরপর ২০২০ সালে বিএনপি ছাড়ে দলটি। বিগত আওয়ামী সরকারের সময়ে বিভিন্ন আন্দোলনে রাজপথে থাকলেও গত বছরের ৫ আগস্টের পর বিএনপির সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্কে পরিবর্তন আসে দলটির।