ঢাকা শুক্রবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২৫

রাকসু নির্বাচন

পাল্টাপাল্টি অভিযোগে শেষ ভোট, গণনায় ১২-১৫ ঘণ্টা

রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশিত: অক্টোবর ১৭, ২০২৫, ১২:০৩ এএম
  • মোট ভোট পড়েছে ৬৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ
  • অভিযোগ ছিল অমোচনীয় কালি উঠে যাওয়া নিয়ে
  • ছাত্রদলের বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবিরের নামে গুজব ছড়ানোর অভিযোগ
  • ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে কয়েকটি কেন্দ্রে ভোট বন্ধ রেখে কারচুপির অভিযোগ ছিল
  • ব্যবস্থাপনায় কিছু ত্রুটি ছিল: রাকসু নির্বাচন পর্যবেক্ষণ কমিটি

বড় ধরনের অনিয়ম বা গোলযোগ ছাড়াই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু), হল সংসদ ও সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন শেষ হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত একটানা ভোটগ্রহণ চলে। এ সময় কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলার ঘটনা না ঘটলেও ছাত্রদল সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম’ ও ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’-এর পাল্টাপাল্টি অভিযোগ রয়েছে। রাকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক এফ নজরুল ইসলাম ৬৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানিয়েছেন। এছাড়া রাকসু নির্বাচন কমিশনার মোস্তফা কামাল আকন্দ জানিয়েছেন, সন্ধ্যা ৬টা থেকে শুরু হয় ভোট গণনা। গণনা শেষে ফল প্রকাশে লাগতে পারে ১২ থেকে ১৫ ঘণ্টা। এদিকে ভোটগ্রহণে কোনো অসংগতি চোখে না পড়লেও ব্যবস্থাপনায় কিছু ত্রুটি ছিল বলে জানিয়েছে রাকসু নির্বাচন পর্যবেক্ষণ কমিটি।

গতকাল সকাল থেকেই বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রগুলোতে ভোটারদের ভিড় বাড়তে থাকে। ভোটাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজ নিজ পছন্দের প্রার্থীদের ভোট দিয়েছেন। নির্ধারিত সময় শেষে অনেক কেন্দ্রে এখনো ভোটারদের লাইন দেখা গেছে। লাইনে থাকা এসব ভোটারের ভোটদানের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পাঁচ মিনিট আগে এখনো যারা ভোট দেননি, তাদের লাইনে দাঁড়ানোর আহ্বান জানানো হয়। এরপর কেন্দ্রের গেট বন্ধ করে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন করা হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে ভোট গণনার কাজ শুরু হয়।

তবে অমোচনীয় কালি উঠে যাওয়া, ছাত্রদলের বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবিরের নামে গুজব ছড়ানো, অন্যদিকে ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে কয়েকটি কেন্দ্রে ভোট বন্ধ রেখে কারচুপি ও ক্যাম্পাসে বহিরাগত ঢুকিয়ে প্রভাব বিস্তারসহ ভোটগ্রহণ নিয়ে কিছু অভিযোগ ছিল প্রার্থীদের।

ভোট গণনায় লাগতে পারে ১২-১৫ ঘণ্টা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে (রাকসু) নির্বাচন কমিশনার মোস্তফা কামাল আকন্দ জানিয়েছেন, ৯টি ভবনে ভোটগ্রহণ শেষে সব ব্যালট বাক্স নেওয়া হয় কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে। ভোট গণনার সুবিধার্থে ১০০টি করে ব্যালট দিয়ে পৃথক বান্ডেল করা হবে। এ বান্ডেলের ভোট গণনা হবে ওএমআর মেশিনে, যা পর্যবেক্ষণ করবে বিশেষজ্ঞ প্যানেল।

সব মিলিয়ে তিন ধাপে চূড়ান্ত ফল তৈরি হবে। একটি হলের ফল তৈরি শেষে আরেকটির গণনা শুরু হবে। তাতে ২৮৩টি পদের ফল জানাতে ১২ থেকে ১৫ ঘণ্টা সময় লাগতে পারে।

এর আগে সকালে নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক পারভেজ আজহারুল হক বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কোথাও কোনো সমস্যা হয়নি।

ছাত্রদল-শিবিরের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

সকাল থেকে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট চললেও দুপুরের পর পরিস্থিতি কিছুটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ছাত্রদল ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সমর্থকদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি অভিযোগের ঘটনায়। উভয় সংগঠন একে অপরের বিরুদ্ধে নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছে।

ছাত্রদল অভিযোগ করেছে, সকাল থেকে তাদের প্রার্থীদের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়েছে অথচ শিবির সমর্থিত প্রার্থীরা প্রবেশ করেছে। অপরদিকে ছাত্রশিবিরের দাবি, ছাত্রদলের প্রার্থীরা প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে ভোট প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ঘটাচ্ছে এবং তাদের হেনস্তা করছে।

সকালে ভোটের শুরুতেই সিরাজী ভবনের সামনে চিরকুট নিয়ে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) পদপ্রার্থী মোস্তাকুর রহমান জাহিদ।

তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল চিরকুট নিয়ে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করা যাবে। কিন্তু বাস্তবে একাধিক স্থানে আমাদের সমর্থকদের প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘ছাত্রদল নিয়ম তোয়াক্কা না করে খালেদা জিয়া হল ও হবিবুর রহমান হলের পাশে বুথ স্থাপন করেছে। অথচ বুথ স্থাপনের কোনো অনুমতি ছিল না। বহিরাগত ছাত্রদল, যুবদল ও বিএনপির অনেকে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেছে। এরা কেউ ভোটার বা প্রার্থী নন, তবুও তারা ভোটকেন্দ্রে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।’

তিনি বলেন, ‘গতকাল নিয়ম ভেঙে দেয়াল লিখন করা হয়েছে। কিন্তু প্রশাসন এ বিষয়ে নীরব ভূমিকা পালন করছে। যারা নির্বাচনের নিয়মনীতি ভঙ্গ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।’

এদিকে রাকসু নির্বাচনে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন ছাত্রদল মনোনীত ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) পদপ্রার্থী শেখ নুর উদ্দিন আবির। তিনি বলেন, ‘এক ঘণ্টা ধরে ভোটগ্রহণ বন্ধ রেখে পোলিং অফিসার নিজ হাতে সিগনেচার করে ব্যালট পেপারে ভোট দিচ্ছেন এবং তা ব্যালট বক্সে ফেলছেন। অথচ নিয়ম অনুযায়ী একজন অফিসার ১৫-২০টি ব্যালটে সিগনেচার করতে পারেন’ কিন্তু তারা নিজেরাই বিপুল পরিমাণ ব্যালটে ভোট দিচ্ছেন।’

তিনি অভিযোগ করেন, ‘বিএনসিসি ও রোভার স্কাউটের কিছু সদস্য নির্বাচনি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে শিবির-সমর্থিত প্রার্থী ও ভোটারদের প্রবেশের সুযোগ দিচ্ছেন। অথচ আমি নিজে ভিপি প্রার্থী হয়েও ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারিনি। এটি নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।’

এদিকে নির্বাচনের দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রবেশ ফটকের পাশে ‘জামায়াত-শিবিরের লোকজন’ নিজেদের মধ্যে ‘অস্ত্র বিলি’ করছে বলে অভিযোগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সভাপতি সুলতান আহমেদ রাহী। বেলা সাড়ে ১১টায় ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি ভিডিও শেয়ার করে তিনি লিখেছেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটের বিপরীতে প্রকাশ্যে নিজেদের মধ্যে অস্ত্র বিলি করছে জামায়াত শিবিরের লোকজন।’

এ বিষয়ে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) পক্ষ থেকে বলা হয়, রাকসু নির্বাচনের দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের একটি বাগানের ভেতরে কিছু লোকের অস্বচ্ছ ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো হয়েছে। ভিডিওতে দাবি করা হয়েছে, একটি রাজনৈতিক দলের লোক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটের বিপরীত পাশে প্রকাশ্যে অস্ত্র বিতরণ করছে।

পুলিশের তদন্তে দেখা গেছে, বাস্তবতা একেবারে ভিন্ন। ভিডিওতে ধরা পড়েছে, বিভিন্ন দলের সমর্থক ও স্থানীয় উৎসুক লোকজন বাগানের পায়ে হাঁটা পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। গাছের ছায়ায় আড্ডা দিচ্ছেন এবং খাওয়া-দাওয়া করছেন।

এদিকে শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের কারণে রাকসু নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেও কিছু অভিযোগ ছিল বলে জানিয়েছে বামপন্থি ছাত্রসংগঠনগুলোর প্যানেল ‘গণতান্ত্রিক শিক্ষার্থী পর্ষদ’। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন মার্কেটের আমতলা চত্বরে সংবাদ সম্মেলন করে পর্ষদের প্রার্থীরা এই অভিযোগ জানান।

পর্ষদের ভিপি পদপ্রার্থী ফুয়াদ রাতুল বলেন, গণতান্ত্রিক শিক্ষার্থী পর্ষদের প্রতিনিধিরা সকাল থেকে ভোটকেন্দ্রগুলো পর্যবেক্ষণ করেছে। তাতে দেখা গেছে, রাকসু নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। সেই জায়গা থেকে এই নির্বাচনকে অনেকটাই অংশগ্রহণমূলক বলা যায়।

তবে সারা দিনের পর্যবেক্ষণে কিছু অনিয়ম পাওয়া গেছে বলে জানান রাতুল। তিনি বলেন, রাকসু নির্বাচনের শুরু থেকেই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড (সবার জন্য সমান সুযোগ) ছিল না। কিছু প্যানেল শিক্ষার্থীদের মধ্যে উপহার বিতরণ করছে, ভূরিভোজের আয়োজন করছে। কিন্তু এসব কাজের বিরুদ্ধে প্রশাসন তেমন কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি।

অসংগতি চোখে পড়েনি, ব্যবস্থাপনায় কিছু ত্রুটি ছিল: রাকসু নির্বাচন পর্যবেক্ষণ কমিটি

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচন পর্যবেক্ষণে ৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছিলেন উপাচার্য সালেহ্ হাসান নকীব। নির্বাচন শেষে গতকাল সন্ধ্যায় এক ব্রিফিংয়ে এই কমিটিতে থাকা শিক্ষকেরা বলেছেন, ভোটগ্রহণে কোনো অসংগতি চোখে পড়েনি। তবে ব্যবস্থাপনায় কিছু ত্রুটি ছিল।

ভোটগ্রহণ শেষে সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবনে ব্রিফিংয়ে রাকসু নির্বাচন পর্যবেক্ষণ কমিটির সভাপতি ও অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এম রফিকুল ইসলাম এই মন্তব্য করেন। এ সময় এই কমিটির সদস্য সাবেক অধ্যাপক মো. শফিকুল আলম ও সৈয়দ জাবিদ হোসেন তার পাশে ছিলেন। এই কমিটির মোট ৯ জন সদস্য আজ দিনভর রাকসু নির্বাচনের কেন্দ্রগুলো পরিদর্শন করেন।

ব্রিফিংয়ে অধ্যাপক এম রফিকুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন কেন্দ্রে গিয়ে প্রিসাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তা, প্রার্থীদের এজেন্ট এবং ভোটারদের সঙ্গে কথা বলেছি, ভোটগ্রহণ সম্পর্কে জানতে চেয়েছি। এ সম্পর্কিত একটা লিখিত প্রতিবেদন রেজিস্ট্রার বরাবর পাঠানো হয়েছে। সার্বিকভাবে বলা যায়, নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে।

রাকসু নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা শেষ হয় গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টায়। নির্বাচনে ছাত্রদল ও শিবির সমর্থিত প্যানেলসহ মোট ১১টি প্যানেল অংশ নিয়েছে। সিনেটের ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের ৫টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৫৮ জন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭টি হল সংসদের ১৫টি পদের বিপরীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মোট ৫৯৭ জন প্রার্থী। এবারের নির্বাচন ৯টি ভবনের ১৭টি ভোটকেন্দ্রে ৯৯০টি বুথে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। রাকসু ও সিনেট নির্বাচনে মোট ভোটারসংখ্যা ২৮ হাজার ৯০১ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার ১১ হাজার ৩০৫ জন এবং পুরুষ ভোটার ১৭ হাজার ৫৯৬ জন।