বাংলাদেশ ও চীনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক গত এক দশকে যে গভীরতা অর্জন করেছে, তা দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক মানচিত্রে এক নতুন অধ্যায় খুলে দিয়েছে। ১৯৭৫ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক ক্রমশ শক্তিশালী হয়েছে। তবে ২০১০ সালের পর থেকে এটি এক ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। বিশেষ করে যখন চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার এবং অন্যতম প্রধান বিনিয়োগ উৎসে পরিণত হয়েছে। ২০২৪ সালের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে চীনের প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রায় ৩৩০ কোটি মার্কিন ডলার, যা ২০১৮ সালের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রবৃদ্ধি শুধু সংখ্যায় নয়, বরং খাতভিত্তিক বৈচিত্র্য ও প্রযুক্তিনির্ভর উন্নয়নের দিক থেকেও তাৎপর্যপূর্ণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চীনের এফডিআই স্টক ছিল ২.৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০১৮ সালের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখন চীনের প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী দেশের তালিকায় অন্যতম। প্রতিবছর শত শত বাংলাদেশি প্রকৌশলী, তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও সরকারি কর্মকর্তা চীনে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সব দিক বিবেচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক আজ একটি অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রতীক। চীনের প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ বাংলাদেশের শিল্পায়ন, জ্বালানি নিরাপত্তা ও ডিজিটাল রূপান্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে এই সম্পর্ক যেন ঋণনির্ভরতা বা একক নির্ভরতার ফাঁদে না পড়ে, সে বিষয়ে সতর্কতা অপরিহার্য।
তাদের মতে, বাংলাদেশের প্রয়োজন স্বচ্ছ বিনিয়োগ নীতি, প্রযুক্তি স্থানান্তর বাধ্যবাধকতা এবং স্থানীয় অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা। শুধু তখনই এই অংশীদারিত্ব বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির চালিকা শক্তি হয়ে উঠবে। মূলত অবকাঠামো, জ্বালানি, যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তি, শিল্পাঞ্চল উন্নয়ন ও ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে চীনের ব্যাপক আগ্রহ এখন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে নতুন এক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
সরকারি ও বেসরকারি সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, চীনের বিনিয়োগ বৃদ্ধির পেছনে মূল কারণ হলো বাংলাদেশের বাজারের সম্ভাবনা, সাশ্রয়ী শ্রম, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে কৌশলগত অবস্থান এবং স্থিতিশীল রাজনীতি। চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি সংস্থাগুলো বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপকভাবে যুক্ত হয়েছেÑ বিশেষ করে সেতু, সড়ক, বন্দর, রেল ও বিদ্যুৎ খাতে। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প এবং কর্ণফুলি টানেল, পায়রা বন্দর, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের পার্শ্ববর্তী সড়ক অবকাঠামো নির্মাণে চীনা কোম্পানিগুলোর উপস্থিতি দৃশ্যমান।
বাংলাদেশের প্রযুক্তি খাতেও চীনের সম্পৃক্ততা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো, মোবাইল নেটওয়ার্ক, টেলিকম যন্ত্রাংশ, স্মার্টফোন অ্যাসেম্বলি এবং সোলার পাওয়ার প্রযুক্তিতে চীনা বিনিয়োগ বাংলাদেশের ডিজিটাল অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। হুয়াওয়ে, শাওমি, অপ্পো, ট্রানশিয়ন ও জেডটিইর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে সরাসরি উৎপাদন ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালনা করছে। তথ্যপ্রযুক্তি পার্কগুলোর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে চীনা সংস্থাগুলো নতুন স্টার্টআপ ও উদ্যোক্তা ইকোসিস্টেম গড়ে তুলছে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষক এবং বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে চীনের ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না, তবে এই বিনিয়োগ যেন প্রকৃত শিল্পায়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত হয়Ñ সেটিই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের উচিত বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, প্রতিযোগিতা ও স্থানীয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। ভবিষ্যতের দিকে তাকালে দেখা যায়, বাংলাদেশ-চীন অর্থনৈতিক সম্পর্ক কেবল বিনিয়োগ বা অবকাঠামোতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি প্রযুক্তি, শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়নের ক্ষেত্রেও নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে।
তিস্তা প্রকল্পে চীনা ঋণ
চীনা ঋণে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার। গত মার্চে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরের পর প্রকল্পটি এগিয়ে নিতে কাজ শুরু হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের কাছে ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
প্রকল্পটির পুরো নাম ‘কম্প্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন অব তিস্তা রিভার প্রজেক্ট’ বা তিস্তা নদীর সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প। এটি তিস্তা মহাপরিকল্পনা নামেও পরিচিত। এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে চীন ও ভারতÑ দুই দেশই বিভিন্ন সময়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। ২০২৪ সালের মে মাসের শুরুতে বাংলাদেশ সফরে এসে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কোয়েত্রা তিস্তা প্রকল্পে ভারতের বিনিয়োগের আগ্রহের কথা জানিয়েছিলেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারও চেয়েছিল, প্রকল্পটিতে যেন ভারত অর্থায়ন করে।
চীন সফর নিয়ে ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তিস্তা প্রকল্পে ভারত অর্থায়ন করতে আগ্রহী। এই সংবাদ সম্মেলনের ২২ দিন পর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। বর্তমান সরকার চাইছে, চীনের ঋণে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়িত হোক। তিস্তা প্রকল্পের প্রথম পর্যায় (ফার্স্ট ফেজ) বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ৭৫ কোটি ডলার। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের গভীরতা আরো বাড়বে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
অবকাঠামো খাতে চীনের ভূমিকা : বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চীনের বিনিয়োগ বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে। প্রায় ৬০ শতাংশ চীনা বিনিয়োগই অবকাঠামো উন্নয়নকেন্দ্রিক, যার মধ্যে সেতু, রেলপথ, বন্দর, বিদ্যুৎ ও শিল্পাঞ্চল উন্নয়ন অন্তর্ভুক্ত।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রধান ঠিকাদার চীনের সিআরইসি (চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেড)। যার ব্যয় প্রায় ৩৯,২৪৬ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের মাধ্যমে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগ পূর্ণগতিতে চালু হলে, বাণিজ্য প্রবাহ ও রপ্তানির সক্ষমতা ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন। এই প্রকল্পে চীনের অর্থায়ন ২১,০৩৬.৩৯ কোটি টাকা।
চীনের সিসিসিসি ও চায়না এক্সিম ব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে কর্ণফুলি নদীর নিচে টানেল তৈরি হয়েছে। যার ব্যয় প্রায় ১০,৩৭৪ কোটি টাকা। এটি চট্টগ্রাম বন্দর এলাকার যানজট ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমাবে বলে প্রক্ষেপণ রয়েছে। সমীক্ষা অনুযায়ী, একই সঙ্গে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম অর্থনৈতিক করিডোরের শিল্পায়নে গতি আনবে। এই প্রকল্পে চীনের অর্থায়ন ৫,৯১৩ কোটি টাকা। ২ শতাংশ সুদে এই ঋণ নেওয়া হয়েছে।
পায়রা বন্দর ও আনোয়ারা অর্থনৈতিক অঞ্চলÑ এই দুই প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ প্রায় ২.১ বিলিয়ন ডলার। এই বন্দরের কার্যক্রম সম্পূর্ণভাবে শুরু হলে প্রতিবছর বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি ৪ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই প্রকল্পে ২ শতাংশ সুদে চীনের ঋণের পরিমাণ ১.৯৮৩ বিলিয়ন ডলার।
অবকাঠামো খাতের এই বিনিয়োগগুলো সরাসরি প্রায় ৭০,০০০ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে এবং পরোক্ষভাবে আরও দেড় লাখ মানুষের জীবিকা যুক্ত হয়েছে। জাতীয় রাজস্বে এ খাত থেকে বছরে প্রায় ১৫,০০০ কোটি টাকার কর রাজস্ব যোগ হচ্ছে।
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত : স্থিতিশীলতার পাশাপাশি নির্ভরতার ঝুঁকি
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগের দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত হলো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি। ২০২৫ সালের শুরু পর্যন্ত মোট ১২টি বিদ্যুৎ প্রকল্পে চীনা অংশীদারিত্ব রয়েছে, যার সম্মিলিত উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৪,৭০০ মেগাওয়াট।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো : পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র (চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইম্পোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশন), ব্যয় প্রায় ২.৪৮ বিলিয়ন ডলার। বড় পুকুরিয়া কয়লা খনি সম্প্রসারণ প্রকল্প, যা বাংলাদেশের জ্বালানি সরবরাহে ১২ শতাংশ অবদান রাখছে। সোলার ও উইন্ড এনার্জি খাতে নতুন যৌথ উদ্যোগে ২০২৪ সালে ৮০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের চুক্তি হয়েছে।
এই বিনিয়োগগুলো বাংলাদেশের জ্বালানি স্থিতিশীলতায় অবদান রাখলেও কিছু বিশেষজ্ঞ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন চীনা ঋণের শর্তাবলি নিয়ে। বিশেষত, পায়রা ও রামপাল প্রকল্পে ‘সুভরেন গ্যারান্টি’ থাকায় বাংলাদেশের রাজস্ব চাপ বাড়ছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের ফেলো ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, চীনের বিনিয়োগ বাংলাদেশের শক্তি অবকাঠামোকে শক্তিশালী করছে, কিন্তু এই ঋণচুক্তিগুলো যদি সতর্কভাবে মূল্যায়ন না করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এটি আর্থিক দায়ে পরিণত হতে পারে।
প্রযুক্তি ও ডিজিটাল অর্থনীতি : চীনের উদ্ভাবন, বাংলাদেশের নতুন গতি
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাত এখন চীনা কোম্পানিগুলোর একটি প্রধান ক্ষেত্র। বর্তমানে বাংলাদেশের আইসিটি সেক্টরে চীনা বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১.১ বিলিয়ন ডলার।
হুয়াওয়ে ও জেডটিই যৌথভাবে দেশের ৪জি ও ৫জি নেটওয়ার্ক উন্নয়নে যুক্ত। ২০২৫ সালের মধ্যে পুরো দেশে ৫জি অবকাঠামো গড়তে হুয়াওয়ে ৩০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। শাওমি ও ট্রানশিয়ন গ্রুপ স্মার্টফোন অ্যাসেম্বলি প্ল্যান্টে বছরে ২৫ লক্ষাধিক ফোন উৎপাদন করছে, যা স্থানীয় বাজারের ৩৫ শতাংশ চাহিদা পূরণ করছে। এই বিনিয়োগের ফলে বাংলাদেশের আইসিটি রপ্তানি আয় ২০২৪ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ১.৯ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ২২ শতাংশ বেশি।
তবে প্রযুক্তি স্থানান্তর বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাংলাদেশকে ‘উৎপাদন কেন্দ্র’ থেকে ‘উদ্ভাবন অংশীদার’ হিসেবে উন্নীত করতে হবে। এজন্য চীন-বাংলাদেশ যৌথ গবেষণা কেন্দ্র ও স্টার্টআপ ফান্ড গঠন এখন সময়ের দাবি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিদেশি প্রযুক্তি শুধু যন্ত্রপাতি আকারে এলে তা দীর্ঘমেয়াদে স্থানীয় সক্ষমতা তৈরি করতে পারে না। এ কারণে চীনের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে গবেষণা ও উদ্ভাবন কেন্দ্র গড়ে তোলা জরুরি, যাতে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি উপকৃত হয়।
শিল্পায়ন ও ম্যানুফ্যাকচারিং : চীনের মূলধন, বাংলাদেশের শ্রম
শিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের শিল্পাঞ্চল উন্নয়ন পরিকল্পনায় চীনের ভূমিকা ক্রমেই বাড়ছে। চট্টগ্রামের আনোয়ারা অর্থনৈতিক অঞ্চল (চায়না ইকোনমিক জোন) এবং মিরসরাইয়ের বাংলাদেশ-চায়না ইকোনমিক অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট জোন মিলিয়ে চীনা বিনিয়োগ প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলার। এই অঞ্চলগুলোতে টেক্সটাইল, প্লাস্টিক, ইলেকট্রনিকস, কেমিক্যাল ও স্টিল উৎপাদনে প্রায় ২০০টিরও বেশি কারখানা স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্যমতে, এই অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো সম্পূর্ণ চালু হলে প্রায় ২.৫ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং দেশের বার্ষিক শিল্প উৎপাদন ১.৩ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
চীনা বিনিয়োগের আরেকটি দিক হলো ‘ইনপুট-লেড এক্সপোর্ট’। বাংলাদেশের পোশাক খাতে ব্যবহৃত প্রায় ৪৫ শতাংশ ফ্যাব্রিক ও যন্ত্রাংশ চীন থেকে আমদানি হয়। যদিও এতে আমদানি ব্যয় বাড়ে। তবে এর ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির সক্ষমতা ও গুণগত মানও বৃদ্ধি পেয়েছে।
কৃষি ও খাদ্য প্রযুক্তি : নতুন দিগন্ত
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দুদেশের কৃষি সহযোগিতা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। কৃষি গবেষণায় দুই দেশের মধ্যে ২০২৩ সালে ১২টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর হয়েছে, যার মাধ্যমে ধানের উৎপাদনশীল জাত ও কৃষিযন্ত্র উন্নয়নে সহযোগিতা চলছে।
চীনা কৃষি প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো এখন বাংলাদেশের মেঘনা ও যশোর অঞ্চলে ‘ড্রিপ ইরিগেশন’ ও ‘স্মার্ট সেচ প্রযুক্তি’ বাস্তবায়ন করছে, যা কৃষি উৎপাদন ১৮ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করেছে।
পাশাপাশি, চীনা কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগে স্থাপিত মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রগুলো রপ্তানি খাতে বছরে প্রায় ১৫ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। এই খাতটি বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করে স্থানীয় পর্যায়ে আয় ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাণিজ্য প্রবাহ : ভারসাম্যের দিকে অগ্রসর
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চীন এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ চীনে রপ্তানি করেছে প্রায় ১.৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, আর চীন থেকে আমদানি করেছে ২১ বিলিয়ন ডলার। যদিও বাণিজ্য ঘাটতি বিশাল, তবে ২০২২ সালে বেইজিং বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশ পণ্যের ওপর শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদান করেছে, যার ফলে রপ্তানি ৩০ শতাংশ বেড়েছে। বাংলাদেশের জন্য চীনা বাজারে তৈরি পোশাক, ওষুধ, জাহাজ নির্মাণ ও পাটজাত পণ্যের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যদি বাংলাদেশ রপ্তানির গুণগত মান ও উৎপাদন বৈচিত্র্য বাড়াতে পারে, তাহলে আগামী পাঁচ বছরে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ঘাটতি অন্তত ২৫ শতাংশ কমানো সম্ভব।
ভূরাজনৈতিক প্রভাব ও কূটনৈতিক ভারসাম্য
চীনের বিনিয়োগ শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং এর পেছনে একটি সুস্পষ্ট ভূরাজনৈতিক কৌশল রয়েছে। বাংলাদেশের জন্য এই সম্পর্ক যেমন সুযোগ, তেমনি চ্যালেঞ্জও বটে।
চীন দক্ষিণ এশিয়ায় তার প্রভাব বাড়াতে চায়, আর বাংলাদেশ তার উন্নয়নযাত্রায় বৈচিত্র্যময় অংশীদারিত্বে বিশ্বাসী। তাই ঢাকার জন্য কৌশলগত ভারসাম্য রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বৈদেশিক নীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের উচিত যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার রাখা, যাতে অর্থনৈতিক কূটনীতি একমুখী না হয়।
অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতার গভীরতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের শিল্প কাঠামো ক্রমশ ম্যানুফ্যাকচারিং ও প্রযুক্তিনির্ভর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বিশেষ করে ২০২৭ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশের জন্য নতুন বাণিজ্য বাজারে প্রবেশের যে প্রয়োজন তৈরি হবে, সেখানে চীনের বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি স্থানান্তর একটি প্রধান সহায়ক উপাদান হবে।
বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টিতে, চীনা বিনিয়োগ শুধু অবকাঠামো নয়, বরং উৎপাদনমুখী খাতে সম্প্রসারিত হওয়া এখন সময়ের দাবি। ইতোমধ্যেই চট্টগ্রামের আয়োজিত ‘বাংলাদেশ-চীন বিনিয়োগ সম্মেলন’Ñ এ দুই দেশের মধ্যে প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমমূল্যের ২১টি নতুন প্রকল্পে সমঝোতা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন, তথ্যপ্রযুক্তি রপ্তানি, ইলেকট্রনিক্স ম্যানুফ্যাকচারিং এবং কৃষি প্রযুক্তি খাতে চীনের বিনিয়োগ।
এদিকে চীন নিজস্ব কৌশলগত স্বার্থের দিক থেকেও বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় এক নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে দেখতে চায়। ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই)-এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে চীন দক্ষিণ এশীয় বাণিজ্য করিডোরের কেন্দ্রে পরিণত করতে আগ্রহী।
চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের সাবেক চেয়ারম্যান মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলেন, বর্তমানে দুই দেশের সরকারি পর্যায়ে গভীর সম্পর্কের কথা বলা হলেও বাস্তবতা হচ্ছে চীন নির্বাচিত সরকারের জন্য অপেক্ষা করছে। তারা চাচ্ছে নির্বাচিত সরকার আসার পর সম্পর্কের মাত্রা বাড়াতে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন