বহুল আলোচিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ’, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী নতুন রাষ্ট্রনৈতিক কাঠামো নির্মাণের অঙ্গীকার হিসেবে দেখা হয়েছিল, তার ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চয়তার দোলাচলে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে, তা নিয়েই তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা ও বিভ্রান্তি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই অনিশ্চয়তা যদি দ্রুত কাটানো না যায়, তাহলে দলগুলো আবার মুখোমুখি অবস্থানে চলে যেতে পারে, যা অন্তর্বর্তী সরকারের স্থিতিশীলতাকেও বিপন্ন করবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে না গেলে আগামী ফেব্রুয়ারিতেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে জুলাই সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ও আইনি কাঠামো নির্ধারণ না হলে নির্বাচনের আগে নতুন রাজনৈতিক জটিলতা তৈরি হতে পারে।
সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে: জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রশ্নে যেমন অগ্রগতি হয়েছে, তেমনি বেড়েছে সংশয়ও। ফেব্রুয়ারির নির্বাচন সামনে রেখে সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।
বিশ্লেষকদের মতে, সনদ বাস্তবায়ন, প্রশাসনিক পুনর্গঠন ও নির্বাচনের প্রস্তুতিÑ এই তিন বিষয় এখন এক সূত্রে গাঁথা। কোনো একটিতে বিলম্ব বা ব্যর্থতা পুরো প্রক্রিয়াকেই প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। ঐকমত্য কমিশন ও অন্তর্বর্তী সরকার কত দ্রুত এবং কতটা কার্যকরভাবে এই রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে, তা-ই দেখার অপেক্ষায় আছে দেশবাসী।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ ৩১ অক্টোবর শেষ হবে। এই সময়ের মধ্যেই তাদের সমস্ত কাজ শেষ করতে হবে। নয়তো আবারও সময় বাড়াতে হতে পারে। যদিও তৃতীয় দফা মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
ঐকমত্যে পৌঁছালেও বাস্তবায়ন নিয়ে ধোঁয়াশা
জুলাই সনদ প্রণয়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করেছে ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোট, যার মধ্যে ২৫টি দল শেষ পর্যন্ত স্বাক্ষর করেছে। তবে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত বেশ কিছু রাজনৈতিক দল এই আলোচনায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়নি, যা শুরু থেকেই প্রক্রিয়াটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বলে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা রয়েছে।
ঐকমত্য কমিশন সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে দলগুলো ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে টানা দেড় মাস ধরে আলোচনা করেছে। ৯ অক্টোবর এ আলোচনা শেষ হয় এবং গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নে মৌলিক ঐকমত্য গড়ে ওঠে। কিন্তু গণভোটের আইনি ভিত্তি, সময় ও পদ্ধতি নিয়ে এখনো দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত রয়ে গেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এটি এখনো কাগুজে দলিলের বেশি কিছু নয়, কারণ বাস্তবায়নের স্পষ্ট কাঠামো বা সময়সীমা নির্ধারিত হয়নি।
বিশেষ আদেশ ও গণভোট: দুটি ধাপে বাস্তবায়নের প্রস্তাব
ঐকমত্য কমিশনের সূত্রে জানা গেছে, সনদ বাস্তবায়নের প্রথম ধাপে একটি বিশেষ সংবিধান সম্পর্কিত আদেশ জারি করা হবে, যার প্রাথমিক নাম হতে পারে ‘জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন (সংবিধান) আদেশ’।
দ্বিতীয় ধাপে এই আদেশের ওপর গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। ভবিষ্যতের সংসদ একই সঙ্গে দুই ভূমিকা পালন করবেÑ সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে এবং নিয়মিত সংসদ হিসেবে, পরবর্তী নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত।
এই আদেশের আইনি ভিত্তি হবে ‘চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান’ অর্থাৎ, বিশেষ পরিস্থিতিতে গণঅভ্যুত্থানের ক্ষমতাবলে এটি জারি করা হবে। আদেশের পরিশিষ্টে থাকবে পুরো জুলাই জাতীয় সনদ এবং গণভোটের মাধ্যমে জনগণের অনুমোদন নেওয়া হবে।
দলগুলোর পরস্পরবিরোধী অবস্থান
এই প্রস্তাবিত বিশেষ আদেশ নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গভীর মতভেদ রয়েছে।
বিএনপি প্রকাশ্যে বলেছে, তারা এ ধরনের বিশেষ আদেশ জারি সমর্থন করে না। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) দীর্ঘদিন ধরে এমন একটি আদেশ জারির দাবি জানিয়ে আসছে।
আদেশের আইনি ভিত্তি স্পষ্ট না হওয়ায় এনসিপি সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান বর্জন করেছিল। শুধু তাই নয়, দলটির সমর্থকেরা ওই দিন অনুষ্ঠানস্থলে সমাবেশ করে অনুষ্ঠান বাধাগ্রস্ত করে। এতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ, পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। জনমনে ধারণা, এনসিপি পরিকল্পিতভাবে এই পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, যদিও তাদের শীর্ষ নেতারা সরাসরি উপস্থিত ছিলেন না। এ ঘটনাই প্রথমবারের মতো ‘জুলাই সনদ’ প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেয়।
বিশ্লেষকদের সতর্কবার্তা: দলগুলো মুখোমুখি অবস্থানে যেতে পারে
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. সাব্বীর আহমেদ মনে করেন, যেসব বিষয়ে দলগুলো একমত হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করা জরুরি। না হলে এখনকার পোস্ট-আপরাইজিং সময়ে দলগুলো একে অপরের বিপক্ষে অবস্থান নিতে পারে।
তিনি আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঠিক মোতায়েন এবং প্রশাসনের পুনর্বিন্যাস এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে আয়োজনের জন্য সরকারের কাছে একটি স্পষ্ট কাঠামো থাকা উচিত। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি বিষয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত না নিলে নির্বাচন ঘিরে জটিলতা দেখা দিতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ মোহাম্মদ সাহান বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে এখনো কোনো স্পষ্ট মতৈক্যে পৌঁছানো যায়নি। বরং এখানে মতভেদের প্রবণতা বাড়ছে। দ্রুত সমাধান না হলে রাজনৈতিক ভাঙাগড়ার নতুন ধাপ শুরু হতে পারে।
জামায়াতের হুঁশিয়ারি ও নতুন অস্থিরতার আশঙ্কা
জামায়াতে ইসলামী জানিয়েছে, তাদের দাবিগুলো পূরণ না হলে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে।
ড. আসিফ সাহান বলেন, যদি জামায়াত সিদ্ধান্তে দেরি করে, তাহলে তা নতুন রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করবে। আগের সরকারের নানা স্বার্থগোষ্ঠীও এই অস্থিরতার সুযোগ নিতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর এখন দ্বৈত চাপ কাজ করছেÑ একদিকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আইনি কাঠামো নির্ধারণের চাপ, অন্যদিকে আসন্ন নির্বাচনের সময়সূচি রক্ষার বাস্তব বাধ্যবাধকতা।
সনদের ৮৪টি প্রস্তাবের বেশির ভাগেই আপত্তি
জুলাই সনদে মোট ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব রয়েছে। এর মধ্যে গুটি কয়েক ছাড়া প্রায় প্রতিটি প্রস্তাবেই এক বা একাধিক দলের আপত্তি আছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বিচার বিভাগসংক্রান্ত প্রস্তাবে আদালত প্রাঙ্গণে দলীয় কর্মকা- নিষিদ্ধের প্রস্তাবে চারটি দল আপত্তি জানিয়েছে।
আরেকটি প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কুমিল্লা ও ফরিদপুর নামে দুটি প্রশাসনিক বিভাগ গঠন করা হবে। এই প্রস্তাবে একটি দল ছাড়া সবাই একমত হলেও বিশ্লেষকেরা প্রশ্ন তুলছেন, ‘অভ্যুত্থান-পরবর্তী একটি সনদে প্রশাসনিক বিভাগ বাড়ানোর মতো বিষয় অন্তর্ভুক্ত হলো কেন?’
তাদের মতে, এসব প্রস্তাব সনদের মৌলিক লক্ষ্য রাষ্ট্র পুনর্গঠন থেকে মনোযোগ সরিয়ে দিয়েছে।
সংসদীয় বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক নয়
সনদে বলা হয়েছে, কোনো রাজনৈতিক দল বা জোট তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে সনদের প্রস্তাব উল্লেখ করলে এবং জনগণের ম্যান্ডেট পেলে তবেই তারা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে পারবে। অর্থাৎ, সনদের বাস্তবায়ন রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক নয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এখানেই প্রশ্ন উঠছেÑ তাহলে এই সনদের আইনি ও সাংবিধানিক ভিত্তি কী? যদি নির্বাচিত সংসদই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে এই সনদ বাস্তবায়নের কতটা অর্থবহতা থাকে?
গণভোটের বাস্তব জটিলতা
এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গণভোটের নজির নতুন নয়, কিন্তু জুলাই সনদের গণভোট ভিন্নধর্মী। এখানে ৮৪টি প্রস্তাব রয়েছে, যার মধ্যে অনেক উপপ্রস্তাবও আছে।
একজন নাগরিক যদি কয়েকটি প্রস্তাবের পক্ষে থাকেন, আবার কয়েকটিতে আপত্তি থাকে, তাহলে তিনি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’Ñ কীভাবে ভোট দেবেন? এই প্রশ্নের উত্তর এখনো অমীমাংসিত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন এক গণভোটের প্রস্তুতি ও প্রক্রিয়া নির্ধারণ করতে অন্তত তিন মাস সময় লাগবে। কিন্তু নির্বাচনের সময়সূচি যদি ফেব্রুয়ারি থাকে, তাহলে এই সময়সীমা বাস্তবসম্মত নয়।
সংবিধান সংশোধন ও স্থায়িত্বের প্রশ্ন
কেউ কেউ বলছেন, জুলাই সনদ ভবিষ্যতে সংবিধানের অংশ হবে। কিন্তু ইতিহাস বলছে, সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হলেই তা স্থায়ী হয় না। বাহাত্তরের সংবিধান একাধিকবার সংশোধিত হয়েছে। দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার ৭ মার্চের ভাষণ ও ১৭ এপ্রিলের মুজিবনগর ঘোষণাপত্র সংবিধানে সংযোজন করেছে। অর্থাৎ, সংবিধান সব সময় সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পুনর্লিখিত হয়। তাই জুলাই সনদ সংবিধানে স্থান পেলেও এর টেকসই হওয়া বা স্থায়িত্বের কোনো নিশ্চয়তা নেই।
রাজনৈতিক দায়িত্বশীলতার আহ্বান
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. সাব্বীর আহমেদ বলেন, যে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই সনদ এসেছে, তার মর্যাদা রক্ষা করা এখন রাজনৈতিক দলগুলোর নৈতিক দায়িত্ব। ক্ষমতার কূটনীতি যদি আবার এই প্রক্রিয়াকে গ্রাস করে, তাহলে আমরা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিই দেখব।
অধ্যাপক আসিফ মোহাম্মদ সাহানও দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে এখন দায়িত্বশীল হতে হবে। জনগণের প্রত্যাশা যে আরেকটি মুখোমুখি সংঘর্ষ নয়, বরং একটি স্থিতিশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনি প্রক্রিয়া, তা প্রমাণ করতে হবে।

