ঢাকা সোমবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২৫

আহ জীবন! নিমেষেই শেষ

মেহেদী হাসান খাজা
প্রকাশিত: অক্টোবর ২৭, ২০২৫, ১২:৫৮ এএম

‘ঘড়ির কাঁটা তখন ঠিক ১২টা ৩০ মিনিট। ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটের ওপর থেকে মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড পড়ে গেছে বলে চারদিকে চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দ শোনা যায়। আমি পাশের একটি দোকানে ছিলাম, গিয়ে দেখি এক ব্যক্তি শরীরে আঘাত পেয়ে পড়ে আছে। তাৎক্ষণিক সবাই ওই অবস্থায় বিয়ারিং প্যাড সরানোর চেষ্টা করে। এর মধ্যেই আবুল কালাম নামের ব্যক্তিটি ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন বলে সবাই দাবি করছিল। চারপাশ রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। এরপর পুলিশ এসে তার লাশ হাসপাতালে নিয়ে যায়।’ কথাগুলো বলছিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী সজল মৃধা। 

গতকাল রোববার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে ঢাকার ফার্মগেট এলাকায় মেট্রো লাইনের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে ৪৬ বছর বয়সি আবুল কালামের মৃত্যু হয়।

আরেক পথচারী রাব্বী জানান, ঘটনাস্থল থেকে শুরু করে হাসপাতালে নেওয়া পর্যন্ত আবুল কালামের সঙ্গে আমরা অনেকেই ছিলাম। তার মাথায় প্রচ- আঘাত ছিল, তাৎক্ষণিকভাবে তিনি মারা গেছেন বলে ধারণা করা হয়। এ সময় তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমি প্রতিদিন এই পথ দিয়ে চলাচল করি, আমারও এমনটি হতে পারতÑ ঘটনার পর ভাবছি, এই শহরে চলাফেরায় আমরা কেউই নিরাপদ নই, কালাম তার উদাহরণ।

একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ওই প্যাড পড়ে কালাম মারা যাওয়ার পাশাপাশি ফুটপাতে একটি চায়ের দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়াসহ দুজন আহত হন। এরপর আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, প্রতিদিন যে পথ দিয়ে আমরা চলাফেরা করি, সেই পথেই এ দুর্ঘটনা। এই জায়গায় আমরাও থাকতে পারতাম। চলাচলরতদের অভিযোগÑ বস্তুত এ শহরে কেউই নিরাপদ নয়, তার উদাহরণ কেবল কালাম। এর আগেও এ ধরনের অঘটন ঘটেছে; কিন্তু আমরা সতর্ক হইনি। একটি দুর্ঘটনার পর আমরা অনেক কিছু বলি, কিন্তু আগে থেকে কেন কর্তৃপক্ষ সতর্ক হয় না, সেটা আমাদের বোধগম্য নয়। 

মৃত আবুল কালাম শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার বাসিন্দা ছিলেন। তার বাবা জলিল চাকদার, মা হনুফা বেগম বলে জানিয়েছে পুলিশ। জানা গেছে, কিশোর বয়সে বাবা-মাকে হারিয়েছিলেন আবুল কালাম। এরপর ভাই-বোনদের সংসারে বেড়ে ওঠেন। কঠোর পরিশ্রম করে সংসারের সচ্ছলতা ফেরাতে চেষ্টা করছিলেন। পরিবারের প্রিয় মানুষটি মাত্র ৩৬ বছর বয়সে হারিয়ে গেলেন। আবুল কালাম মারা যাওয়ার ঘটনাটি তাৎক্ষণিকভাবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশব্যাপী ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। 

বিষয়টি কীভাবে ঘটেছে এবং পথচারী কালাম কীভাবে মারা গেলেনÑ এমন প্রশ্নের জবাবে তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোবারক হোসেন বলেন, প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, নিহত ওই ব্যক্তি ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন।  মেট্রোরেল চলার সময় হঠাৎ একটি বিয়ারিং প্যাড ওপর থেকে নিহত ব্যক্তির মাথায় পড়ে। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। তেজগাঁও থানা পুলিশের উপপরিদর্শক শহিদুজ্জামান বলেন, আমরা ডিউটিরত অবস্থায় পাশেই ছিলাম। খবর পেয়ে দ্রুত এসে দেখি, একজন মৃত অবস্থায় পড়ে আছে। পরে প্রাথমিকভাবে জানতে পারি, মেট্রোরেল চলাচলের সময় পিলারের কম্পন নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে এবং তিনি মারা যান। 

স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হাসপাতাল:

এদিকে রাজধানীতে মেট্রোরেল লাইনের বিয়ারিং প্যাড খসে পড়ে প্রাণ হারানো আবুল কালামের স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলের পরিবেশ। মর্গের সামনে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন কালামের স্ত্রী আইরিন আক্তার পিয়া (৩৬)। পিয়া হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছেন তার সন্তানের দিকে। এ সময় তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার স্বামী আমাদের রেখে চিরতরে চলে গেলÑ আমার সন্তানদের কী হবে? আমাদের কে দেখবে’Ñ এটুকু বলে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। এক ছেলেকে কোলে নিয়ে তিনি বারবার বলছিলেন, ‘কালামকে আমি গতকাল বাসা থেকে বিদায় দিতে যাইনি। দরজা লাগাতেও যাইনি। কেন যে তাকে জোর করে আটকে রাখলাম না। নিজেকে কোনোভাবেই বোঝাতে পারছি না, আমার বাচ্চাদের কথা চিন্তা হচ্ছে, কী হবে তাদের?’

স্বামীর মৃত্যুর কারণ নিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা মৃত্যু নয়, হত্যা। এটা মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের অবহেলা। টাকা বা চাকরি দিয়ে ক্ষতিপূরণ হবে না। এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অবহেলায় জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’ আইরিন আরও বলেন, ‘আমার ছেলেটার বয়স ৪ বছর, মেয়ের ৩ বছর। বাচ্চা দুটি তাদের বাবাকে হারাল। সেটার ক্ষতিপূরণ কীভাবে হবে?’

মর্গের সামনে কথা হয় নিহতের ভাগ্নে শাহাদাতের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার মামা আবুল কালাম ট্র্যাভেল এজেন্টে এয়ার টিকিট বিক্রির কাজ করতেন। তার তিন ও চার বছর বয়সি দুটি ছেলে রয়েছে। তিনি পরিবার নিয়ে নারায়ণগঞ্জে থাকতেন। মামাকে এভাবে হারাতে হবে কখনোই ভাবতে পারি না।’

আবুল কালামের শ্যালক সোহাগ আহমেদ বলেন, আমার বোনের স্বামী একসময় মালয়েশিয়ায় ছিলেন। ছয় বছর আগে বিয়ে করে আর মালয়েশিয়া যাননি। তিনি কী কারণে ফার্মগেটে গিয়েছিলেন, তা আমরা জানি না।’

৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন, ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবে নিহতের পরিবার: মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে নিহত হওয়া ব্যক্তির পরিবারকে প্রাথমিকভাবে পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সড়ক ও রেল উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। একই সঙ্গে ওই পরিবারে চাকরিক্ষম কোনো ব্যক্তি থাকলে তাকে মেট্রোরেলে চাকরির ব্যবস্থা করা হবে বলেও জানান তিনি। এদিন দুপুরে দুর্ঘটনাস্থল মেট্রোরেলের ফার্মগেট স্টেশন পরিদর্শনে এসে তিনি এ কথা জানান।  

এদিকে দুর্ঘটনায় সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ আব্দুর রউফকে আহ্বায়ক করে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে বলে জানান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, নিহত ব্যক্তির পরিবারের সব দায়-দায়িত্ব মেট্রোরেল গ্রহণ করবে। প্রাথমিকভাবে নিহতের পরিবারকে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। এরপর নিহতের পরিবারে যদি কর্মক্ষম সদস্য থাকে, তাকে মেট্রোরেলে চাকরি দেওয়া হবে।

এদিকে বিয়ারিং প্যাড পড়ে একজন নিহত হওয়ার ঘটনায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রায় সাত ঘণ্টা পর মতিঝিল থেকে শাহবাগ পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল শুরু হয়েছে। এমআরটি ৬ লাইনের আগারগাঁও থেকে উত্তরা অংশে ট্রেন চলাচল গতকাল বিকেলেই শুরু হয়েছিল। তবে শাহবাগ থেকে আগারগাঁও অংশে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে।

ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ফেসবুক পেজে রোববার সন্ধ্যায় এক বার্তায় বলা হয়, ‘মেট্রোরেলের সম্মানিত যাত্রীসাধারণের জ্ঞাতার্থে জানানো যাচ্ছে যে, অদ্য বিকেল ৩টা থেকে উত্তরা উত্তর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল সেবা চালু করা হয়েছে। মতিঝিল থেকে শাহবাগ পর্যন্ত মেট্রোরেল সেবা ৭টা ১৫ মিনিটে চালু হয়েছে।’