জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার বদলে জাতীয় অনৈক্য প্রতিষ্ঠার একটা প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। কমিশন ‘নিষ্কৃতি’ পাওয়ার জন্য আলোচনা ও সিদ্ধান্ত‘বহির্ভূত’ বিষয় সংযুক্ত করে সুপারিশ জমা দিয়েছে বলে দাবি করেছেন তিনি। সুপারিশ জমা দেওয়ার জন্য ঐকমত্য কমিশনকে ধন্যবাদ দেওয়ার পাশাপাশি নিজেদের ক্ষোভ ও হতাশার কথাও বলেছেন তিনি। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় সম্পর্কিত যেসব সুপারিশ প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিয়েছে, তার প্রতিক্রিয়ায় এ কথা বলেছেন তিনি। একই সঙ্গে কার্যক্রম শেষ করায় ঐকমত্য কমিশনকে ধন্যবাদ দিয়েছেন এই বিএনপি নেতা।
গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে সচিবালয়ে আইন উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করার পর বেরিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, যে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলো স্বাক্ষর করেছে, সেই স্বাক্ষরিত সনদবহির্ভূত অনেক পরামর্শ বা সুপারিশ সনদ বাস্তবায়নের আদেশের খসড়ায় যুক্ত করা হয়েছে।
আগামী সংসদ সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে ২৭০ দিনের মধ্যে গণভোটে পাস হওয়া প্রস্তাবগুলো অনুমোদন না করলে এগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হয়ে যাবে বলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে সুপারিশ করেছে, তার কঠোর সমালোচনা করেছেন বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘এটা একটা হাস্যকর ব্যাপার। সংবিধানের কোনো বিষয় সংশোধিত হওয়ার পরে এটা একটা আইন। সেই আইন পার্লামেন্টে যথাযথভাবে পাস হওয়ার পরে যখন স্পিকার সই করে রাষ্ট্রপতির কাছে দেবেন, রাষ্ট্রপতি সই হওয়ার পরে সেটা তখন আইনে পরিণত হবে। সেটা সংবিধান সংশোধন হোক বা অন্য আইন,...পরীক্ষায় অটো পাসের মতো কোনো বিষয় তো সংবিধানে থাকতে পারে না। এগুলো কীভাবে সুপারিশে এলো আমি জানি না।’
বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘জুলাই জাতীয় সনদ ৮৪টি দফা সম্ভবত, সেখানে বিভিন্ন দফায় আমাদের এবং বিভিন্ন দলের কিছু ভিন্নমত আছে, নোট অব ডিসেন্ট আছে। পরিষ্কারভাবে সেখানে উল্লেখ করা আছে যে এই সমস্ত নোট অব ডিসেন্টের বিষয়গুলো রাজনৈতিক দলসমূহ যারা দিয়েছে, তারা যদি নিজেদের নির্বাচনি ইশতেহারে উল্লেখপূর্বক ম্যান্ডেট-প্রাপ্ত হয়, তাহলে তারা সেভাবে সেটা বাস্তবায়ন করতে পারবেন। সেটা এই প্রিন্টেড জাতীয় জুলাই সনদের যে বই এখানে আপনারা পাবেন, সমস্ত দফায় দফায় যেখানে যেখানে ডিসেন্ট আছে সেখানে আছে। অথচ বিস্ময়করভাবে আজ যে সংযুক্তিগুলো দেওয়া হলো সুপারিশমালার সাথে, সেখানে এই নোট অব ডিসেন্টের কোনো উল্লেখ নেই।’
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গণভোট আয়োজনের বিষয়ে কমিশনের সুপারিশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বা নির্বাচনের দিন অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গ উল্লেখ করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় বিএনপির প্রতিনিধিত্ব করা সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘হয়তো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমস্যাটা নিয়ে আবার আলোচনা হতে পারে। এখানে একটা নতুন বিষয় সংযুক্ত করা হয়েছে যে, সংবিধান সংস্কার পরিষদের নামে একটা আইডিয়া এখানে সংযুক্ত করা হয়েছে, যেটা আগে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে কখনো টেবিলে ছিল না, আলোচিত হয়নি। এ বিষয়ে কোনো ঐকমত্য হয়নি।’
সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা জানি, আসন্ন যে নির্বাচনটা হবে, সেই নির্বাচনটা হবে জাতীয় সংসদের নির্বাচন। জাতীয় সংসদের সদস্যগণ নির্বাচিত হবেন। এখন সেই সংসদ সদস্যদের যদি সংবিধান সংস্কার পরিষদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়, সেটা তো জাতীয় সংসদেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এখন জাতীয় সংসদে কী সিদ্ধান্ত নেবে, সেটা তো আলোচিত হয়নি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে। এ বিষয়ে কোনো সুপারিশ বা এ বিষয়ে কোনো আলোচনা না হওয়ার পরও এই সুপারিশমালার মধ্যে হঠাৎ করে যে পরবর্তী জাতীয় সংসদ একই সাথে সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করবে, ওনারা এই সিদ্ধান্তটা আরোপ করতে পারেন না। চাপিয়ে দিতে পারেন না।’
এ প্রসঙ্গে বিএনপির এই নেতা আরও বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে কেবল জাতীয় সংসদ গঠিত হওয়ার কথা। সংবিধান সংস্কার পরিষদের জন্য তো কোনো নির্বাচন হচ্ছে না। নির্বাচন তো হবে জাতীয় সংসদের জন্য। গণভোটে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের পক্ষে রায় এলে যে প্রক্রিয়ায় এই সনদ স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেই নোট অব ডিসেন্টসহ সেটি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলো বাধ্য থাকবে বলে উল্লেখ করেন সালাহউদ্দিন আহমেদ। কিন্তু জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে ভিন্নতা দেখছেন উল্লেখ করে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘যে সমস্ত প্রশ্ন আমি দেখলাম, এখানে বলা হয়েছে আপার হাউসে অর্থাৎ, উচ্চকক্ষে নি¤œকক্ষের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে আসনের মধ্য দিয়ে উচ্চকক্ষ গঠিত হবে। এ রকম তো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সিদ্ধান্ত হয়েছে উচ্চকক্ষ গঠিত হবে ১০০ সদস্যের এবং তারা কীভাবে কোন পদ্ধতিতে নির্বাচিত হবে, সেটার ব্যাপারে তো ঐকমত্য হয়নি।’
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় সংসদের উচ্চকক্ষের প্রতিনিধিরা কীভাবে নির্বাচিত হবেন, তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হলেও কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি দলগুলো। আলোচনায় বিএনপির পক্ষ থেকে উচ্চকক্ষের প্রতিনিধি নির্বাচন নি¤œকক্ষে সদস্যের অনুপাতে অর্থাৎ, সংসদ নির্বাচনে কোন দলগুলো কতগুলো আসন পেল, তার ভিত্তিতে বণ্টনের কথা বলা হয়। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পক্ষ থেকে নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে আসন বণ্টনের প্রস্তাব করা হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গ তুলে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কেউ ভোটের অনুপাতে চেয়েছে, আমরা চেয়েছি নি¤œকক্ষের আসনের অনুপাতে। এখানে বলা আছে, যেভাবে নোট অব ডিসেন্ট দেওয়া হয়েছে, সেই নোট অব ডিসেন্টগুলো নির্বাচনি ইশতেহারে উল্লেখ-পূর্বক যদি আমরা ম্যান্ডেট-প্রাপ্ত হই বা কোনো দল হয়, ওই সময় ম্যান্ডেট-প্রাপ্ত হয়ে তারা সেইভাবে সেটা বাস্তবায়ন করবে। তার পরে এখানে পিআরের ভিত্তিতে তারা প্রস্তাব সরাসরি করে ফেললেন এবং এখানে কোনো নোট অব ডিসেন্টের উল্লেখ নাই।’
ভাষাগত অস্পষ্টতা থাকলেও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশকে সাধুবাদ এনসিপির:
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের চূড়ান্ত সুপারিশ জমা দেওয়ার পর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় কমিশনকে সাধুবাদ জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার। তবে চূড়ান্ত সুপারিশের ভাষাগত কিছু অস্পষ্টতা রয়েছে বলে মনে করছেন তিনি।
গতকাল দুপুরে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ জমা দেয় ঐকমত্য কমিশন। পরে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত তুলে ধরেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
এ বিষয়ে এনসিপি নেতা তুষার বলেন, ‘আমরা কমিশনকে সাধুবাদ জানাই, তারা কাজটা কমপ্লিট (সম্পন্ন) করেছে। যদি আমরা সেদিন স্বাক্ষর করে ফেলতাম, তাহলে কাজটা হতো কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। আমাদের স্বাক্ষর না করার কারণে তারা ব্যাপারটাকে গুরুত্বসহকারে নিয়েছে এবং একটা সুপারিশ সরকারের কাছে দিয়েছে। এটাকে আমরা সাধুবাদ জানাই।’ চূড়ান্ত সুপারিশে ভাষাগত অস্পষ্টতা রয়েছে জানিয়ে সারোয়ার তুষার বলেন, ‘কিছু ভাষাগত অস্পষ্টতা আছে, যেগুলো আমরা আরও ক্ল্যারিটি (স্পষ্টতা) প্রত্যাশা করি। সেগুলো হয়তো আমরা সরকারের কাছে তুলে ধরব।’

