কক্সবাজার বিমানবন্দরে জেনারেটর নিয়ে করা দুর্নীতি মামলা ঝুলিয়ে দিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারার পাঁয়তারা চলছে। এতে একদিকে মামলাটি অকার্যকর করা, অন্যদিকে পুরো পেনশন হাতিয়ে নেওয়ার ধান্দা। মামলার আসামি বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) প্রকৌশলী শহীদুল আফরোজ ও ভবেশ চন্দ্র রায় এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ঢাকা ইন্টারন্যাশনালের মালিক শাহাবুদ্দিন মিলেমিশে এই অপতৎপরতা চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে। অভিযোগ উঠেছে, ঠিকাদার শাহাবুদ্দিন জাতীয়তাবাদী ঘরানার দাপটে নানাভাবে বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্তের অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। পারস্পরিক যোগসাজশে আসামিরা বারবার ধার্য তারিখে আদালতে গরহাজির থাকছেন। গত ১৭ সেপ্টেম্বর হাজিরার তারিখ ছিল, তারা যাননি। গত ২২ অক্টোবর ফের তারিখ পড়লেও তারা ছিলেন অনুপস্থিত। ফলে মামলার বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত হওয়ার পাশাপাশি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এমনকি অবাক করে দেওয়ার মতো বিষয় হচ্ছে, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপপরিচালক মাহবুবুল হকও নিয়মিতভাবে অনুপস্থিত। এ কারণে তদ্বিরের অভাবে থমকে দাঁড়াতে দাঁড়াতে মামলাটি রীতিমতো মাঠে মারা যেতে বসেছে।
জানা গেছে, এই আইও মাহবুবুল হক বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করায় সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন এবং বর্তমানে কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত আছেন। তাই তার বক্তব্য গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি।
বেবিচকের বিশ^স্ত সূত্র জানাচ্ছে, মামলার আসামি দুই বেবিচক প্রকৌশলী শহীদুল আফরোজ ও ভবেশ চন্দ্র রায়ের মূল উদ্দেশ্য হলো পুরো পেনশন হাতিয়ে নিয়ে পিআরএলে চলে যাওয়া। মামলা চলমান অবস্থায় প্রকৌশলী ভবেশ চন্দ্র রায় ইতিমধ্যে পুরো পেনশন নিয়ে অবসরোত্তর ছুটিতে চলে যাওয়ায় এ সন্দেহ আরও বেশি ঘনীভূত হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, অপর আসামি প্রকৌশলী শহীদুল আফরোজও কি একই পথে হাঁটছেন!
উল্লেখ্য, রূপালী বাংলাদেশের প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দুদক মামলাটি রুজু করে। গত বছরের ৬ জুন ‘কক্সবাজার বিমানবন্দরে জেনারেটর সরবরাহে পুকুরচুরি’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশের পর নড়েচড়ে বসে দুদক। দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে তারা মামলাটি নথিভুক্ত করে। এর পর থেকেই মামলাটি নষ্ট করে দেওয়ার জন্য নানান কসরত চলে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে কক্সবাজার বিমানবন্দরে জেনারেটর সরবরাহে পুকুরচুরির ঘটনা ঘটে। জেনারেটর সরবরাহ না করেই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে যোগসাজশে ঠিকাদার ৬০ লাখ টাকার বিল তুলে নিলে চারদিকে হইচই পড়ে যায়। এ নিয়ে কেলেঙ্কারির হোতাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। জেল খাটেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আশ্চর্যের বিষয় হলো, জেল থেকে জামিনে মুক্ত হওয়ার পর গুরুদ- না দিয়ে উল্টো লঘুদ- প্রত্যাহার করে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) তাদের চাকরিতে পুনর্বহাল এবং বিভিন্ন বিভাগে পদায়ন করে।
রূপালী বাংলাদেশের অনুসন্ধানে দেখা যায়, কক্সবাজার বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে একটি জেনারেটর সরবরাহের জন্য দরপত্র আহ্বান করে। সর্বনি¤œ ৯০ লাখ টাকা দরদাতা হিসেবে কার্যাদেশ পান ঢাকা ইন্টারন্যাশনালের মালিক শাহাবুদ্দিন। দরপত্রের শর্তানুযায়ী তিনি জেনারেটর সরবরাহে ব্যর্থ হন। কিন্তু হতবাক করে দেওয়ার মতো খবর হলো, বিমানবন্দরের সেই সময়কার ব্যবস্থাপক হাসান জহির, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শহীদুল আফরোজ, নির্বাহী প্রকৌশলী মিহির চাঁদ দে, সহকারী প্রকৌশলী ভবেশ চন্দ্র পরস্পর যোগসাজশে ঠিকাদার শাহবুদ্দিনকে ৬০ লাখ টাকা বিল পরিশোধ করে দেন। বলা যায়, বিমানবন্দরের সব কর্মকর্তার পেটেই চলে যায় এই বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থ। এই অভূত ঘটনা গণমাধ্যমে শিরোনাম হলে দুদক, কক্সবাজার স্বপ্রণোদিত হয়ে একটি মামলা দায়ের করে। মামলা নম্বর ৮৬১/২০১৯।
দীর্ঘ সময় ধরে অনুসন্ধানের পর দুদক ২০২৩ সালে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। শুরু হয় বিচার। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গঠন করা হয় চার্জ। এই চার্জের বিরুদ্ধে বিমানবন্দরের সাবেক ব্যবস্থাপক হাসান জহির উচ্চ আদালতে রিভিউ মামলা দায়ের করেন। শুনানির পর উচ্চ আদালত মামলার বিচার কার্যক্রমের ওপর প্রথম ছয় মাস, এরপর আরও ছয় মাস এবং সবশেষে এক বছর স্থগিতাদেশ দেন।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) যেন তর সইছিল না। ঘটিয়ে বসে আরেক তুঘলকি কা-। মামলা নিষ্পত্তি না হতেই তারা তড়িঘড়ি কক্সবাজার বিমানবন্দরের সাবেক ব্যবস্থাপক হাসান জহিরের লঘুদ- অর্থাৎ, সাময়িক বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার করে নিয়ে তাকে ফায়ার বিভাগে পদায়ন করে। একইভাবে একে একে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শহীদুল আফরোজ, নির্বাহী প্রকৌশলী মিহির চাঁদ দে এবং সহকারী প্রকৌশলী ভবেশ চন্দ্রের সাময়িক বরখাস্তের আদেশও প্রত্যাহার করে নিয়ে তাদের বিভিন্ন বিভাগে পদায়ন করা হয়।
এদিকে, নির্বাহী প্রকৌশলী মিহির চাঁদ দে জন্ম দেন এক হাস্যরসাত্মক ঘটনার। তিনি সবার সাসপেনশন চ্যালেঞ্জ করে বেবিচকের বিরুদ্ধে ঠুকে দেন মামলা। মামলা নম্বর ৪৪৫/২০২৩। এ মামলার ফলে তাদের বেতন-ভাতা যখন আটকে যেতে বসে, তখন মিহির মামলাটি প্রত্যাহার করে নেন।
বেবিচক সূত্র বলছে, এ কারণেই হয়তো পুরস্কার হিসেবে গড়পড়তা তাদের সবার সাসপেনশন তুলে নেয় বেবিচক। ওদিকে দুদকের মামলা বিচারাধীন থাকা অবস্থায় পিআরএলে চলে যান সহকারী প্রকৌশলী ভবেশ চন্দ্র। তিনি আবেদন করেন তাকে যেন ৮০ ভাগ পেনশন দেওয়া হয়। কিন্তু বেবিচক আগ বাড়িয়ে তাকে শতভাগ পেনশন দিয়ে দেয়।

