ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২৫

বন্দির চাপে হিমশিম দেশের ৭০ কারাগার

মাইনুল হক ভূঁইয়া
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৩, ২০২৫, ১২:১৭ এএম

ক্রমবর্ধমান বন্দির চাপ সামাল দিতে পারছে না দেশের কারাগারগুলো। ধারণক্ষমতা অতিক্রম করে কয়েকগুণ বেশি বন্দি হয়ে যাওয়ায় এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। দেশের ৭০ কারাগারেই কম-বেশি একই অবস্থা। কারাগারগুলোর ধারণক্ষমতা ৪৩,১৫৭। বর্তমানে বন্দি রয়েছে প্রায় আশি হাজার ৮৫ জন। তবে ৩০ সেপ্টেম্বর বকশীবাজারে এক সংবাদ সম্মেলনে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোতাহার হোসেনের দেওয়া তথ্যমতে, কারা বন্দির সংখ্যা ছিল ৭০ হাজার। এক মাসে বেড়ে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮০ হাজার ৮৫ জনে। এ তথ্য প্রকাশ করে ১১ নভেম্বর সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (উন্নয়ন ও মিডিয়া) জান্নাত-উল ফরহাদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘ক্রমবর্ধমান বন্দির চাপ সামাল দিতে ৭টি নতুন কারাগার নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এগুলো হলোÑ কেরানীগঞ্জ, সিলেট, কিশোরগঞ্জ, মাদারীপুর, পিরোজপুর, খুলনা ও ফেনী। এরইমধ্যে কেরানীগঞ্জে দুটি এবং খুলনায় একটি নতুন কারাগারের কাজ শুরু করেছে।’ তিনি জানান, বর্তমানে রাজনৈতিক মামলায় গ্রেপ্তার আছেন কম বেশি ২২০ থেকে ২৩০ জন। এর মধ্যে সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী রয়েছেন ৪১ জন, সংসদ সদস্য ৪০, আমলা ৯৮ এবং পুলিশ রয়েছেন বেশ কয়েকজন। অন্যান্য বন্দি রয়েছেন পাঁচজন।

এআইজি প্রিজন আরও জানান, ডিভিশন পেয়েছেন অর্থাৎ প্রথম শ্রেণির বন্দির মর্যাদায় রয়েছেন ১৮৪ জন। তাদের মধ্যে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ৪১, সংসদ সদস্য ৪০, সরকারি কর্মকর্তা ৯৮ এবং অন্যান্য পাঁচজন।  কিন্তু ৩০ জন বিশেষ বন্দি যারা মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যÑ বিশেষ কারণে তারা ডিভিশন পাননি।  এদের একজন মন্ত্রী অথবা প্রতিমন্ত্রী, বাকি ২৯ জনই সংসদ সদস্য। তার তথ্যমতে, বন্দিদের মধ্যে যাবজ্জীবন কারাদ-প্রাপ্ত ছয় হাজার ৭০০, মৃত্যুদ-প্রাপ্ত দুই হাজার ৬০০। কারাগারগুলোয় বয়োবৃদ্ধ বন্দির সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়Ñ এ সংখ্যা কম-বেশি চারশ। তাদের সবারই বয়স সত্তুরের বেশি। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর এরা আটক হয়েছেন। মাদকসহ বিভিন্ন মামলায় আটক হয়ে নারী বন্দি রয়েছেন দুই হাজার ৮০০। মায়েদের সঙ্গে শিশু বন্দি রয়েছে ২৫১, আরপি বন্দি ১৫৪। হাতেগোনা কিছু ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দি ছাড়া বাদবাকি সবারই অবস্থা নাজুক।

কারা অধিদপ্তর সূত্রের তথ্য বলছে, বিচারাধীন মামলার বন্দি প্রায় ৫০ হাজার এবং সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি প্রায় ২১ হাজার। গত বছরের ডিসেম্বরে বিচারাধীন বন্দির সংখ্যা ছিল ৫০ হাজার। দিন যত গড়াচ্ছে আর এর সংখ্যা স্ফীত হচ্ছে। গণঅভ্যুত্থানকেন্দ্রিক রাজনৈতিক মামলা এবং এবং ফৌজদারিসহ নানামুখী মামলায় ধরপাকড় বেড়ে যাওয়াকে এ জন্য দায়ি করছেন বিশেষজ্ঞগণ। তারা বলছেন, কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের রুটিন ধরপাকড়ের আরও একটি কারণ হতে পারে। গত ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত দেশজুড়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন এক হাজার ৪৩২ জন।

এই প্রতিবেদন লেখার শেষ পর্যায়ে ৭ নভেম্বরও পরিসংখ্যান বলছে, সারা দেশে পুলিশি অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছে এক হাজার ৮৩১ জন। সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ জানিয়েছে, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে রয়েছে মামলা ও ওয়ারেন্টের ভিত্তিতে এক হাজার ২৩৩ জন এবং অন্যান্য ঘটনায় ৫৯৮। এ ধরনের গ্রেপ্তার কিন্তু থেমে নেই। ৯ নভেম্বরও কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ২৫ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে গোযেন্দা পুলিশ (ডিবি)। সংগঠনটি ১৩ নভেম্বর আওয়ামী লীগ লকডাউন ঘোষণা করেছে। এ কর্মসূচিকে ঘিরে ১০ নভেম্বর থেকে বিভিন্ন অভিযোগে তাদের নেতাকর্মীদের আটক করা হয়েছে প্রায় শ’দুয়েক। সুতরাং, বন্দির সংখ্যা বেড়ে যাওয়াটা অস্বাভাবাবিক কিছু নয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জামিনপ্রাপ্ত একজন হাজতির সঙ্গে কথা হয় রূপালী বাংলাদেশের। তার বয়ান অনুযায়ী, ‘ভালো নেই বন্দিরা। দিন দিন অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছেÑ সেলগুলোয় মানবেতর জীবন-যাপন করতে হয়। চিৎ-কাত হয়ে কোনোরকম রাত পার করতে হচ্ছে। বারান্দায় হাই পাওয়ারের লাইটের তীব্র আলোয় ঘুম পালিয়ে যায়, কোনোরকম চোখ বুঁজে পড়ে থাকা আর কী!, মুক্ত হাওয়ায় বেরিয়ে আসা যুবকটি আরও জানায়, ‘কতদিন যে গোসল নেই বন্দিদেরÑ তার কোনো ইয়ত্তা নেই, অনেকেই তাই অসুস্থ হয়ে পড়ছে, ঘন ঘন হাসপাতালে নিতে গিয়ে কেউ কেউ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।’ তার বক্ত্যব্য, ‘জেলখানার ভেতরের আরও কাহিনি আছেÑ সেসব কথা বলতে গেলে রাতের পর রাত চলে যাবে, তবু কথা ফুরোবে না। এখানেই গল্পের শেষ নয়, অসুস্থতাসহ  নানা কারণে কারাগারে আজকাল মৃত্যুর অভিযোগও উঠছে।’

সম্প্রতি এ ধরনের বেশকিছু মৃত্যুর ঘটনা মানুষের মনোজগতে ঝড় তুলেছে। এর মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী অ্যাডভোকেট নুরুল মজিদ হুমায়ুনের মৃত্যু এখনো মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। কারা অধিদপ্তরের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, বিগত পাঁচ বছরে নানা কারণে কারাগারে ৯৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে কারাগার অথবা হাসপাতালে নেওয়ার সময় মৃত্যু হয় বছরে কম-বেশি ৫৮ জনের। গত পাঁচ বছরে কারাগার থেকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা গেছেন ২৭৫ বন্দি। সূত্রটি এ জন্য বিচারের দীর্ঘসূত্রতার পাশাপাশি কারা হাসপাতালে চিকিৎসক সংকটকে দায়ি করেন। সূত্রের দাবি, হাতেগোনা কয়েকজন পার্টটাইমার চিকিৎসক দিয়ে চালাতে গিয়ে বন্দি মৃত্যু ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।