ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৫৮৩টি মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গত ২৫ জুন পর্যন্ত দায়ের হওয়া ২৭টি মামলা আছে। সবকটিতে শেখ হাসিনাকে আসামি করা হয়েছে। ৫৮৩টি মামলার মধ্যে ৩২৪টি হত্যা মামলা। এ ছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলা আছে সাতটি। জার্মানিভিত্তিক বার্তা সংস্থা ডয়চে ভেলের এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে আসে।
এতে বলা হয়, পুলিশ সদর দপ্তরের এক হিসাবে দেখা গেছে, জুলাই-আগস্ট আন্দোলন পরবর্তী সারা দেশে ১ হাজার ৬০২টি মামলা দায়ের হয়েছে। এসব মামলায় হত্যা, হত্যাচেষ্টা, হামলা ভাঙচুর, মারধর, অগ্নিসংযোগ, ভয়ভীতি প্রদর্শন, লুটপাট, চাঁদাবাজি ও দখলবাজির অভিযোগ করা হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা মামলা হয়েছে ৫৯৯টি আর অন্যান্য মামলা হয়েছে এক হাজার তিনটি। এর মধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঢাকাসহ সারা দেশের থানা ও নি¤œ আদালতে ৩২৪টি হত্যা মামলাসহ মোট ৫৭৬টি মামলা দায়ের হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একটি মামলার শুনানি শেষ হয়েছে। সেটির রায়ের তারিখ জানা যাবে বৃহস্পতিবার। এর বাইরে গুমসংক্রান্ত একটি মামলায় চার্জশিট হয়েছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। সেটির শুনানি এখনো শুরু হয়নি। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি মামলার তদন্তকাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সেগুলোতে পর্যায়ক্রমে চার্জশিট দেওয়া হবে।’
শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন আইনি লড়াই করেছেন। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘আমি আশা করি, যে তথ্য-উপাত্ত দিয়েছি তাতে শেখ হাসিনা খালাস পাবেন।’
শেখ হাসিনার পক্ষে কেউ আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে কী নাÑ জানতে চাইলে আমির হোসেন বলেন, ‘শেখ হাসিনা বা তার পক্ষে কেউ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। তারা কোনো তথ্য উপাত্তও আমাকে সরবরাহ করেনি। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে যা পেয়েছি সেটা এবং নিজের আইনজীবী জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি শেখ হাসিনার পক্ষে ডিফেন্স করেছি।’
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যত অভিযোগ : আগামী ১৭ নভেম্বর যে মামলার রায়ের তারিখ জানা যাবে সেই মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও অন্য দুজন আসামি আছেন। তারা হলেনÑ সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামনু। এর মধ্যে চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন রাজসাক্ষী হয়েছেন। চৌধুরী মামুন বর্তমানে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর অপর দুই সদস্য বিচারক হলেন মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
জুলাই অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে যৌথ দায় হিসেবে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে। ফরমাল চার্জ মোট ১৩৫ পৃষ্ঠার। এক নম্বর অভিযোগে বলা হয়েছে, গত বছরের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আসামি শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান এবং নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণের অংশ হিসেবে হত্যা, হত্যার চেষ্টা, নির্যাতন এবং অন্যান্য অমানবিক আচরণ করার অপরাধসমূহ সংঘটনের প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, অপরাধ সংঘটন প্রতিরোধে ব্যর্থতা, অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ি। শেখ হাসিনা হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। এই মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দায় হিসেবে তার সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়েছে প্রসিকিউশন। এই মামলার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- পর্যন্ত দিতে পারেন আদালত।
চলতি বছরের ১০ জুলাই শেখ হাসিনার মামলায় অভিযোগ গঠন করা হয়। এ মামলায় ৩ আগস্ট সূচনা বক্তব্য এবং ৪ আগস্ট প্রথম সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ধার্য করা হয়েছিল।
শেখ হাসিনার ছয় মাসের কারাদ- : গত জুলাই মাসে আদালত অবমাননার একটি মামলায় শেখ হাসিনাকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদ- দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এই আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের দুই সদস্য হলেনÑ বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। এই মামলার অপর আসামি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের শাকিল আকন্দ বুলবুল ওরফে মো. শাকিল আলমকে দুই মাসের বিনাশ্রম কারাদ- দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। গণঅভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এই প্রথম কোনো মামলায় শেখ হাসিনার কারাদ- হলো।
কয়েক মাস আগে ‘২২৬ জনকে হত্যার লাইসেন্স পেয়ে গেছি’Ñ এমন একটি অডিও অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে। অডিওর এ বক্তব্য শেখ হাসিনার উল্লেখ করে তিনি ও শাকিল আকন্দ বুলবুলের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আদালত অবমাননার মামলা করে প্রসিকিউশন। সেই মামলায় চূড়ান্ত শুনানি শেষে রায় ঘোষণা করা হয়।
রায়ের পর সাংবাদিকদের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেছিলেন, সাবমিশনে তারা বলেছিলেন, শেখ হাসিনার তর্কিত যে কনভারসেশন, সেটি পুলিশের সিআইডির মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। তারা পরীক্ষা করে রিপোর্ট দিয়েছে, এখানে যে দুজন ব্যক্তির কনভারসেশন, তার একজন শেখ হাসিনা ও অন্যজন শাকিল আকন্দ বুলবুল। কনভারসেশনটি এআই জেনারেটেড নয়। অর্থাৎ প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরি করা হয়নি। এটি জেনুইন একটি কনভারসেশন।
‘রাষ্ট্রদ্রোহ’, বিচারের জন্য প্রস্তুত আরেকটি মামলা : শেখ হাসিনাসহ ২৮৬ জনের বিরুদ্ধে ‘অন্তর্বর্তী সরকারকে উৎখাত ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকা-ে’ অংশ নেওয়ার অভিযোগে করা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা বিচারের জন্য প্রস্তুত হওয়ায় তা বিচারিক আদালতে বদলি করা হয়েছে। মঙ্গলবার ঢাকার মহানগর হাকিম ইশরাত জেনিফার জেরিন এ আদেশ দেন। তিনি বিচারের পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য মামলাটি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে বদলির আদেশ দেন। ‘জয় বাংলা ব্রিগেড’ এর জুম মিটিংয়ে অংশ নিয়ে তারা সরকারকে ‘উৎখাতের’ চেষ্টা করেন বলে মামলায় অভিযোগ আনা হয়।

