ঢাকা শুক্রবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৫

পানি সংকটে ৫ লাখ একর ফসলি জমি

সাইফুল ইসলাম, ভেড়ামারা (কুষ্টিয়া) প্রতিনিধি
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৪, ২০২৫, ০১:১৪ এএম

*** গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচপ্রকল্প
*** প্রকল্পের আওতায় ৪ জেলার ১৩ উপজেলা
*** বিকল হয়ে আছে এই প্রকল্পের ১২টি সাব-পাম্প
*** তিনটি প্রধান পাম্পের মধ্যে একটি অচল
*** জিকে সেচখালের পানি দিয়ে চাষাবাদে বিঘাপ্রতি খরচ ৩০০ টাকা
*** ডিজেলচালিত শ্যালোইঞ্জিনে চাষাবাদে খরচ ১০-১২ হাজার টাকা
*** বোরো চাষ নিয়ে বিপাকে প্রায় কয়েক লাখ কৃষক

দীর্ঘদিন ধরে পানির পাম্প বিকল থাকায় দেশের বৃহত্তম কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার গঙ্গা-কপোতাক্ষ জিকে সেচপ্রকল্পের বেহাল দশা। বিকল হয়ে পড়ে আছে প্রকল্পের ১২টি সাব পাম্প। তিনটি প্রধান পাম্পের মধ্যে একটি অচল। ফলে ব্যাহত হচ্ছে কুষ্টিয়াসহ আশপাশের ৪ জেলার সেচব্যবস্থা। তাই অনিশ্চয়তায় পড়েছে ৪ জেলার ১৩টি উপজেলার প্রায় পৌনে ৫ লাখ একর জমির এই মৌসুমের চাষাবাদ। এতে বিপাকে  প্রায় কয়েক লাখ কৃষক।

ভেড়ামারা উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, জিকে প্রজেক্টের আওতায় ভেড়ামারার দুটি ইউনিয়ন চাঁদগ্রাম ও বাহিরচরের বিস্তীর্ণ ফসলি জমি পড়েছে। যার পরিমাণ ১ হাজার ৫৩০ হেক্টর। এর মধ্যে বোরো ধানের আবাদ ৬৩৫ হেক্টর, সরিষা আবাদ ১১৯ হেক্টর বাকি জমিতে চাষ হয় ভুট্টা, গমসহ অন্যান্য ফসল। ভেড়ামারার জিকে পাম্প হাউসের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান জানান, দ্রুত সময়ের মধ্যে পাম্পগুলো সচল করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এদিকে অভিযোগ উঠেছে, বোরো মৌসুমে গম, সরিষা, ভুট্টাসহ অন্যান্য চাষাবাদ শুরু হয়েছে ১৫ অক্টোবর থেকে। কিন্তু পানি না থাকায় চরম বিপাকে পড়েছে কৃষকরা। চলতি বোরো মৌসুমে উৎপাদন নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে তাদের মাঝে।

কৃষকদের দাবি, জিকে সেচখালের পানি দিয়ে চাষাবাদ করতে খরচ হয় বিঘাপ্রতি মাত্র ৩০০ টাকা। অন্যদিকে ডিজেলচালিত শ্যালোইঞ্জিন দিয়ে চাষাবাদে খরচ ১০-১২ হাজার টাকা। এত বিপুল পরিমাণ খরচের কারণে অনেক জমি তাই অনাবাদি থেকে যাচ্ছে। এর ফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে উৎপাদিত ফসলের মূল্যের চেয়ে উৎপাদন খরচই বেশি পড়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় কৃষকরা। যার ফলে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়ছে লাখ লাখ কৃষক।

ভুক্তভোগী এক কৃষক আসাদুর রহমান বলেন, শ্যালোমেশিন দিয়ে পানি তুলে চাষাবাদ করলে লাভের চেয়ে লোকসানের ভাগই বেশি চলে যায়। এই অঞ্চলের কৃষকরা খুবই অসহায়। শুষ্ক মৌসুমে পানি পাওয়া দুষ্কর হয়ে যায়। কৃষকদের সেচ কার্য সমাধানে কৃষি অধিদপ্তর ও পানি উন্নয়ন বোর্ডকে একসঙ্গে কাজ করা উচিত।

চাঁদগ্রাম ইউনিয়নের কৃষক শরিফুল ইসলাম জানান, গত বছরও জিকে খাল থেকে আমরা পানি পাই নায়। এ বছর আমার ১৫ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। ডিজেল ইঞ্জিনের মাধ্যমে যে পানি পাওয়া যায় সেটা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। চাঁদগ্রাম ইউনিয়নের আরেক কৃষক এনামুল মেম্বার বলেন, খালে পানি থাকলে বিঘাপতি খরচ ৩০০ টাকা। শ্যালো ইঞ্জিনের মাধ্যমে চাষ করলে বিঘাপতির খরচ ১০-১২ হাজার টাকা। জিকে খালে পানি না থাকলে গভীর নলকূপে পানি থাকে না। এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় শুকনো মৌসুমে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জিকে সেচ প্রকল্পের আওতায় রয়েছে ৪ জেলার ১৩টি উপজেলার প্রায় পৌনে ৫ লাখ একর জমি। এই সেচ প্রকল্পের পানির ওপর নির্ভরশীল কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মাগুরা এই ৪ জেলার ১৩টি উপজেলার কয়েক লাখ কৃষক। ৩টি পাম্পের মধ্যে ২টি পাম্প গত কয়েক বছর আগে থেকেই অচল হয়ে গেছে। পানির দুষ্প্রাপ্যতা আর লেয়ার নিচে নেমে যাওয়া আর পদ্মা নদীতে চর পড়ে পানির গভীরতা কমে যাওয়ায় এ বছরের শুরুতে একই সমস্যা হয়েছিল।

পাম্প হাউস সূত্রে জানা গেছে, ১৯৫১ সালে প্রাথমিক জরিপের পর ১৯৫৪ সালে জিকে সেচ প্রকল্প অনুমোদন পায়। ১৯৫৯ সালে প্রধান পাম্প হাউসের কার্যক্রম চালু হয়। ১৯৬২-৬৩ সালে প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যে জিকে সেচ প্রকল্প চালু করা হয়। তখন চাষযোগ্য ফসলি জমি ছিল ১ লাখ ১৬ হাজার ৬০০ হেক্টর। পরবর্তীতে পাম্পের ক্যাপাসিটি কমার সঙ্গে সঙ্গে জমির পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৯৫ হাজার ৬১৬ হেক্টর। শুরুতে তিনটি পাম্প দিয়ে বছরে ১০ মাস (১৫ জানুয়ারি থেকে ১৫ আক্টোবর পর্যন্ত) দিনরাত ২৪ ঘণ্টা পানি উত্তোলন করা যেত। বাকি ২ মাস রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পাম্প তিনটি বন্ধ রাখা হতো। ৩টি পাম্প সচল থাকলে ৪ জেলার ১৯৩ কিলোমিটার প্রধান খাল, ৪৬৭ কিলোমিটার শাখা খাল ও ৯৯৫ কিলোমিটার প্রশাখা খালে পানি সরবরাহ করা সম্ভব হয়। আর সেচ প্রকল্পের প্রধান এবং শাখা খালগুলোতে পানি থাকলে এখান থেকে কৃষকরা নিরবচ্ছিন্ন সেচ সুবিধা পান। ৩টি পাম্প একসঙ্গে চালু থাকলে প্রতি সেকেন্ডে ৩ হাজার ৯০০ কিউসেক পানি আবাদি জমিতে দেওয়া সম্ভব হয়। এ ছাড়া বিকল্প হিসেবে আরও ১২টি ছোট পাম্প ছিল। সেগুলোও বিকল হয়ে গেছে। উপর্যুপরি কয়েক বছর আগে ২টি পাম্প সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে যায়। এর সঙ্গে সঙ্গে ক্যানালগুলোর পানি ধারণক্ষমতাও কমে গেছে। কোথাও কোথাও এর শাখা খালগুলো মরে গেছে বলেও জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তাগণ।