ঢাকা রবিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৫

শুক্রবারের ভয়াবহ ভূমিকম্প

ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের নির্দেশ, উৎপত্তিস্থলের নমুনা সংগ্রহ

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: নভেম্বর ২৩, ২০২৫, ০২:১৮ এএম
  • বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একই স্থানে বারবার কম্পনে বড় বিপদের শঙ্কা
  • ভূমিকম্পে মেট্রোরেলের ছয় স্টেশনে ফাটল, যাত্রীরা উদ্বিগ্ন
  • পালিয়েছেন পুরান ঢাকার ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের মালিকরা
  • নরসিংদীতে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে কাজ করছে প্রশাসন

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তীব্র ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের জন্য সংশ্লিষ্ট সব মহলকে নির্দেশনা দিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক ই আজম (বীরপ্রতীক)। এ ছাড়া পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ এবং সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরকে অবিলম্বে মাঠপর্যায়ের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। এদিকে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নরসিংদী যে এলাকায় ফাটল ধরেছে সেখানকার মাটির নমুনা সংগ্রহ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগ। গত শুক্রবার রাজধানীতে পাঁচ দশমিক সাত মাত্রার ভূমিকম্পে মেট্রোরেলের অন্তত ৬টি স্টেশনে ফাটল দেখা দিয়েছে। এই স্টেশনগুলো হলোÑ কারওয়ান বাজার, বিজয় সরণি, পল্লবী, মিরপুর-১০, মিরপুর-১১ ও ফার্মগেট। এ নিয়ে যাত্রীদের মধ্যে বিরাজ করছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ভূমিকম্প নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কারণ রয়েছে। একই স্থানে বারবার কম্পন হলে বুঝতে হবে সামনে বড় ভূমিকম্প আসছে। সে বিষয়ে অপেক্ষা করতে হবে আরও চার-পাঁচ দিন। তারপর বোঝা যাবে কী হয়।

গতকাল শনিবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে তীব্র ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার ঘটনায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ এবং সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরকে অবিলম্বে মাঠপর্যায়ে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের নির্দেশনা দিয়েছেন উপদেষ্টা ফারুক ই আজম। দ্রুত ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ শেষে তা অবহিত করা হবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে তাৎক্ষণিক একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। কন্ট্রোল রুমের টেলিফোন নম্বর ০২৫৮৮১১৬৫১। এ নম্বরে সবাইকে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। পাশাপাশি, এ নিয়ে কোনো ধরনের গুজব বা বিভ্রান্তিতে কান না দিয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার অনুরোধ জানানো হয়েছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী জানান, একই স্থানে বারবার কম্পন হলে সামনে বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে। তিনি বলেন, ‘ভূমিকম্প নিয়ে আতঙ্কিত হওয়া ছাড়া উপায় নেই। একই স্থানে বারবার কম্পন হলে বুঝতে হবে সামনে বড় ঝুঁকি আসছে। সে বিষয়ে অপেক্ষা করতে হবে আরও চার-পাঁচ দিন। তারপর বোঝা যাবে কী হয়।’

অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ‘বিগত দুই দিনে যে তিনটি ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। তিনটিরই উৎপত্তিস্থল নরসিংদীতে। একই স্থানে বারবার কম্পন হলে সামনে বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে।’

ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর ফাটল এলাকার মাটির নমুনা সংগ্রহ : গত শুক্রবার ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নরসিংদীর যে এলাকায় ফাটল ধরেছে গতকাল শনিবার দুপুরে সেখানকার মাটির নমুনা সংগ্রহ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগ। দেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র জানিয়েছে, ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল নরসিংদীর মাধবদীতে। যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসজিএস বলছে, কেন্দ্রস্থল নরসিংদী সদর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার পশ্চিম-দক্ষিণ পশ্চিমে।

গুগল ম্যাপ অনুযায়ী, কেন্দ্রস্থল ছিল নরসিংদীর পলাশ উপজেলার শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত ডাঙ্গা গ্রামে। এটি পলাশ উপজেলার ঘোড়াশাল পৌর শহর ও সদর থানার মাধবদীর পাশের এলাকা। ফলে এই অঞ্চলের মানুষ ভূমিকম্পের কম্পন বেশি অনুভব করেন।

শুক্রবার সকালে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ভূমিকম্পে নরসিংদীর ঘোড়াশালের বিভিন্ন স্থানে ফাটল ধরা মাটির নমুনা সংগ্রহের পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগ। গতকাল সকালে ঘোড়াশাল পৌর এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত ঘোড়াশাল ডেইরি ফার্ম ও পলাশ রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজে ধসে পড়া মাটির নমুনা সংগ্রহে কাজ করে ভূতত্ত্ব বিভাগের ৭ সদস্যের একটি দল।

এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আ.স.ম ওবায়দুল্লাহ জানান, প্রাথমিকভাবে ফাটল ধরা মাটির নমুনা সংগ্রহ করেছেন তারা। এসব নমুনা সংগ্রহের পর তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কী ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে বা কতটুকু গভীরতায় তা নিশ্চিত হওয়া যাবে।

অন্যদিকে জেলাব্যাপী ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করতে কাজ করছে জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন ইউনিট। আগামী তিন-চার দিনের মধ্যে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আবু তাহের মো. শামসুজ্জামান।

ভূমিকম্পে মেট্রোরেলের ছয় স্টেশনে ফাটল, যাত্রীরা উদ্বিগ্ন : ভূমিকম্পে মেট্রোরেলের অন্তত ছয়টি স্টেশনে ফাটল দেখা দিয়েছে। এই স্টেশনগুলো হলোÑ কারওয়ান বাজার, বিজয় সরণি, পল্লবী, মিরপুর-১০, মিরপুর-১১ ও ফার্মগেট। সরেজমিন দেখা গেছে, কারওয়ান বাজার ও বিজয় সরণি স্টেশনের বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন কক্ষের ফ্লোরে ফাটল ধরেছে। বিজয় সরণিতে সাব-স্টেশনের প্রবেশদ্বারের দেয়ালেও ফাটল লক্ষ্য করা গেছে। পল্লবী স্টেশনে বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন এবং নিয়ন্ত্রণ কক্ষের দেয়ালে ফাটল দেখা গেছে। মিরপুর-১১ স্টেশনের সাব-স্টেশনের ফ্লোরে এবং মিরপুর-১০-এর কিছু টাইলসে ফাটল পাওয়া গেছে। ফার্মগেট স্টেশনে লিফট কোরের ভেতরের দেয়ালে ফাটল লক্ষ্য করা গেছে।

পল্লবী স্টেশনের কন্ট্রোলার ফাটল সম্পর্কে প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে জানিয়েছেন, এটি ভূমিকম্পের কারণে বা আগের সময় থেকেই থাকতে পারে। মেট্রোরেল কর্মকর্তা ও কর্মীরা জানিয়েছেন, ফাটল দেখা দিয়েছে এবং অনেকে ভয়ে আছে। ডিএমটিসিএল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদ ফোন রিসিভ করেননি।

তবে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অন্তর্বর্তী উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানিয়েছেন, ‘ফাটল গুরুতর নয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। ট্রায়াল রানের পর ঝুঁকি পাওয়া যায়নি বলেই মেট্রোরেল চালানো হচ্ছে। ভূমিকম্পের পর স্টেশনগুলোর নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হয়েছে।’ যাত্রীদের মধ্যে ভূমিকম্প ও ফাটলের কারণে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে, তবে কর্তৃপক্ষ আশ্বাস দিয়েছেন, মেট্রোরেল নিরাপদে চালু রয়েছে।

পলাতক পুরান ঢাকার ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের মালিকরা : শুক্রবারের ভূমিকম্পের পর পুরান ঢাকার কসাইটুলির ক্ষতিগ্রস্ত ভবন মালিকরা পালিয়েছেন। গতকাল সকালে ভবন পরিদর্শনে গিয়ে তিন মালিকের কারও দেখা পাননি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কর্মকর্তারা। পরে কাউকে না পেয়ে তারা কথা বলেন এক ভবন মালিকের স্ত্রীর সঙ্গে। এ সময় বাড়ির নকশা দেখতে চান রাজউক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রিয়াজুল ইসলাম। তবে তা দেখাতে পারেননি ভবন মালিকের স্ত্রী। চেয়ারম্যান জানান, ‘সাত দিনের মধ্যে নকশা দেখাতে না পারলে ভবন সিলগালা করা হবে।’ শুক্রবারের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ঢাকার সব ভবনের তথ্য নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি। একইসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ সব ভবন চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

নরসিংদীতে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে কাজ করছে প্রশাসন : এদিকে নরসিংদীতে ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ, ফাটল ধরা সরকারি-বেসরকারি ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা চিহ্নিতকরণে কাজ করছে জেলা প্রশাসন। এ ছাড়া ভূমিকম্পে নিহতদের পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে।

ভূমিকম্পে পলাশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চারটি আবাসিক ভবন, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও সার্কিট হাউসে ফাটলসহ শতাধিক ভবনে ছোট ছোট ফাটল পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানের পর সুনির্দিষ্ট তথ্য জানাবে জেলা প্রশাসন। এদিকে ঘোড়াশাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে আগুনে ক্ষতিগ্রস্তের পর জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে সংযোগ গতকাল শুক্রবার রাতেই মেরামত হয়েছে।

ভূমিকম্পে হতাহতদের ব্যাপারে নরসিংদী পৌর প্রশাসক ও স্থানীয় সরকার শাখার উপপরিচালক মো. মনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এই মুহূর্তে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কেউ নেই, দু-একজন বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে নিহতদের পরিবারকে ২৫ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়েছে। নরসিংদী শহরে হেলে পড়া ভবন, ফাটল ধরা ভবন চিহ্নিত করতে পৌর নির্বাহী প্রকৌশলীকে প্রধান করে চার সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি পরিদর্শন করে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করবে। পরবর্তীকালে জেলা পর্যায়ের কমিটি মোট ক্ষতির পরিসংখ্যান নির্ধারণ করবে।’