চলতি বছর এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ১১ বোর্ডে গড় পাসের হার ছিল ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ, যা গত দুই দশকের মধ্যে সর্বনি¤œ। অনুত্তীর্ণ হন ৫ লাখ ৮ হাজার ৭০১ শিক্ষার্থী। গত বছরের তুলনায় কমলেও চলতি বছর বোর্ডওয়ারি পাসের হারে শীর্ষে ছিল মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে যেখানে পাসের হার ছিল ৫৭ দশমিক ১২ শতাংশ, সেখানে মাদ্রাসা বোর্ডের আলিম পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৭৫ দশমিক ৬১ শতাংশ। অন্যদিকে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার ছিল ৬২ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ফলাফল বিপর্যয়ের এমন পরিস্থিতিতেও মাদ্রাসা বোর্ডের পাসের হার নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য অর্জন। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিগত বছরগুলোয় এই বোর্ডের দাখিল (এসএসসি) স্তরে যত শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হতো, আলিম স্তরে শিক্ষার্থী ভর্তি হতো অর্ধেকেরও কম। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর পাল্টে গেছে শিক্ষার্থী ভর্তির এই চিত্র। আগামী ২০২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষে এই স্তরে বেড়েছে শিক্ষার্থী ভর্তির হার, যা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে বলে আশা বোর্ড কর্তৃপক্ষের। মাদ্রাসা শিক্ষার উজ্জ্বল চিত্র সামনে রেখে ২০২৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে দাখিল স্তরে চালু হচ্ছে ব্যবসায় শিক্ষা শাখা। এরই মধ্যে এ বিষয়ের কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে কাজ চলছে।
শিক্ষার্থী ভর্তির হার বাড়ার বিষয়ে বোর্ড কর্তৃপক্ষ বলছে, গণঅভ্যুত্থানের আগে দীর্ঘ সময় মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে ব্যাপক নেতিবাচক প্রচারণা ছিল। ইবতেদায়ি ও দাখিল স্তরে ভর্তির হার মোটামুটি থাকলেও পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীরা ব্যাপক হারে সাধারণ শিক্ষায়Ñঅর্থাৎ কলেজে ভর্তি হতেন। মূলত মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে নেতিবাচক ধারণার কারণেই আলিম সনদ নিয়ে উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ করা ঝুঁকিপূর্ণ আশঙ্কা করে শিক্ষার্থী ও অভিভাবক কেউই এই স্তরের শিক্ষায় থাকতে চাইতেন না। তবে ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে মানুষের মনে ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে শিক্ষার্থী ভর্তির হারেও। অন্যদিকে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের নানা চ্যালেঞ্জ নিয়ে পড়াশোনা করতে হয়, পড়াশোনার বাইরে অন্যান্য বিষয় নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা যেমন ব্যস্ত থাকেন, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা ব্যতিক্রম। নিরবচ্ছিন্ন পড়াশোনার মধ্যে থাকার কারণেই চলতি বছরের বিপর্যয়ের মধ্যেও মাদ্রাসা বোর্ডের ফলাফল উজ¦ল।
মাদ্রাসা বোর্ড থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষন করে দেখা গেছে, ২০২২ সালে এই বোর্ডের দাখিল পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ২ লাখ ৬০ হাজার ১৩২ জন। পাস করেছিল ২ লাখ ১৩ হাজার ৮৮৩ জন। পাসের হার ছিল ৮২ দশমিক ২২ শতাংশ। দুই বছর পড়াশোনার পর গত বছর এই বোর্ডের আলিম পরীক্ষায় অংশ নেয় ৮৫ হাজার ৫৫৮ জন। পাস করে ৭৯ হাজার ৯০৯ জন। পাসের হার ৯৩ দশমিক ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ দাখিল থেকে আলিমে দেড় লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী কম ভর্তি হয়। ২০২৩ সালের দাখিলে অংশ নেয় ২ লাখ ৯৫ হাজার ৫২০ জন। পাস করে ২ লাখ ১২ হাজার ৯৬৪ জন। পাসের হার ৭৪ দশমিক ৭০ শতাংশ। দুই বছর পর চলতি বছরের আলিম পরীক্ষায় অংশ নেয় মাত্র ৮৬ হাজার ৬০১ পরীক্ষার্থী। পাস করে ৬২ হাজার ৬০৯ জন। পাসের হার ৭৫ দশমিক ৬১ শতাংশ। অর্থাৎ দুই বছরে এই স্তরে শিক্ষার্থী ভর্তি কমেছে প্রায় দুই লাখের মতো।
২০২২ ও ২০২৩ সালে আলিমে শিক্ষার্থী ভর্তির হার কমলেও গত বছর থেকে এই ধারায় পরিবর্তন দেখা গেছে। বোর্ডের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত বছর দাখিলে পরীক্ষার্থী ছিল ২ লাখ ৯১ হাজার ৩৯০ জন। পাস করেছে ২ লাখ ২৬ হাজার ৭৫৪ জন। পাসের হার ৭৯ শতাংশ। উত্তীর্ণ এই পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ২০২৬ সালের আলিম পরীক্ষায় অংশ নিতে যাচ্ছে প্রায় দেড় লাখ পরীক্ষার্থী। ২০২২ ও ২০২৩ সালের পরিক্ষার্থীর সংখ্যা ছাড়িয়েছে লাখের বেশি। ২০২৭ সালে কত সংখ্যক শিক্ষার্থী আলিম স্তরে পড়াশোনা করছেন সেই সংখ্যা বুয়েট থেকে বোর্ড এখনো পায়নি বলে জানা গেছে।
বোর্ড কর্তৃপক্ষের বক্তব্য অনুযায়ী নেতিবাচক প্রচারণা অথবা অন্য যেকোনো কারণেই হোক, মানুষের মনে এক ধরনের উপলব্ধি ছিলÑ সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের তুলনায় মাদ্রাসা বোর্ডের পড়াশোনা সহজ, পরীক্ষার খাতা দেখায় শিক্ষকরা উদার বা পরিক্ষার্থীর তুলনায় পরীক্ষাকেন্দ্র অনেক বেশি। এ জন্য মাদ্রাসা বোর্ডের ফলাফল ভালো হয়। তবে এমন উপলব্ধির সত্যতা পাওয়া যায়নি। প্রথমত, সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের শিক্ষার্থীরা মোট ১৩০০ নম্বরে পরীক্ষা দিয়ে থাকেন। কিন্তু মাদ্রাসা বোর্ডের শিক্ষার্থীদের এই নম্বরের বাইরে আরও ৪টি বিষয়Ñ কোরআন, হাদিস, আরবি ও ফিকাহসহ মোট ১৭০০ নম্বরের পরীক্ষা দিতে হয়। পাশাপাশি মাদ্রাসার আলিম শিক্ষার্থীরা সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের শিক্ষার্থীদের মতোই বাংলা, ইংরেজি, পদার্থ, রসায়ন, জীববিজ্ঞান ও উচ্চতর গণিতের মতো সব বিষয় একইভাবে পড়ে থাকে। তবে সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে যেমনÑ বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও মানবিক বিভাগ রয়েছে, অন্যদিকে মাদ্রাসা বোর্ডে ৩৪টি বিষয় নিয়ে রয়েছে সাধারণ, বিজ্ঞান ও মুজ্জাবিদ মাহির বিভাগ। দ্বিতীয়ত, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সব বোর্ড কর্তৃপক্ষকেই উদার হাতে পরীক্ষার্থীদের নাম্বার দেওয়ার নির্দেশনা ছিল, যা মাদ্রাসা বোর্ডের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের পর পরীক্ষার খাতা দেখার নির্দেশনায় পরিবর্তনের পর মাদ্রাসা বোর্ডের ফলাফলেও এর প্রভাব দেখা গেছে। সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মতো আলিম পরীক্ষাতেও ইংরেজি, আইসিটি বিষয়ে খারাপ করেছে শিক্ষার্থীরা। প্রায় ৩৩ হাজার ৭১২ জন শিক্ষার্থী খাতা পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন করেছেন।
সাধারণ শিক্ষা বোর্ড ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষার্থীদের কারিকুলাম, সিলেবাসে কোনো পার্থক্য নেই বলে মন্তব্য করেছেন বোর্ডের কন্ট্রোলার অব পাবলিকেশন্স প্রফেসর এফ এম শাকিরুল্লাহ্। রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের চেয়ে আরও ৪টি বিষয় বেশি পড়ে ও পরীক্ষা দেয়। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা নামাজ ও পড়াশোনার বাইরে অন্য বিষয়ে মনোযোগ কম দেয়। যার ফলে তাদের পরীক্ষার ফলও ভালো হয়।’
দাখিল স্তরে প্রচুরসংখ্যক পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হলেও আলিম স্তরে শিক্ষার্থীদের ভর্তি না হওয়ার প্রবণতার বিষয়ে বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর ড. মো. কামরুল আহসান বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে মাদ্রাসা নিয়ে ভীষণ নেতিবাচক প্রচার ছিল। শিক্ষার্থীদের জঙ্গিসহ নানা ট্যাগ (তকমা) দেওয়া হতো। এতে আলিমের সনদ নিয়ে পরবর্তী উচ্চশিক্ষায় সংকট হবে কি না ইত্যাদি নানা শঙ্কা ছিল শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মধ্যে। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা সাধারণত নামাজ ও পড়াশোনার বাইরে অন্য বিষয়ে মনোযোগ কম দেন, পাশাপাশি এসব শিক্ষার্থীর বেশিরাভাগই দরিদ্র পরিবারের, তাদের নানা চ্যালেঞ্জ নিয়ে পড়াশোনা করতে হয়। তাই পরীক্ষায় পাস করা তাদের জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায়’, মন্তব্য করেন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক। পরীক্ষাকেন্দ্রের সংখ্যা যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
অন্যদিকে বোর্ড চেয়ারম্যান প্রফেসর মিঞা মো. নুরুল হক বলছেন, ‘মাদ্রাসা শিক্ষার মান ভালো বলেই বুয়েট, মেডিকেল ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের মতো বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলোর ভর্তি পরীক্ষায় শীর্ষে থেকে নির্বাচিত হচ্ছে এই স্তরের শিক্ষার্থীরা।’ শিক্ষার্থীদের ‘আমানত’ হিসেবে বিবেচনা করে শিক্ষকদের বিশেষ সেবা, ভালো করার জন্য মোটিভেশনাল কার্যক্রম ইত্যাদি বোর্ডের ভালো ফলাফলের অন্যতম কারণ বলে তিনি মন্তব্য করেন। বিগত আওয়ামী সরকারের সময় দায়িত্বশীলদের মাদ্রাসার শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য, বক্তব্যে আলিম স্তরের ভর্তিতে বাধা হয়েছিল বলেও তিনি মন্তব্য করেন। বর্তমান সময়ও এই শিক্ষার প্রতি ইতিবাচক ধারণা বাড়ায় আলিম স্তরে শিক্ষার্থী ভর্তি বেড়েছে এবং আগামীতেও বাড়বে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

