ঢাকা রবিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৫

ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে সিলেট

সবুজে মোড়া প্রকৃতিতে লুকিয়ে নীরব আতঙ্ক

আব্দুল আহাদ, সিলেট
প্রকাশিত: নভেম্বর ২৩, ২০২৫, ০২:৪৫ এএম

দেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তঘেঁষা সিলেটÑ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নগরী, চা-বাগানের সবুজে মোড়া প্রাণবন্ত শহর। কিন্তু এই সৌন্দর্যের নিচে লুকিয়ে আছে এক নীরব আতঙ্ক : ভূমিকম্পের ঝুঁকি। ভূতাত্ত্বিকভাবে সিলেট বরাবরই কম্পন-সংবেদনশীল। বহুদিন ধরে উচ্চ ঝুঁকির অঞ্চলে রয়েছে এ শহর।

দ্রুত নগরায়ণের চাপ, পুরোনো ভবনের আধিক্য এবং ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের কারণে সিলেট এখন সম্ভাব্য বড় ধরনের ভূমিকম্পে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একাধিক হালকা কম্পন অনুভূত হওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে উদ্বেগ বেড়েছে। তাই প্রশ্ন ওঠেÑ একটি বড় কম্পন এলে শহরের ভবিষ্যৎ কী দাঁড়াবে?

আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন স্থানে গত শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর মাধবদী। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৭, যা মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হিসেবে ধরা হয়। গত কয়েক বছরে সিলেট ও আশপাশের এলাকায় কয়েক দফা হালকা কম্পন ঘটেছে, যার মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৫ থেকে ৫-এর মধ্যে। ক্ষয়ক্ষতি না হলেও ঘন ঘন কম্পনের উপস্থিতি স্থানীয়দের মধ্যে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছেÑ এটি কি বড় কোনো ভূমিকম্পের পূর্বাভাস?

সিলেটের ভৌগোলিক অবস্থান ঝুকির অন্যতম কারণ। ভারতীয় ও বার্মিজ প্লেটের সীমানায় অবস্থান করায় এই অঞ্চলে ভূ-চাপ স্বাভাবিকভাবেই বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়েকটি কারণ ঝুঁকি আরও বাড়িয়েছে। এর মধ্যে অপরিকল্পিত নগরায়ণÑ দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, সংকীর্ণ রাস্তা, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। দুর্বল ভবন নির্মাণÑ অনেক ভবন এখনো আধুনিক ভূমিকম্প সহনশীলতা মানদ- মেনে তৈরি হয়নি; পুরোনো কাঠামোর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। সক্রিয় ফল্ট লাইনÑ ডাউকি ফল্টসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ফল্ট লাইনের নিকটতা ঝুঁঁকি বাড়িয়েছে। মাটির প্রকৃতিÑ নরম সেডিমেন্ট স্তর কম্পনের অভিঘাত বাড়াতে পারে। ভূতত্ত্ববিদরা সতর্ক করেছেন, এসব মিলিয়ে সিলেটে মাঝারি মাত্রার কম্পনও বড় ধরনের কাঠামোগত ক্ষতি ঘটাতে পারে।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ ও পুর প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম বলেন, ‘মধুপুর ফল্ট লাইন’ সক্রিয় হওয়া সিলেটের জন্য অশনিসংকেত। সিলেটেও বেশ কিছু নিষ্ক্রিয় ফল্ট লাইন আছে, যেগুলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ছোট ছোট কম্পন দিচ্ছে। তাই ডাউকি ফল্টের পাশাপাশি এসব ছোট ও নিষ্ক্রিয় ফল্টকেও গুরুত্ব দেওয়ার সময় এসেছে।

তিনি সতর্ক করে বলেন, সিলেটে এ ধরনের ভূমিকম্প হলে পুরোনো ও নন-ইঞ্জিনিয়ারিং ভবনগুলো ধসে পড়ার ঝুঁকি বেশি। শহরকে নিরাপদ রাখতে এখনই এসব ভবন পরীক্ষা করে সংস্কার জরুরি।

ড. জহিরের মতে, সিলেটে দুর্যোগ মোকাবেলার সক্ষমতা বাড়লেও তা এখনো প্রয়োজনের তুলনায় কমÑ মাত্র ৩০-৪০ শতাংশ। উপশহর এলাকা জলাশয় ভরাট করে তৈরি হওয়ায় এবং সেখানে হাইরাইজ ভবন বেশি থাকায় বড় ভূমিকম্পে বেশি ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। এ ছাড়া নগরে খোলা মাঠের অভাবও দুর্যোগ মোকাবিলায় বড় বাধা হবে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তব প্রয়োগে দুর্বলতা স্পষ্ট। ভূমিকম্প মোকাবিলায় নেই নিয়মিত মহড়া। স্কুল, কলেজ ও সরকারি অফিসে ভূমিকম্প মহড়া বা জরুরি ব্যবস্থা যাচাই নিয়মিত হয় না। উদ্ধার সরঞ্জামের ঘাটতি : দমকল বাহিনী ও স্থানীয় উদ্ধার টিমের সক্ষমতা শহরের জনসংখ্যার তুলনায় অপর্যাপ্ত। এদিকে ঝুঁঁকিপূর্ণ ভবন শনাক্ত করা হলেও সংস্কার বা অপসারণ প্রক্রিয়া খুব ধীর। ভূমিকম্প মোকাবিলায় নেই জনসচেতনতাও।

ভূতত্ত্ববিদ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিলেট নরম সেডিমেন্টে গঠিত। কম্পনের অভিঘাত এখানে অন্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশি হতে পারে। মাঝারি মাত্রার কম্পনও বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। ভূতাত্ত্বিক গঠনের কারণে ভূমিকম্পের জন্য সিলেটকে দেশের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এর অন্যতম কারণ ভারতের মেঘালয়ের ডাউকি ফল্ট। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন ওই ফল্ট থেকে উৎপত্তি হওয়া ভূমিকম্পে বৃহত্তর সিলেটের বড় অংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। যা সিলেটের ইতিহাসে ‘বড় ভুইছাল’ হিসেবে পরিচিত।

২০২১ সালের মে মাসে ১০ দিনের মধ্যে সিলেটে ২০ বার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর মধ্যে ডাউকি ফল্টের কাছে ছিল কয়েকটির উৎপত্তিস্থল। বাকিগুলোর উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেট বিভাগ। ২০২১ সালে দফায় দফায় ভূমিকম্পের পর কিছুটা নড়েচড়ে বসে সিসিক। ঘোষণা দেওয়া হয় নগরের সব ভবন পরীক্ষা করার। পরবর্তী সময়ে বাজেট সংকটের অজুহাতে এই উদ্যোগ ভেস্তে যায়। ওই সময় ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ২২টি ভবন চিহ্নিত করা হয়। ভবনগুলোর কোনটি রঙ পাল্টে, আবার কোনটিতে ‘টুকটাক’ সংস্কার করিয়ে এখনো ঠিকে আছে।

প্রকৌশলী সায়মা রহমান বলেন, ‘ভবন নির্মাণে মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা এখনই জরুরি। ঝুঁঁকিপূর্ণ ভবনগুলো শনাক্ত ও দ্রুত সংস্কার না করলে কোনো বড় দুর্যোগে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। ভূমিকম্প কখন হবে তা বলা যায় না। তবে ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য প্রস্তুতি নেওয়াই সবচেয়ে কার্যকর উপায়। উদ্ধার সক্ষমতা এবং জনসচেতনতা বাড়ানো অতীব জরুরি।’

সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাই রাফিন সরকার জানান, ‘ভূমিকম্প মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পূর্বের জরিপ ও প্রস্তাবনাগুলো বিবেচনায় রেখে কাজ এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।’

প্রধান প্রকৌশলী আলী আকবর বলেন, ‘নানা সীমাবদ্ধতার কারণে আগে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি, তবে এখন নতুনভাবে উদ্যোগ গ্রহণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।’

ভূমিকম্প প্রতিরোধ করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে ক্ষতি কমানো মানুষের হাতে রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেনÑ পরিকল্পনা, প্রস্তুতি এবং মাননিয়ন্ত্রিত নির্মাণে নজর দিলে বিপর্যয় অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।