ঢাকা রবিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৫

বললেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

দেড় দশকের উন্নয়নে লাভবান রাজনীতিবিদ ব্যবসায়ী ও আমলা

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: নভেম্বর ২৩, ২০২৫, ০২:২৪ এএম
  • ব্যাংক, বিদ্যুৎসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন খাতের নিয়ন্ত্রণ চলে গিয়েছিল তাদের হাতেই
  • এলডিসির খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসার আহ্বান রেহমান সোবহানের

‘দেড় দশকে উন্নয়নের যে বয়ান তৈরি করা হয়েছিল, তাতে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলাÑ এই তিন গোষ্ঠী লাভবান হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তার মতে, এই গোষ্ঠীগুলো প্রতিযোগিতা এড়িয়ে চলেছে। পরিণামে দেশে শুধু স্বজনতোষী পুঁজিবাদ সৃষ্টি হয়নি, হয়েছিল চৌর্যতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা।’ গতকাল শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত তিন দিনব্যাপী ‘বে অব বেঙ্গল কনভারসেশন ২০২৫’ সম্মেলনের প্রথম দিন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এসব কথা বলেন। তিনি ওই অধিবেশনে একক বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ।

বিভিন্ন দেশের চিন্তাবিদ, রাজনীতিক, কূটনীতিক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের নিয়ে চতুর্থবারের মতো ঢাকায় এ অনুষ্ঠান হচ্ছে। এই সম্মেলনে ৮৫টি দেশের ২০০ বক্তা, ৩০০ প্রতিনিধি এবং ১ হাজারের বেশি অংশগ্রহণকারী যোগ দেবেন বলে এক সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিল সিজিএস।

অনুষ্ঠানে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘ব্যবসায়ী, আমলা ও রাজনীতিকদের একটি বলয় গড়ে উঠেছিল। ব্যাংক, বিদ্যুৎসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন খাতের নিয়ন্ত্রণ চলে গিয়েছিল তাদের হাতেই।’

সংস্কারের পরিকল্পনা করা সবচেয়ে সহজ কাজ; কিন্তু তা বাস্তবায়ন করা সবচেয়ে কঠিনÑ এমন মন্তব্য করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘সংস্কার সরকারের হাত দিয়ে শুরু হয় না, তেমনি সরকারের হাত দিয়ে শেষও হয় না। দেশ, মানুষ, অংশীজনÑ সবার ধারাবাহিক প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে সংস্কারের লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে গতি বজায় রেখে আলস্য দূরে রাখাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ এখন ঠিক এই প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে।’

সাম্প্রতিক কাজের ওপর ভিত্তি করে বিষয়টিকে ‘সংস্কারের সঙ্গে রোমান্স’ হিসেবে আখ্যা দেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। প্রায় ৪০ বছর আগের একটি জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের কথা স্মরণ করেন তিনি। চলচ্চিত্রটির নাম ছিল ‘রোমান্সিং দ্য স্টোন’। প্রধান চরিত্রে ছিলেন মাইকেল ডগলাস, ক্যাথলিন টার্নার ও ড্যানি ডেভিটো। সেই গল্পে অ্যাডভেঞ্চার বা রোমাঞ্চের দায়িত্ব ছিল মাইকেল ডগলাসের, রোমান্সের বা প্রেমের দায়িত্ব ছিল ক্যাথলিন টার্নারের আর কমেডি বা হাস্যরসের দায়িত্ব ছিল ড্যানি ডেভিটোর। এই তিন উপাদানের সমন্বয়ে গল্পটি আনন্দদায়ক হয়ে ওঠে বলে জানান দেবপ্রিয়।

দেবপ্রিয় বলেন, ‘বাংলাদেশের সংস্কারের অভিজ্ঞতাকেও একইভাবে এ তিন উপাদানের সমন্বয় হিসেবে দেখা যায়। আজ আমরা তিনটি মূল লক্ষ্য সামনে রেখেছি। এগুলো হচ্ছে ন্যায়বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন। এ তিন বিষয়ের কেন্দ্রে আছে সংস্কার। অন্য দুটি লক্ষ্যকে সংযুক্ত করছে এ সংস্কার। ফলে জাতি গঠনে আমাদের অগ্রগতির বিকল্প নেই এবং পেছনে ফিরে তাকানোর অবকাশ নেই।’

অন্তর্বর্তী সরকারের শ্বেতপত্র প্রতিবেদন প্রণয়নের কাজে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। সেই প্রতিবেদনে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি, গত দেড় দশকে দেশে উন্নয়ন বলতে কেবল কৌশল ও কর্ম সম্পাদন বোঝানো হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে উন্নয়ন ধারণাটি সংকীর্ণ করা হয়েছে। এখন যখন দেশ নতুন রাজনৈতিক সমাধানের খোঁজে, তখন চ্যালেঞ্জ হলো: কীভাবে সেই প্রতিযোগিতাবিরোধী জোট ভেঙে দেওয়া যায়। রাজনৈতিক হোক বা অর্থনৈতিকÑ কোনো ক্ষেত্রেই তারা প্রতিযোগিতা চায় না। এর উত্তর হলো সংস্কার। সংস্কারের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধান হতে পারে, নতুন চাহিদা পূরণ করতে পারে, কার্যকারিতা বাড়াতে পারে, সঠিকভাবে সম্পদ বরাদ্দ করতে পারে বা অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত হতে পারে। কিন্তু মূল সত্য হলো, এটি রাজনীতিবিদ ও নীতিপ্রণেতাদের জন্য সবচেয়ে বড় ধাঁধা। সংস্কার বাস্তবায়নের গাইড বই নেই। প্রায়োগিক অর্থনৈতিক নীতি জটিল বিষয়। সে কারণে সংস্কার প্রক্রিয়া শক্তিশালী, সুসংহত ও বাস্তবসম্মত হতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি দেশকে নিজস্ব পথ খুঁজে নিতে হবে।’

বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা থেকে কয়েকটি শিক্ষা পেয়েছেন মন্তব্য করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য শক্তিশালী বা দুর্বল রাষ্ট্র থাকা আবশ্যক নয়। পরিবর্তনের সময়ও সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো দূরদৃষ্টি, পরিকল্পনা, সমন্বয় ও ফলাফলের স্বচ্ছতা। তা সে স্বল্পমেয়াদি হোক বা মধ্যমেয়াদি। তবে এতে থাকতে হবে রাজনৈতিক সংযোগ এবং নাগরিকদের অংশগ্রহণ।’

একই অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান বলেন, বিশ্ব ব্যবস্থার ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। তাঁর মতে, এক সময় সারা বিশ্ব পশ্চিমের শাসনে থাকলেও ক্ষমতার ভরকেন্দ্র এখন ক্রমেই পূর্ব দিকে চলে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে তার অবস্থান নতুন করে সাজাতে হবে বলে মনে করেন রেহমান সোবহান। যে বাজারে পুঁজি সবচেয়ে বেশি সহজলভ্য এবং যে বাজারে দীর্ঘস্থায়ী প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে, বাংলাদেশের সেদিকেই যাওয়া উচিত।

ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ পশ্চিমঘেঁষা বলে মন্তব্য করেন রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর আমাদের জিডিপির ১০ থেকে ১৫ শতাংশ আসত পশ্চিমা সহায়তা থেকে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে। কিন্তু এখন সেই বাস্তবতা নেই। এখন বিদেশি সহায়তার ওপর নির্ভরশীলতা ২ শতাংশের মতো।’

রেহমান সোবহান আরও বলেন, ‘এমনকি যে সহায়তা আমরা পাই, তার একটি অংশ অব্যবহৃত থেকে যায়। এখনো প্রায় ৫০ বিলিয়ন বা ৫ হাজার কোটি ডলারের মতো বিদেশি সহায়তার প্রতিশ্রুতি পাইপলাইনে পড়ে আছে। আমাদের পুঁজির প্রধান উৎস এখন এশীয় দেশগুলো। এই দেশগুলো বিশেষ করে জাপান ও চীন বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে ৪০ বিলিয়ন বা ৪ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে।’

রেহমান সোবহান বলেন, সামগ্রিক বিচারে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের শীর্ষ জিডিপি হলেও চীন অনেকটাই ওপরে উঠে এসেছে; ভারত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে দক্ষিণের দেশগুলোর প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার হচ্ছে চীন। বৈশ্বিক পুঁজির বড় একটি অংশ সরবরাহ করছে চীন। অনেক দেশ চীনের বাজারে প্রবেশ করছে এবং চীনের পুঁজি ব্যবহার করে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ তার নিকটবর্তী দুটি বড় বাজার ঠিকঠাক ব্যবহার করতে পারেনি। সেই দুটি বাজার হচ্ছে ভারত ও চীন। রেহমান সোবহান আরও বলেন, ভারত সেই ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশের অধিকাংশ পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়ে রেখেছে। চীনও কয়েক বছর আগে এই সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু আমরা রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে পারিনি। আঞ্চলিক সরবরাহ ব্যবস্থায় সম্পৃক্ত হতে পারিনি।

এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের করণীয় সম্পর্কে আলোকপাত করেন রেহমান সোবহান। বলেন, ‘আমাদের নীতি প্রণেতাদের আরও গতিশীল হতে হবে। পাশাপাশি বেসরকারি খাতকে আরও উদ্ভাবনী হতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাকের বাজার ধরে রাখা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজার সুবিধা পেতে এলডিসি মর্যাদা আরও কিছুদিন ধরে রাখতে চাইছি, তা পুরোনো চিন্তা বলে সমালোচনা করেন রেহমান সোবহান। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের রপ্তানি হয় ৮ বিলিয়ন বা ৮০০ কোটি ডলারের মতো। কিন্তু সেই বাজার ক্রমেই রাজনৈতিক কারণে অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে, এই অনিশ্চয়তা অর্থনৈতিক কারণে নয়।’