একই দিনে গণভোটের প্রস্তুতি নিতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) চিঠি দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এক দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট করতে হবে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি বেশ চ্যালেঞ্জিং বিষয়। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনমত গঠনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো গণভোট। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয়ের ওপর জনগণের সমর্থন আছে কি না তা যাচাইয়ে যে ভোট অনুষ্ঠিত হয় তাকে গণভোট বলে। গণভোটে ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ ব্যালটে সিল দেওয়া হয়। ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়নে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত বা সম্মতি নেওয়ার জন্য একটি গণভোট আয়োজনের বিষয়ে কথা বলছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। যা ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই পরিচালনা করার নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘জুলাই সনদ’ সম্পর্কে এখনো সাধারণ মানুষের মধ্যে ধোঁয়াশা রয়েছে। অনেকেরই এটি সম্পর্কে নেই স্পষ্ট ধারণা। আবার এর কিছু ধারা নিয়েও রয়েছে দ্বিমত। এ ছাড়া ইসির রয়েছে লজিস্টিক সাপোর্টের অভাব। এটিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিও গণভোট নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে বলে মনে করছে। অপর রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী বলছে, একই দিন গণভোট ও সংসদ নির্বাচন হলে জেনোসাইড হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে দেশে। এমন পরিস্থিতিতে দেশে হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশে ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়নে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত বা সম্মতি নেওয়ার জন্য একটি গণভোট আয়োজনের বিষয়ে কথা জানিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সম্প্রতি কমিশনের সদস্যরা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, গণভোট যদি নির্বাচনের দিন অনুষ্ঠিত হয়, ভোটাররা আলাদা ব্যালট পেপারে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিয়ে জানাবেন, তারা সনদটি সমর্থন করেন কি না। এরপর যে দল পরবর্তী সংসদ গঠন করবে, তারা সনদ বাস্তবায়ন করবে। যদিও সংবিধান বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বের অনেক দেশেই কোনো সুনির্দিষ্ট বিষয়ে জনগণের মতামত নিতে গণভোট হয়েছে বা নেওয়ার চর্চা আছে। তবে সনদের বিষয়ে গণভোট সম্ভব না। সনদের কতগুলো ধারা, কতগুলো পাতা পুরোটার সঙ্গে কোনো ব্যক্তি একমত কি না সেটা ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ দিয়ে কীভাবে যাচাই সম্ভব? কেউ কেউ গণভোট আইন না থাকার বিষয়টিও সামনে আনছেন। আওয়ামী লীগ আমলে ২০১১ সালে সংবিধান থেকে গণভোটের বিধান বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল।
এর আগে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় খুঁজে পেতে গত ১১ সেপ্টেম্বর থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা ও তাদের সম্মতির জন্য গণভোটের বিষয়ে সব দল একমত হলেও কীভাবে হবে এই ভোটÑ জানতে চাইলে সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘বর্তমান সরকার বিভিন্ন রকমের কমিশন তৈরি করেছে। তার মধ্যে ঐকমত্য কমিশনের কাজ হয়েছে রাজনীতিটাকে বিরাজনীতিকরণ করা। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক লক্ষ্য থাকে, সেটা নিয়ে তারা জনগণের কাছে যায়। আর এরা এখানে বসে মাসের পর মাস মিটিং করেছে। এদের কোনো জনসম্পৃক্ততা নেই। ছোট ছোট দলগুলো তাদের সঙ্গে মিটিং করেই ধন্য। আমি মনে করি, বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া চলেছে। এটা হয়ে গেলে তখন কয়েকটা লোকের সিদ্ধান্ত দিয়ে পুরো দেশ চলবে।
গণভোটের প্রক্রিয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গণভোট অনেক ধরনের হয়। জুলাই সনদ যদি পাঁচ পাতার হয় এবং সেটাতে কতগুলো ধারা থাকে। পাঁচ পাতার মধ্যে চার পাতার সঙ্গে আপনি একমত, আরেক পাতার সঙ্গে আপনি একমত নন। সে ক্ষেত্রে এটা পড়ে আপনি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ সিদ্ধান্ত কীভাবে নেবেন।’
তবে এ ব্যাপারে আইন পাস না হলে এ ব্যাপারে কাজ শুরু করা যাবে না উল্লেখ করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসিরউদ্দিন বলেন, ‘আগামী সপ্তাহে গণভোটের আইন পাস হবে। আইন হলেই কাজ শুরু করবে কমিশন।’ সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আইন না হওয়া পর্যন্ত কমিশন এ বিষয়ে কাজ করতে পারবে না। আগামী সপ্তাহেই গণভোট আইনটি পাস করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। আইন পাস হলে সেই আইন অনুযায়ী কমিশন প্রস্তুতি ও সিদ্ধান্ত নেওয়া শুরু করবে। গণভোট হলে চারটি পয়েন্টেই ‘হ্যাঁ বা না’ ভোট হবে। একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট করা ইসির জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।’
গণভোট নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে মতপার্থক্য এবং তা বাস্তবায়ন নিয়ে সরকারের ঘোষণার পর নতুন এক প্রসঙ্গ তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট পরিচালনার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের দৃঢ়তা, মাঠ পর্যায়ের সকল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করা সর্বোপরি রাজনৈতিক দলগুলোর সহনশীল ভূমিকা কী মাত্রায় থাকবে তা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থ ও সুবিধা অনুযায়ী গণভোটকে বিবেচনা করলে ভোটারদের অংশগ্রহণ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকেও বেগ পেতে হবে। দলগুলোর উচিত দলীয় স্বার্থের সঙ্গে গণঅভ্যুত্থানের জনআকাক্সক্ষাকে সংযুক্ত করে আগামী দিনের নির্বাচনি ইশতেহার ও প্রতিশ্রুতির কাঠামো নির্ধারণ করা।’
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত তিনটি গণভোটের কথা জানা যায়। দুটি প্রশাসনিক গণভোট আর একটি সাংবিধানিক গণভোট। প্রথম প্রশাসনিক গণভোট হয় ১৯৭৭ সালে। লক্ষ্য ছিল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনকার্যের বৈধতা দান। এতে ফলাফলে দেখা যায়Ñ ৯৮ দশমিক ৮০ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়েছিল। দ্বিতীয় প্রশাসনিক গণভোট হয় ১৯৮৫ সালে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সমর্থন যাচাইয়ের লক্ষ্যে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট। ফলাফল ৯৪ দশমিক ১৪ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়েছিল। আর তৃতীয়টি সাংবিধানিক গণভোট অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯১ সালে। সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী আইন প্রস্তাবের বিষয়ে, যার ফলাফল ৮৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়েছিল।
এদিকে জুলাই সনদ নিয়ে এখনো ধোঁয়াশায় সাধারণ মানুষ। এটির প্রতিটি ক্লজ এখনো বুঝে উঠতে পারেননি উল্লেখ করে বেসরকারি কর্মকর্তা সোলায়মান হোসেন বলেন, ‘জুলাই সনদ নিয়ে দেশে নানা কিছু হচ্ছে। কিন্তু এটি আসলে কী সেটাই এখনো বুঝতে পারিনি। এটির বিষয়ে কী ভোট দেব?’
একই কথা বলেন কলেজ শিক্ষিকা প্রিয়াশা শর্মা। তিনি বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হলে কি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাতিল হয়ে যাবে না এটি নতুন আরেকটি ইতিহাস হবেÑ এ বিষয়টি এখনো বুঝতে পারিনি। তাই এর বিষয়ে কীভাবে হ্যাঁ বা না ভোট দেব তা বুঝে উঠতে পারছি না।’
গণভোটের ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ মানুষ বুঝতে পারছে না বলে দাবি করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ‘পিআর দেশের মানুষ বোঝে না। পিআরের সঙ্গে আমরা পরিচিত নই। গণভোটের ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ মানুষ বুঝতে পারছে না। শেষদিন পর্যন্তও বুঝতে পারবে না।’ গতকাল শনিবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘গত ১৫-১৬ বছর একটা ভয়াবহ দানবীয় সরকার ছিল। নিজের লোক, দলের লোক বসাতে গিয়ে সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়েছে। শহীদ জিয়াউর রহমানের দল বিএনপি ধর্মীয় মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিয়েছে।’
এদিকে নির্বাচনের দিন গণভোট হলে দেশে জেনোসাইড হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে উল্লেখ করে একই দিন চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান দাবি করেছেন, ‘ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই। সেটা আমাদের তৈরি করতে হবে। আপনারা প্রস্তুত থাকুন, এই নির্বাচন হতে হবে। এই নির্বাচন না হলে দেশে সংকট দেখা দেবে। আমরা কোনো সংকট তৈরি হতে দেব না।’ তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচনের দিন গণভোট চাই না। নির্বাচনের দিন গণভোট হলে জেনোসাইড হওয়ার ঝুঁকি আছে। পিআরের দাবি বাস্তবায়ন হবে জনগণের স্বার্থে। আমরা ক্ষমতায় গেলেও কথা দিচ্ছি, পিআর আমরা বাস্তবায়ন করব।’ ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘স্থানীয় নির্বাচনের কথা বলছি না, এখন তা সম্ভব নয়। এই সময়ের মধ্যে আমরা অবাস্তব কথা বা দাবি করছি না, করবও না। আমি জামায়াতের বিজয় চাই না, জনগণের বিজয় চাই। নির্বাচনের দিন গণভোট ভালোভাবে চাই না। নির্বাচনের দিন গণভোট হলে জেনোসাইড হতে পাারে।’
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আইনুল ইসলাম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনকে সেভাবে আইনি কাঠামো তৈরি করতে হবে। যেহেতু সরকার এ বিষয়ে ইসিকে চিঠি দিয়েছে, সেহেতু ইসিকে এ ব্যাপারে যা যা করণীয় তা করতে হবে। এটি একটি বড় রকমের চ্যালেঞ্জ। এক দিনে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে এটি আয়োজন করা খুব কঠিন। বিশেষ করে একজন ভোটারের একসঙ্গে দুটি ভোট দিতে বাড়তি সময় লাগবে, জায়গা লাগবে, জনবল লাগবেÑযা নির্বাচন কমিশনের জন্য আসলেই কঠিন।’
নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘প্রযুক্তিগত ও লজিস্টিক প্রস্তুতিতে কমিশন যথেষ্ট সক্রিয়; কিন্তু গণভোট যুক্ত হয়ে যাওয়ায় তাদের স্বাভাবিক প্রস্তুতির কাঠামো এখন প্রায় দ্বিগুণ চাপের মুখে পড়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে এবারই প্রথম একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং গণভোট আয়োজন করতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এমন কঠিন বাস্তবতায় দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পূর্ণ করলেও সামনে যে কাজ, তার জটিলতা ও পরিধি এই কমিশনের আগের সব অভিজ্ঞতাকে ছাড়িয়ে গেছে। কারণ একই দিনে দুই ধরনের ভোট মানে দ্বিগুণ ব্যালট, দ্বিগুণ প্রশাসনিক প্রস্তুতি, দ্বিগুণ পর্যবেক্ষণ; কিন্তু সময় ও সম্পদের চাপ হবে এক দিনের। সেই চাপ কীভাবে সামাল দেবে ইসি, এটিই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।

