ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৪ ডিসেম্বর, ২০২৫

দুই ছাত্র উপদেষ্টা অনিশ্চিত, এনসিপিতে ভাঙনের সুর!

এফ এ শাহেদ
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৪, ২০২৫, ০২:৪৬ এএম
গ্রাফিক্স : রূপালী বাংলাদেশ

জুলাই গণঅভুত্থানের সম্মুখ সারির একঝাঁক তরুণের নেতৃত্বে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিকল্প শক্তি হিসেবে গড়ে ওঠে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। যদিও দল গঠনের পর থেকেই নানা বিতর্কে জড়িয়েছেন দলটির নেতারা। বিভিন্ন কেলেঙ্কারিতে বহিষ্কারও হয়েছেন অনেকে। পাশাপাশি অনেক নেতা অভিযোগ জানিয়ে পদত্যাগও করেছেন।

এবার অন্তর্বর্তী সরকারের দুই ছাত্র উপদেষ্টা  আসিফ মাহমুদ ও মাহফুজ আলম পদত্যাগ করে জাতীয় নাগরিক পার্টিতে (এনসিপি) যুক্ত না হয়ে ভিন্ন দুটি রাজনৈতিক দলে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ফলে এনসিপির একটি অংশ দল থেকে বের হয়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। যার আভাস মিলেছে সদ্য পদত্যাগ করা দক্ষিণাঞ্চলের সাবেক সংগঠক মুহাম্মদ রাকিবের কথায়।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই অন্তর্বর্তী সরকারে থাকা দুই ছাত্র প্রতিনিধি উপদেষ্টার পদত্যাগ অনেকটাই নিশ্চিত। তবে তাদের পরবর্তী গন্তব্য নিয়ে চলছে বিভিন্ন হিসাব-নিকাশ, দেনদরবার ও জল্পনা। বিশেষ করে স্থানীয় সরকার এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সাম্প্রতিক বক্তব্যে রহস্য বেড়েছে। তিনি উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ এবং সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা জানালেও কোন দলের হয়ে ভোটের লড়াইয়ে নামবেন, তা স্পষ্ট করেননি। তবে নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগ মুহূর্তে পদত্যাগ এবং ঢাকা-১০ আসন থেকেই নির্বাচন করবেন বলে তার ঘনিষ্ঠ একাধিকজন রূপালী বাংলাদেশকে জানিয়েছেন।

অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ এবং এই সময়সীমায় অনড় থাকার কথা এরই মধ্যে একাধিকবার জানিয়েছে। জুলাই আন্দোলনে আসিফ মাহমুদের সহযোদ্ধাদের গড়া দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) সেই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে জানা গেছে, সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে আসিফ মাহমুদ বা এনসিপির পক্ষ থেকে এখনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। বরং কিছু বিষয়ে দুপক্ষের মধ্যে তৈরি হয়েছে দূরত্ব। আর তাতে উপদেষ্টা পদ ছেড়ে এনসিপিতে যোগ দিয়ে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হওয়া কিংবা নির্বাচন করার বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশা দেখা দিয়েছে।

উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, এনসিপির কিছু শীর্ষ নেতার সহযোগিতা না পেয়ে দলের সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ ভেঙে এনসিপির সহযোগী ছাত্র সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে জাতীয় ছাত্রশক্তি। সেখানেও আসিফ মাহমুদ ঘনিষ্ঠদের ‘মাইনাস’ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ফলে দুই পক্ষের মধ্যে আরও বেড়েছে দূরত্ব। এমন প্রেক্ষাপটে আসিফ মাহমুদ এবং তার ঘনিষ্ঠদের এনসিপির বেশকিছু শীর্ষ নেতা এড়িয়ে চলছেন বলেও জানা গেছে। এমন প্রেক্ষাপটে আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার বিএনপি বা গণঅধিকার পরিষদ থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে।

এদিকে, চলতি মাসেই নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা হওয়ার কথা থাকলেও এখনো সরকারের ছাত্র উপদেষ্টা মাহফুজ আলম রয়েছেন সিদ্ধান্তহীনতায়, পদত্যাগের বিষয়ে কোনো বার্তা স্পষ্ট করেননি। আসিফ মাহমুদ নির্বাচনের ঘোষণা দিলেও তার সিদ্ধান্ত এখনো অনিশ্চিত। তথ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের কাছ থেকে নির্বাচনের বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত বার্তা পাওয়া যায়নি। মাহফুজ আলমের ক্ষেত্রে তার পক্ষের কিছু সূত্র বলছে, তিনি হয়তো সরকারের শেষ সময় পর্যন্ত দায়িত্বেই থাকতে পারেন এবং নির্বাচনে অংশ নাও নিতে পারেন। নির্বাচনে অংশ নিলেই কেবল পদত্যাগ করবেন তিনি।

দুই ছাত্র উপদেষ্টার সিদ্ধান্তহীনতা এবং এনসিপিতে যুক্ত হওয়া নিয়ে দলটির মধ্যে নানা সমীকরণ চলছে। জানা যায়, দুই ছাত্র উপদেষ্টার ইচ্ছা ছিল বিএনপির সঙ্গে এনসিপির জোট গঠনের। তবে সেটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। যদিও সম্প্রতি দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বিএনপির সঙ্গে জোট গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি এক বক্তব্যে অভিযোগ করেন, কয়েকটা সিটের লোভ দেখিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্রকে হত্যার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ছোট ছোট দলকে কয়েকটা সিটের লোভ দেখিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে বহুদলীয় গণতন্ত্র, সেটাকে হত্যার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

এদিকে, এনসিপি, এবি পার্টি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি)-কে নিয়ে একটি তৃতীয় রাজনৈতিক জোট গঠনের চেষ্টা হলেও তা সফল হয়নি। তাদের সর্বশেষ বৈঠকে,  ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতাদের একাংশের উদ্যোগে গঠিত রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম আপ বাংলাদেশকে (ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ) নির্বাচন জোটে রাখার প্রশ্নে এনসিপির নেতারা তীব্র আপত্তি তোলেন। আর গণ অধিকার পরিষদের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে এই জোটে আসা নিয়ে মতভেদ ছিল। যে কারণে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই জোট গঠন প্রক্রিয়া শেষ হয়।

এনসিপির নির্বাচনি জোটের বিষয়ে দলটির কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য আবদুল্লাহ আল আমিন রূপালী বংলাদেশকে বলেন, ‘প্রার্থী তালিকা তৈরির কাজ চলছে। চলতি সপ্তাহের মধ্যেই এই তালিকা প্রকাশিত হতে পারে। তবে ৩০০ আসনের তালিকা কয়েক ধাপে প্রকাশ করার সম্ভাবনা বেশি, যা থেকে বলতে পারি আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেবে এনসিপি।’

এদিকে জোটের বিষয়ে এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, ‘বড় কোনো দলের সঙ্গে এখনো রাজনৈতিক জোটের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। সমঝোতার পাশাপাশি এনসিপি এককভাবে নির্বাচন করার প্রস্তুতিও রাখছে।’

এদিকে দুই ছাত্র উপদেষ্টার এনসিপিতে যোগদান করা না করার দ্বন্দ্বে ভাঙনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে দলটিকে। জাতীয় নাগরিক পার্টি থেকে সদ্য পদত্যাগ করা দক্ষিণাঞ্চলের সাবেক সংগঠক মুহাম্মদ রাকিবের কথায় মিলেছে এমনই আভাস। রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘এনসিপির এখন অনেকটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও মন্ত্রিপাড়াকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। যোগ্যদের যোগ্য স্থানে মূল্যয়ন না করে বিভিন্ন জনের এজেন্ডাভিত্তিক ব্যক্তিকে পদায়ন করা হয়েছে। এনসিপির অনেক নেতা আর্থিক কেলেঙ্কারিসহ নানা অপকর্মে জড়াচ্ছেন, যা গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষার সম্পূর্ণ পরিপন্থি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা জেনেছি একজন ছাত্র উপদেষ্টা পদত্যাগ করে এনসিপিতে যুক্ত হবেন না। যার প্রভাব পড়বে দলে। এনসিপি থেকে একটি অংশ বের হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।’

এদিকে গতকাল বুধবার রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে তপশিল ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।