ডিজিটালাইজেশন তথাপ্রযুক্তির অবিশ্বাস্য অগ্রগতি মানুষের জীবনকে সহজ করেছে। স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, টেলিভিশন, ফ্রিজ কিংবা ওয়াশিং মেশিন; সবকিছুই আজ হাতের নাগালে। তবে এ সুবিধার পেছনে একটি অন্ধকার দিক লুকিয়ে আছে, আর সেটি হলো ইলেকট্রনিক বর্জ্য বা ই-বর্জ্য। বলা চলে, প্রযুক্তি খাতের দুশ্চিন্তা এখন ই-বর্জ্য। বাংলাদেশে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ ই-বর্জ্য উৎপন্ন হলেও, সঠিক ব্যবস্থাপনায় বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় পিছিয়ে আছেন বাংলাদেশ। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বিষয়ে এখনই সচেতন না হলে, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যকে ভয়াবহ পরিণতির মুখোমুখি হতে হবে।
জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) সংজ্ঞা অনুযায়ী, নষ্ট বা বিকল হওয়া ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিক ডিভাইসের সকল অংশ বা যন্ত্রাংশকে ই-বর্জ্য হিসেবে চিহ্নিত হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, বৃহৎ হোম অ্যাপ্লায়েন্স (এসি, ওয়াশিং মেশিন, ফ্রিজ, টেলিভিশন ইত্যাদি) এবং মেডিকেল যন্ত্রপাতির মতো খাত থেকে সর্বাধিক ই-বর্জ্য তৈরি হয়। আর এই ই-বর্জ্যরে ক্ষতিকর প্রভাবে সবথেকে ঝুঁকিতে থাকেন শিশু ও গর্ভবতী নারী। ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউ) এবং জাতিসংঘের প্রশিক্ষণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ইউনিটার) ‘দ্য গ্লোবাল ই-ওয়েস্ট মনিটর-২০২৪’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে ২০১০ সালে ইলেকট্রনিক অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইকুইপমেন্ট (ইইই) এর পরিমাণ ছিল ৬২ বিলিয়ন কেজি, যা ২০২২ সালে এসে দাঁড়ায় ৯৬ বিলিয়ন কেজিতে। ২০৩০ সাল নাগাদ এর পরিমাণ ১২০ বিলিয়ন কেজিতে পোঁছাবে। এসব ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ থেকে ২০১০ সালের তুলনায় ২০২২ সালে বিশ্বজুড়ে ই-বর্জ্যরে পরিমাণ বেড়েছে ৮২ শতাংশ। ২০১০ সালে বিশ্বজুড়ে ই-বর্জ্যরে পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৪ মিলিয়ন টন। ২০২২ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৬২ মিলিয়ন টনে; যা প্রতিবছর ই-বর্জ্য বৃদ্ধির হার ৩৩ শতাংশ বা পরিমাণ ২ দশমিক ৬ মিলিয়ন টন হিসেবে ২০৩০ সাল নাগাদ ৮২ মিলিয়ন টনে পৌঁছাতে পারে। তবে যে হারে ই-বর্জ্য বাড়ছে, সেই হারে আনুষ্ঠানিকভাবে (ফারমাললি রেকর্ডেড) বাড়ছে না ই-বর্জ্যরে রিসাইক্লিং; বরং ই-বর্জ্য সংগ্রহ করে রিসাইক্লিং করার হার প্রতি বছর কমছে। ২০২২ সালে ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং এর হার ছিল ২২ দশমিক ৩ শতাংশ, যা ২০৩০ সালে ২০ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে প্রতিবেদনে। ২০১০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং এর পরিমাণ ছিল ৮ বিলিয়ন কেজি, যা ২০২২ সালে দাঁড়ায় প্রায় ১৪ বিলিয়ন কেজিতে। অর্থাৎ ২০২২ সালে উৎপাদিত ই-বর্জ্যরে মাত্র ২২ দশমিক ৩ শতাংশ আনুষ্ঠানিকভাবে রিসাইক্লিং হয়েছে।
ই-বর্জ্য উৎপাদন এবং সেগুলোর ব্যবস্থাপনায় সমসাময়িক অর্থনীতির অনেক দেশের তুলনায় পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার পরেও, ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় শক্তিশালী আইনি কাঠামোর অনুপস্থিতি এবং অংশীজনদের মাঝে সচেতনতার অভাবে দেশে হু হু করে বাড়ছে ই-বর্জ্য। আর সেগুলো বৈজ্ঞানিক ও মানসম্পন্ন উপায়ে রিসাইক্লিং না করা এবং অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে চলে যাওয়ায়, পরিবেশেই উন্মুক্ত হচ্ছে ই-বর্জ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ই-বর্জ্য থেকে অন্তত এক হাজার ধরনের রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশে উন্মুক্ত হতে পারে, যার মাঝে সব থেকে ক্ষতিকর হচ্ছে ‘লেড’ বা সিসা। তবুও বাংলাদেশে এ বিষয়ক সচেতনতা সামান্যই।
দ্য গ্লোবাল ই-ওয়েস্ট মনিটর-২০২৪ বলছে, এশিয়া অঞ্চলে ই-বর্জ্য উৎপাদনকারী অন্যতম দেশ বাংলাদেশ। মাথাপিছু ২ দশমিক ২ কেজি হারে, ২০২২ সালে বাংলাদেশে ৩৫০ মিলিয়ন কেজি ই-বর্জ্য তৈরি হয়। প্রতিবেশী দেশ ভারতে ৪ হাজার ১০০ মিলিয়ন, পাকিস্তানে ৫৬০ মিলিয়ন, ভুটানে ৫ দশমিক ২ মিলিয়ন, নেপালে ৪১ দশমিক ৫ মিলিয়ন কেজি ই-বর্জ্য তৈরি হয় ২০২২ সালে। অত্র অঞ্চলে ই-বর্জ্য তৈরির সর্বনি¤œ হার আফগানিস্তানের, ৩২৪ কেজি।
দীর্ঘ ১০ বছরের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দুইটি বিধির উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। এর একটি বন, পরিবেশ ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের ‘ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০২১’ এবং অপরটি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) প্রণীত ‘টেলিকম ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও রিসাইক্লিং সিস্টেম সংক্রান্ত নির্দেশিকা, ২০২২’। এ ছাড়াও, প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয় যে, বাংলাদেশে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অনুমোদিত বা লাইসেন্সবিহীন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও নগন্য। এই খাত সংশ্লিষ্টরাও জানিয়েছেন, দেশে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ করছে হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। যারা কাজ করছেন, তারাও সরকারের পক্ষ থেকে পাচ্ছেন না সহায়তা। ফলে ই-বর্জ্য নিয়ে কাজ করতে উল্লেখযোগ্য উৎসাহ পাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা।
ই-বর্জ্যরে রিসাইক্লিং নিয়ে কাজ করছে দেশিয় প্রতিষ্ঠান এনএইচ এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে দেশের টেলিযোগাযোগ খাত থেকে সৃষ্ট ই-বর্জ্যরে সিংহভাগ ব্যবস্থাপনা করছে। পাশাপাশি জাতিসংঘের কয়েকটি অঙ্গ সংস্থা এবং বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানের ই-বর্জ্য নিয়েও কাজ করছে এনএইচ এটারপ্রাইজ। দেশের প্রেক্ষাপটে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নানান সংকট তুলে ধরে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হায়দার বলেন, “ই-বর্জ্য অফিসিয়াল চ্যানেলে আসা জরুরি কারণ অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানগুলো ই-বর্জ্যরে সবটুকু ব্যবস্থাপনা করে। যেটা প্রয়োজনীয় না, সেটা ফেলে দেই না। কিন্তু অনানুষ্ঠানিক খাতে গেলে, যেমন ধরেন, ভাঙ্গারি দোকানে গেলে, সেই দোকানির যা প্রয়োজন, সেটা রেখে বাকিগুলো পরিবেশেই ফেলে দেবে। বাংলাদেশের ই-বর্জ্যরে ৯০ শতাংশই এভাবে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে যাচ্ছে। ২০২১ ও ২০২২ সালে কিছু নীতিমালা হয়েছে তবে সেগুলোর বাস্তবায়ন নেই। খোদ সরকারি সংস্থা ও কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে আগ্রহ ও সচেতনতা নেই। উদাহরণস্বরূপ, বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের পুরাতন বা অব্যবহৃত কম্পিউটার ও অন্যান্য ডিজিটাল যন্ত্রাংশ নিলামের মাধ্যমে বিভিন্ন মাধ্যমে বিক্রি করা হচ্ছে। এগুলো ই-বর্জ্য তাই নিয়ম হচ্ছে, এগুলো শুধু পরিবেশ অধিদপ্তর অনুমোদিত ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে দিতে হবে। আইসিটি পণ্যের সর্বাধিক ব্যবহারকারী সরকার, কিন্তু সরকার নিজেই এর ব্যবস্থাপনা করছে না।’
সচেতনতা ও আইনের প্রয়োগের অভাবে দেশিয় প্রতিষ্ঠানগুলো সক্ষমতার সমান ই-বর্জ্য রিসাইকেল করতে পারছে না বলেও জানান এই উদ্যোক্তা। নাজমুল বলেন, বাংলাদেশে যে পরিমাণ ই-বর্জ্য তৈরি হয়, তার ৩০ শতাংশ প্রসেস করার সক্ষমতা এনএইচ প্রতিষ্ঠানসহ দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর রয়েছে। কিন্তু আমরা মাত্র ২ শতাংশ বর্জ্য পাচ্ছি প্রসেস করার জন্য।’
ই-বর্জ্য যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনা করলে দেশীয় উৎপাদন খাতে কাঁচামাল সরবরাহ এবং বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে উল্লেখ করে নাজমুল হায়দার বলেন, একটি ডিজিটাল ডিভাইস থেকে পৃথকীকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন কম্পোনেন্ট রিসাইক্লিং এর মাধ্যমে আলাদা করা হয়। সার্কিট বোর্ড, পিসিবি বোর্ড আন্তর্জাতিক নিয়মে সংরক্ষণের পরেও, ই-বর্জ্য থেকে গুরুত্বপূর্ণ ধাতু পাওয়া যায়। সেগুলোকে বিভিন্ন অংশীজনদের মাঝে সরবরাহ করি, যেগুলো কাঁচামাল হিসেবে তারা তাদের পণ্য উৎপাদনে ব্যবহার করে। যেমন দেশীয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন আমাদের থেকে অ্যালুমিনিয়াম নেয়। এ ধরনের পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় অনেক প্রতিষ্ঠানকে। ই-বর্জ্য রিসাইকেল করে এ ধরনের প্রয়োজনীয় জিনিস যদি আরও বেশি বাজারে সরবরাহ করা হয় তাহলে কাঁচামালের চাহিদা পূরণ হওয়ার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।’
এখনই ই-বর্জ্য নিয়ে সচেতন না হলে আগামীতে এর নেতিবাচক প্রভাব আমাদেরই বহন করতে হবে বলে সতর্ক করেছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এখন থেকেই প্রস্তুতি না নিলে, আগামীতে অর্থ খরচ করে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করতে হবে।

 
                            -20250830120408.jpg) 
                                     সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                    -20251031020255.webp) 
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       -20251025002118.webp) 
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন